টপিকঃ পিতৃত্ব

এই গল্পটা সত্যি ঘটনা নিয়ে লেখা আসল মানুষটি মুম্বাই এর এক প্রখ্যাত ম্যানেজমেন্ট গুরু তাই নাম ও পেশা পরিবর্তিত

বার্গারটাতে একটা জম্পেশ কামড় বসাতে যায় রুন্না,ওহ্ সো ইয়ামি,সো চিজি। সত্যি এতো ভালো  বানায় এরা জাস্ট থামা যায়না। এইজন্যই বোধহয় বন্ধুরা ওকে হেংলু আর মোটু বলে। খাওয়ার দেখলেই ভুলে যায় সব। এমন কি মায়ের বারণটাও," বাইরের খাবার খাসনা রুনি। হেলদি খা,এরপর প্রফেশনে যাবি এতোটা মোটু হয়ে গেলে চলবে কি করে? "
.....সবে চিজের সাথে জিভের মাখামাখিতে মনটা খুশিতে ভাসছে। খেলেই উধাও হয়ে যায় সব মন কেমনগুলো। হঠাৎই চোখ পড়ে যায় ক্যান্টিনের কোণের টেবিলে। নতুন এসেছেন স্যার এরমধ্যে দুদিন ক্লাশ নিয়েছেন ওদের। প্রথমদিন থেকেই যেন ওর ব্যাপারে একটু বেশিই ইন্টারেস্টেড। আগে মুম্বাইয়ে পড়াতেন এখন ট্রান্সফার হয়ে ওদের কলেজে। অসাধারণ ফ্লুয়েন্টলি বেশ কয়েকটা ভাষা বলেন। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে। তবে দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। ওদের হোটেল ম্যানেজমেন্টের প্রফেশনটাই এমন,সবটাই পরিপাটি আর টিপটপ। রুন্নাই একটু সাদামাটা। তবে ঠিক হয়ে যাবে সব হয়ত একসময় পরিস্থিতির চাপে। " হাই ইয়ঙ্গ লেডি,মে আই টেক আ সীট হেয়ার?"একটু যেন অস্বস্তি হয়,ধ্যাৎ গেলো বার্গারটা মাঠে মারা,কোথায় ভেবেছিলো একটু চেটেপুটে খাবে তা না চোখের সামনে এসে বসলেন উনি। ভদ্রতার খাতিরে ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি জানাতেই হয় কিছু করার নেই।
             সেইজন্যই সেদিন বন্ধুরা হাসাহাসি করছিলো "স্যারটার বোধহয় একটু ইয়ে টিয়ে আছে মানে ঐ একটু মেয়েদের আশেপাশে ঘুরতে ভালোবাসেন। তবে সাবধান রুন্না তোকেই কিন্তু টার্গেট করেছে মনে হচ্ছে। দেখেছে একটা গোলু বিয়ার।"..." এই একদম বডি শেমিং করবিনা। স্যার আমাকে পছন্দ করলে আমি কি করবো শুনি?"
       একটু একটু করে মুখে হাসি রেখে খাবারটা খেলো,কিছু করার নেই আর্ধেকটা অলরেডি খেয়ে ফেলেছিলো। স্যারও মিষ্টি হাসছেন ওর দিকে তাকিয়ে। একটু অপ্রস্তুত লাগলো,আজ সবাই ডাইনিং হলে খাচ্ছে,ওর কি যে ভীমরতি হলো ক্যান্টিনে খাবার। অতক্ষণ কুকিং ক্লাশে দাঁড়িয়ে আর ভালো লাগছিলোনা।"তোমার খুব খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে,এটা নাও। আমি অর্ডার দিয়ে ফেলেছি তোমার জন্য। লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকে রুন্না,কে জানে ছেলেরা কেউ দেখছে কিনা। কথাটা বন্ধুদের কানে গেলে আজ আর রক্ষা নেই। একটু অস্বস্তিতে বলে ওঠে,"নো স্যার,আ্যকচুয়ালি...."..." ডোন্ট বি নার্ভাস,আরে আমি কোন বাঘ নই,তোমার চকোলেট শেক ভালো লাগেনা? আমার তো খুব ফেভারিট। ওকে কি আর হবে আমিই খাই একা,আমারটা অবশ্য সুগার ফ্রি।"....চকোলেট শেকটা তাকিয়ে রয়েছে রুন্নার দিকে,ওখান থেকে উঠে যাওয়াটা একদম ব্যাড ম্যানার্স।
