টপিকঃ একাকী শিক্ষক
উপন্যাসটা ফেবিকলের মত আটকে রেখেছে শুভময় সেনকে। অনেকক্ষণ থেকেই টয়লেট যাওয়ার তাগিদটাকে অস্বীকার করছে ও। এমন সময় কলিং-বেল। একটু অবাক হল। এই সময় কে আবার এলো? উঠতেই হল ওকে। দরজা খুলল। কোলাপসেবল গেটে তালা। চারজন ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে। “তোমরা দু-মিনিট দাঁড়াও, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।” কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাথরুমে ঢুকল শুভময়।দুমিনিটেই ফিরল ও।
- তোমরা? ঠিক চিনলাম নাতো?
- আমরা “সঙ্ঘবদ্ধ” ক্লাব থেকে আসছি।
- “সঙ্ঘবদ্ধ”! হ্যাঁ নাম শুনেছি। বেশ বড় পুজো হয়। কিন্তু সেতো অনেকটা দূরে। আমিতো কোনোবারই এই পুজোয় চাঁদা দেই না।
- না, না। আমরা চাঁদার জন্য আসিনি। আগামী রোববার পঞ্চমী। আমাদের ক্লাবের দুর্গা-প্রতিমা উদ্বোধন হবে। আপনাকে যেতে হবে।
- আমি! প্রতিমা উদ্বোধনের দিন! তোমরা কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দাঁড়াও, গেটটা খুলি। ভেতরে এসো।(কথাটা বলে কোলাপসেবল গেটের তালা খুলতে গেল শুভময়।)
- না, না। তালা খোলার দরকার নেই। আমাদের হাতে বেশী সময় নেই। ঐদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ রেডি থাকবেন। গাড়ি নিয়ে নিতে আসবো।
- কিন্তু বাবা আমিতো ভাল বক্তৃতাও দিতে পারিনা। আমাকে তোমরা শুধু শুধু কেন এই সব ......
- না, না। বক্তৃতা দিতে হবে না। শুধু উপস্থিত থাকলেই চলবে। ওইদিন একদম রেডি থাকবেন। আজ আমরা আসি।
ছেলেগুলো চলে গেলে, ওদের যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল শুভময়। তার একার জীবনে পেপার-ওয়ালা, কাজের মহিলা ও তার ছেলে ছাড়া বিশেষ কেউ তার সাথে সচরাচর দেখা করতে আসে না। কিন্তু একসময় এ বাড়ির বারান্দায় বেশীরভাগ সময়েই বারো থেকে পনের জোরা জুতো দেখা যেত। প্রচুর ছাত্র পড়াতো শুভময়। রিটায়ার করার সাথে সাথে সে সংখ্যা কমতে কমতে বছর দু-একের মধ্যেই সেটা প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়ায়। এখন শুধু কাজের ভদ্রমহিলার ছেলেটি আসে বিনে-পয়সায় অঙ্ক বুঝতে। আসলে মানুষ এখন জ্ঞান নয়, পয়সা দিয়ে ভালো রেজাল্ট কিনতে চায়। তাছাড়া ভীষণ ডিসিপ্লিন লাইফ লিড করে শুভময়। আর তার নিয়মের বাইরে চললে বা কেউ তার জীবনের ছন্দের পতন ঘটালে তার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে শুভময়। সে কোনও ছাত্রই হোক, আর কোনও কাছের লোকজনই হোক। আর এই কারণেই স্ত্রী-পুত্রের সাথে এখন তার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। শুভময়ের জীবন বেশ পরিমিত ও শৃঙ্খলিত। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা সব অঙ্ক করে, বিজ্ঞান মেনে। অন্যায় করা বা তাকে প্রশ্রয় দেওয়া দুটোই শুভময়ের স্বভাব বিরুদ্ধ। চিরকাল-ই সে দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়ালেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। তাই সে আজ একা। ভীষণ একা। তবুও আজ শুভময়ের জীবনে একটা গতি আছে, একটা ছন্দ আছে। রোজকার নিয়মিত জীবনে ব্যায়াম, প্রাণায়াম, বই, খবরের কাগজ যেমন আছে, তেমনি আছে স্মার্ট ফোন, ইন্টার-নেট। ফেসবুক, হোয়াটস-অ্যাপের সাথে সম্পর্ক থাকলেও সেখানে বন্ধু সংখ্যা খুব-ই সামান্য। পঁয়ষট্টি বছরের এই পৌঢ়ের শরীর মন দুটোই তরুণ। আধুনিক প্রযুক্তিকে মেনে নিতে বা ব্যবহার করতে কোনও বাধা নেই তার। তবে সবকিছুই হিসেব কষে, অঙ্ক করে। তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী আজ বিদেশে আছে। কেউ বা দেশেই ভিন্ন রাজ্যে সম্মানীয় পদে চাকুরী করছে। বছরে একবার নিয়ম করে কোনও টুর- ট্রাভেলের সাথে বেড়াতে বের হয় শুভময়। বেড়াতে গিয়ে অনেক সময়-ই পুরনো ছাত্র-ছাত্রীর সাথে দেখা হয়েছে। শুভময় তাদের চিনতে না পারলেও তারা শুভময়কে চিনে নিয়ে কুশল বিনিময় করেছে। এতো কিছুর মধ্যে এনগেজ থাকলেও এক সময় নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয় শুভঙ্করের।মন তখন মনের কথা সেয়ার করার লোক খোঁজে। ইচ্ছে করে বৌ, ছেলে, নাতির সাথে সময় কাটাতে। কিন্তু তারাতো অনেক দূরে। দূরত্বটা ভৌগলিক হলে তবু তার নাগাল পাওয়া যায়। কিন্তু মানসিক হলে .....
