টপিকঃ কারখানায় আগুন লাগার পর শোনা যায়, গেট তালাবদ্ধ
বাংলাদেশে বিভিন্ন কারখানায় আগুন লাগার পর শোনা যায়, গেট তালাবদ্ধ থাকা কারণে শ্রমিকরা আটকা পড়ে মারা গেছে। কারখানার গেট তালাবদ্ধ থাকে কেন?
কোনো কারখানায় আগুন লাগার খবর শুনলে সাথে আরেকটা তথ্য শুনে থাকবেন সবাই………
সেটা হলো আগুন লাগার পর কারখানার গেট লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো। যার কারণে ভেতরে থাকা শ্রমিকরা বের হতে পারেনি এবং ভিতরেই জ্বলেপুরে মৃত্যুবরণ করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো…...
কেন গেইটে তালা মেরে দেয়া হয়?
কেন শ্রমিকদেরকে বাইরে বের হওয়ার পথ আটকে দেয়া হয়?
কেন এই অমানুষিক কাজটি করা হয়?
কোনো এক সেমিস্টারে “বাংলাদেশ লেবার কোড-২০০৬” মুখস্ত করেছিলাম। যা মুখস্ত করেছিলাম তার কিছুই মনেই নাই।কিন্তু যা বুঝেছিলাম তার প্রায় অনেকটাই মনে আছে।
“ফায়ার সেফটি” পড়তে গিয়ে উপর্যুক্ত প্রশ্নটি মাথায় এসেছিলো।ঘাটাঘাটি করে যা বুঝতে পেরেছি তা আসলে কোনো স্বাভাবিক মানুষই গ্রহণ করতে পারবেনা।
সোজা কথায় বলে দেই…… কারখানার এসব দূর্ঘটনার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা যত বেশি হবে কারখানার মালিকের ‘আর্থিক’ ক্ষতির পরিমাণ ততই কমবে!
দুইটা কারণ বলিঃ
১। বীমা কোম্পানির ব্যাপারে তো জানেন।প্রত্যেকটা কারখানাই বীমা করা থাকে।যেকোনো দূর্ঘটনা ঘটলে পরে আর্থিক ক্ষতি থেকে বাঁচতেই বীমা করতে হয়।কারখানায় আগুন ধরে যাওয়া মানেই ক্ষতি হবে। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
কিন্তু কারখানার মালিক যদি বীমা কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ লেবার ডেথ শো করাতে পারে তাহলেই তার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমে যায়।ক্ষতির বহন করে বীমা কোম্পানি।
২। এই কারণটা একটু মন দিয়ে পড়ুন।
মনে করেন ওই কারখানায় ১০০ শ্রমিক ছিলো আগুন লাগার সময়।এখন সবাই আহত হলে ১ লাখ টাকা করে দিলেও দিতে হবে ১ কোটি টাকা (লেবার কোড অনুযায়ী দিতেই হবে)।
কিন্তু আপনি যদি ওই মানুষগুলোকে আটকে রাখতে পারেন তাহলে কি হবে?তালা মারার পর সেখানের খবর আর কেউ জানবে না!এরপর ১০০ জনের ভিতর ১০ জনের লাশ পাওয়া যাবে।৯০ জন গায়েব।এই ৯০ জন পুরো কয়লা হয়ে যাবে।কয়লাকে লাশ হিসেবে কেমনে ধরবেন!
দুঃখিত, লাশ না। কয়লা।
বাকি যে ১০ জনের লাশ পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে ২ লাখ করে দিলে লাগবে ২০ লাখ টাকা।কারণ আহত ১ লাখ টাকা হলে, নিহত ২ লাখ টাকা।ঘটনা ধামাচাপা দিতে আরো ২০ লাখ ধরলাম।৪০ লাখ গেল।হাতে থাকল ৬০ লাখ!শুধুমাত্র একটা ১৫০ টাকার তালা দিয়েই ৬০ লাখ টাকা সেভ করে ফেললেন!
তার উপর এই শ্রমিকরা আহত হয়ে বেঁচে গেলে আরো বিপদ। এদেরকে চালাইতে হবে। ভরণপোষণ দিতে হবে।চিকিৎসা খরচ দিতে হবে।এতো ঝামেলায় না গিয়ে তালা মেরে দিলেই খেলা শেষ।
একদিকে, বীমার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার রাস্তা সহজ হয়। অপরদিকে, মালিকের পকেটও বেঁচে যায়।
কোনো এক্সিকিউটিভ/এমপ্লোয়ার লেভেলের লোক মরতে শুনেছেন?আমি শুনিনি।আর শুনলেও এতো কম শুনেছি যে মনেই পরেনা।
আগুন লাগার সময় প্রত্যেকটা ফ্লোরে অবশ্যই এমপ্লোয়ার লেভেলের লোক থাকে।তারা ঠিকই বের হয়ে যায়।তারমানে আগুন লাগার পর বের হবার রাস্তা আছে।তালা শুধু শ্রমিকদের জন্যই!
এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে তালা মারার সময় শ্রমিকরা তালা ভেঙ্গে ফেলেনা কেন অথবা প্রতিবাদ করেনা কেন?
তার মূল কারণ বেতন, চাকরি বাঁচানো।চিল্লাইয়া মরবে নাকি (কারণ তারা জানেনা যে মরতে যাচ্ছে)!সম্ভবত প্রথমে তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয় যে কিছুই হবেনা। তারা এটা শুনে চুপচাপ থাকে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে ততক্ষণে আসলে অনেক দেরি হয়ে যায়!
এই অংশটা ধারণামাত্র।
কিন্তু এটাই যে হয় তা অনুমান করা কঠিন কিছুনা।
আর আগুন সবসময় ‘এক্সিডেন্টলি’ লাগেনা।ইচ্ছাকৃতও আগুন লাগানো হয়।বীমার টাকা মানেই নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে পারা।
অনেক কিছুই বলা যায়।কিন্তু বলে লাভ নেই।শুধু তালা দেয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করলাম।বাইরের দেশগুলোতে এমন হয় কিনা আমার জানা নেই।
তবে একটা সত্য কথা হলো…… আমাদের দেশের মানুষ ভালোনা।
প্রত্যেকটা দূর্ঘটনার পর শুনবেন বিল্ডিং এ ৫ টা সিড়ি থাকার কথা থাকলেও ছিলো মাত্র দুইটা, এক্সিট পয়েন্ট থাকা মেন্ডাটরি হলেও তা ছিলোনা, ২ তলার পারমিশন নিয়ে বানাইছে ১০ তলা………শুধু মালিকপক্ষকে খারাপ ধরাই যায়।কিন্তু আমি দেখতেছি ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসন, ডাক্তার(ডেথ রিপোর্টের সাথে জড়িত), মালিক, ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রের নেতা সবাই জড়িত!
এদের সবাই কখনো না কখনো টাকা খেয়ে ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এতো বড় বড় অপরাধ করে ঘুমায় কেমনে এরা!
©ইফতেখার আহমেদ।