মুখটায় আবার মিষ্টি হাসিটা আনে,এবার ওর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গজদাঁতটা দেখা যায়। ওর বোকা বোকা ক্যাবলামুখটা দেখে স্যারও হেসে ফেলেন। " খুব মিষ্টি হাসি তো তোমার,সবসময় মুখটা এতো সিরিয়াস করে রাখো কেনো?তোমার হাসি তো ম্যাজিকটাচ দিতে পারে,মানে ফিদা করে দিতে পারে এনিওয়ান এনিটাইম রুন্নি।"....স্যারের কথাগুলোতে এমন কিছু ছিলো যে বুকের ভেতরটা তির তির করে উঠলো কুড়ির রুন্নার। খুব ভালো লাগলো রুন্নি নামটা শুনতে,আরো একবার শুনতে ইচ্ছে করলো। ভালোলাগা মেশানো লজ্জায় মাথাটা নিচু করলো রুন্না।
           হাতটা বাড়িয়ে দেন স্যার,"তাহলে আর ভয় পাবেনা তো রুন্নি,ওকে মিট ইউ এগেন ডিয়ার,আসলে আমিও খুব ফুডি তোমার মত। তোমার ঐ চেটেপুটে চিজ খাওয়াটা দূর থেকে এনজয় করছিলাম তাই আর পারলামনা নিজেকে আটকাতে।"....ইশ্ যাচ্ছেতাই কান্ড!মনে মনে খুব লজ্জা পায়।
    চেঞ্জিং রুমে গিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিলো বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপছে তখনো। মিররের দিকে তাকিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করে,ইশ্ ঐ জঘন্য উঁচু হওয়া দাঁতটা দেখা যাচ্ছে,মায়ের কাছে কত অভিযোগ করে ঐ টা নিয়ে। আর স্যার বললেন ওটাই নাকি সবচেয়ে সুন্দর। রুন্নার বন্ধু অনেক,তবে এখনো প্রেম  করা হয়নি,আরে ওর মত মোটুকে কে আর প্রপোজ করবে। তারচেয়ে এই বেশ ভালো আছে নো টেনশন,নো লুকিয়ে চ্যাট,নো মিথ্যে কথা বলা মাকে। জীবনে শুধু একটাই প্রেম,খাওয়া আর খাওয়া।
           বাড়ি এসে মাকে বলেই ফেলে স্যারের কথাটা। মা একটু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন বয়স কেমন হবে। তবুও বলে দেন,"বলা যায়না রুনি,কার স্বভাব কেমন নতুন এসেছেন সবে কলেজে। একটু বন্ধুদের সাথেই থাকিস।"
      পরে কদিন একটু এদিক ওদিক করেই কাটালো রুন্না। স্যারের ক্লাসেও পেছনদিকেই বসলো। তবুও স্যার জিজ্ঞেস করলেন,"রুন্নি,আর ইউ ফিলিং ব্যাড?"...বুকের ভেতরটা আবার কেঁপে উঠলো,এক ক্লাশ ছেলেমেয়ে। তাই মুখে মিষ্টি হাসিটা এনে বললো,"ইটস ওকে স্যার।"...."দেন কিপ স্মাইলিং অলওয়েজ।"...ইশ্ খেয়েদেয়ে কাজ নেই সারাক্ষণ দাঁত বার করে হেসে বেড়াবে।
               বার্গারগুলো আয় আয় করে ডাকলেও কদিন আর ক্যান্টিনমুখো হয়নি। সেদিন লাঞ্চটাইমে বিশাল লাইন দেখে একটু বেড়িয়েছে বাইরে হঠাৎই স্যারের সামনে। "আজ আমারও বার্গার খেতে ইচ্ছে করছে রুন্নি তোমাকেই খুঁজছিলাম ভালোই হলো,এখনো লাঞ্চ হয়নি তো আচ্ছা চলো। আসলে আমিও খুব বোর হচ্ছি এখানে। এই তো সবে এসেছি।"...মনে মনে একটু দাঁত কিড়মিড় করে রুন্না ইশ্ যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। স্যার বলে কথা তাই কিছুই করার নেই গুটিগুটি পায়ে স্যারের সাথে গিয়ে বসলো,আজকে ওকে কিছুই কিনতে হলোনা পুরোটাই স্যার খাওয়ালেন তবে বার্গারটাতে যেন মনে হলো একটু বেশিই চিজ দেওয়া আজ।"