পঞ্চমীর দিন। শুভময় একদম রেডি। মনের কৌতুহলটাকে আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। যে ক্লাবের একটি লোকের সাথে তার কোনো পরিচয় নেই, তারা হটাৎ প্রতিমা উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তাকে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কেন? পাঁচটার আগেই গাড়ি এসে উপস্থিত হল শুভময়ের বাড়ির সামনে। সময়ের ব্যাপারে শুভময় ভীষণ পাঞ্চুয়াল। তাই ক্লাব কর্তৃপক্ষ এইদিকটায় খুব সচেতন ছিল। অনেকগুলো বই ঘেঁটে একটা বক্তৃতা রেডি করেছে শুভময়। বাই-চান্স কিছু বলতে বললে যেন অপ্রস্তুতে পরতে না হয়। “বাঙ্গালীর জীবনে দুর্গাপূজার ভূমিকা” এই বিষয়েই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেডি করেছে ও। ক্লাবের সামনেই এক বাড়িতে ড্রইং রুমে শুভময়কে বসাল ওরা। খানিকক্ষণ পরে একটা শোরগোল শোনা গেল। শুভময় দেখলও বছর তিরিশের একজন সুদর্শন যুবক ঘরে ঢুকছে, আর তাকে ঘিরে রয়েছে একদল তরুণ-তরুণী। ক্লাবের কর্মকর্তারা ভীর সরিয়ে এই যুবককে ঘরে আনার চেষ্টা করছে। মিনিট পাঁচেক চেষ্টার পর, যুবকটির বেশ কিছু অটোগ্রাফ বিনিময়ের মাধ্যমে সেই ভীর অপসারণ সম্ভব হল। শুভময়ের এই যুবকটিকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছিল। কিন্তু সে কে বা কোথায় ওকে দেখেছে তা কিছুই মনে করতে পারলো না শুভময়। “স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন?” কথাটা বলেই শুভময়কে ঢিপ করে প্রণাম করল যুবকটি। শুভময় তার অভিব্যক্তি আর ঈষৎ মাথা নাড়ানোর মাধ্যমে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ওকে চিনতে পারেন নি। “ওনাকে চিনলেন না? উনি তো মেগা-স্টার বাংলার ব্যস্ত নায়ক “জয়”।” ক্লাবের এক কর্মকর্তার বক্তব্য। “ও, তাই কেমন চেনা-চেনা লাগছে। আসলে সিনেমা তো তেমন দেখা হয় না, তাই ...” জয় শুভময়ের পাশের চেয়ারটায় বসল। “আমি শুধু সিনেমার নায়ক নই, আমি আপনার ছাত্র। সুজয়কে চিনতে পারলেন না স্যার?” “সুজয়! ও, হ্যাঁ মনে পরেছে। তুমি তো ভালো মিমিক্রি করতে।” শুভময়ের মুখে অনেক দিন পর কোনো হারানো জিনিষ খুজে পাওয়ার অভিব্যক্তি।“যাক, চিনতে পেরেছেন তাহলে!” কথাটা বলে ক্লাবের কর্মকর্তাদের দিকে মুখ ঘোরালেন জয়। “জানেন, আমি ক্লাসের গ্যাপ টাইমে সব টিচারদের কথাবার্তা, চলাফেরার স্টাইল নকল করে দেখাতাম। এরজন্য বহুবার বিভিন্ন স্যারেদের কাছে ধরা পরে বকা মারও খেয়েছি। একদিন শুভময় স্যারকেই নকল করছিলাম। উনি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি খেয়ালই করিনি। হটাৎ ওনার দিকে চোখ পরতেই আমি থতমত থেয়ে থেমে গেলাম। উনি বললেন “থামলি কেন, ভাল হচ্ছে। কর পুরোটা কর।” আমি ইতস্ততা করলে উনি আমাকে অভয় দিয়ে পুরোটা করালেন। বললেন “এই গুনটা নষ্ট হতে দিস না। সবাইকেই যে বিদ্যান হতে হবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এই অভিনয়ের গুনটা তোর সহজাত। আমার এক বন্ধু আছে, গ্রুপ থিয়েটার করে। তুই ওর গ্রুপে ভর্তী হয়ে যা।” এরপর স্যারই সব যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই গ্রুপে থেকে ভালো করে অভিনয়টা শিখলাম। সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ বাড়তে থাকলো। আর তার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো সংগ্রাম। তারই ফলস্বরুপ আজ আমি এই যায়গায়। স্যার ঐ ভাবে শুরুটা না করিয়ে দিলে এটা কোনোদিনই সম্ভব হত না।” “ও এইবার বুঝলাম আপনি কেন শুভময় বাবুর সাথে দেখা করার জন্য এতো উদগ্রীব হয়েছিলেন।” ক্লাবের এক কর্মকর্তার বক্তব্য।
- হ্যাঁ, স্যারের সাথে যোগাযোগের ইচ্ছেটা বহুদিন ধরেই ছিল। এখানের পূজো উদ্বোধনের অফারটা যখন এলো, থন ভাবলাম আপনারা যদি এই ইচ্ছেটা পুরন করতে পারেন। আপনাদের হয়তো একটু কষ্ট দিয়েছি।
- না, না। কষ্ট কিসের? স্কুল থেকে আমরা ওনার অ্যাড্রেস জোগাড় করি। বাকি কাজ ক্লাবের ছেলেরা করেছে।
প্রতিমা উদ্বোধনের আয়োজন সম্পূর্ণ হতেই ডাক পরলো জয়ের। জয় শুভময়কে নিয়েই মঞ্চে উঠল। মঞ্চে রয়েছেন ক্লাব সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, মহিলা কমিটির সভাপতি এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা। সঞ্চালিকা জয়কে কিছু বলতে বললে সে বলল তার শুভময় স্যারের হাত ধরে আজকের “জয়” হয়ে ওঠার গল্প। আর তার সাথে সে সংযোজন করল “আজ আমার নাম, যশ, প্রতিপত্তি কোনও কিছুরই অভাব নেই। অভাব অভিবাবকের। অভাব শাসনের। অভাব ভুল শুধরে দেওয়ার লোকের। তাই বহুদিন পর স্যারকে যখন খুঁজে পেয়েছি, তখন তার সঙ্গ আর আমি ছাড়ছি না। সময় পেলেই ছুটে আসবো স্যারের কাছে। বা স্যারকে নিয়ে যাব আমার কাছে।” এরপর শুভময়কে কিছু বলতে বলা হলে সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুই বলতে পারলো না। আর চোখ ছল-ছল করছে। গলার কাছটা কেমন ভার হয়ে আছে। জয়কে জরিয়ে ধরে বহু কষ্টে শুধু বলল “আমার এই পাগল ছেলেটা নিয়ে আমি বুড়ো বয়সে কি যে করি.....”
আর কিছু বলতে হল না। মায়ের বোধনের প্রাককালে গুরু-শিষ্যের এমন মিলন অনেক না বলা কথাই বলে দিল। এরপর জয় তার স্যারকে সাথে নিয়ে প্রতিমা উদ্বোধনের কাজ সেরে বিদায় নিল। যাওয়ার পথে শুভময়কে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল জয়।
এরপর শুভময় রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে গেল। অনেক হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ, ফেস-বুকে অনেক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। আর তার মধ্যে একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে শুভময় একটি চমকে গেল। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা মহিলা কমিটির সভাপতি মালবিকা সেনের, মানে তার স্ত্রীর।