তুমি খাও আমার বয়েস হচ্ছে,একটু কন্ট্রোল করতে হয়। তবুও মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে।"...আজ স্যার একটু করে জানতে চাইলেন ওর বাড়ির কথা,বাড়িতে কে কে আছে। কেন হঠাৎ করে এরকম একটা লাইনে এলো অন্য কিছু পড়তে পারতো। আজ রুন্নারও একটু ভালো লাগলো অনেকটা ফ্রী লাগলো,সত্যি স্যার বেশ ফ্রেন্ডলি,কি সুন্দর কথা বলেন। তবে আজ অনীশ দেখে ফেলেছিলো ওকে, আর যায় কোথায় সবাই একচোট ক্ষেপিয়ে মারলো। ইশ্ রুন্না তুই কি লাকি!আচ্ছা স্যার তোকে কি ফ্লার্ট করছে নাকি? আমাদেরকেও তো একদিন খাওয়াতে পারতো। দেখিস বাবা একটু সাবধানে থাকিস শুনেছি তো স্যার ব্যাচেলর।
          বাড়িতে এসে মাকে সবটা না বললে তো ওর খাওয়াই হজম হয়না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরোটা বললো কি কি হয়েছে কলেজে। অদ্ভুত লাগে সোহার, সত্যি তো এতো ছেলেমেয়ে থাকতে হঠাৎ ওর মেয়েকে খাওয়াতে গেলেন কেন ভদ্রলোক? বড় আগলে আগলে রেখেছে এতোদিন মেয়েকে। মেয়েটা সত্যিই এখনো ফুলের মত সুন্দর আর সরল। শুধু একটু ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসে এছাড়া আর কোন ঝামেলা নেই।"শোন উনি বোধহয় সরল ভেবে তোকে একটু বেশিই প্রেফারেন্স দিচ্ছেন। স্যারের সঙ্গে কি দরকার এতো মেশার,কার মনে কি আছে কে জানে?"
          ...."ওহ্ মা এমন করে বোলনা,স্যার ভীষণ মাই ডিয়ার তুমি তো আমাকে কোনদিনই ছেলেদের সাথে মিশতে দিলেনা। চিরকালই আগলে রাখলে।"....মেয়েকে কিছু না বললেও মনে মনে ভাবে সোহা আগলে রাখি কি আর সাধে? চারিদিকের যা অবস্থা,তবে এখন তো কলেজ নিজেকেই ভালোমন্দ বুঝে নিতে হবে। স্বামী অকালে চলে যাওয়ার পর মেয়ে আর মা দুজনের ছোট পৃথিবীতে কাউকে আর ঢুকতে দেয়নি সোহা। বাড়িঘর টাকা পয়সা সবটাই মোটামুটি গুছিয়ে গিয়েছিলো সিদ্ধার্থ শুধু নিজেই থাকলোনা হঠাৎই কার্ডিয়াক আ্যটাক তাই কিছুই করার ছিলোনা। মেয়েটা তখন খুবই ছোট,শ্বশুরবাড়ির পরিবারকে তেমনভাবে কাছে পায়নি কোনদিনই। নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিলো বলে দাদারা একটু করে সরিয়ে দিয়েছিলো,আর এখন তো বাবা মা কেউ নেই।
        তবে কোনভাবে চলে গেছে দিনগুলো,আজ হয়ত পায়ের তলার মাটিটা অনেক শক্ত,নিজেও একটা হোম ডেলিভারি চালায়। মেয়েকে কিছু না বললেও সোহার একটু চিন্তা হয়। কে জানে কি আছে ভদ্রলোকের মনে। থাক পরে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলবে,অবশ্য স্যার তো.. তাকে কি করেই বা আ্যভয়েড করবে!
            ...মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে 'চিনি কম' সিনেমাটার কথা মনে পড়ে সোহার কি কান্ড একটা কম বয়সী মেয়ে বাবার থেকেও বড় লোকের প্রেমে পড়লো। সিনেমাটা আবার খুব প্রিয় রুনির। আসলে মেয়েরা বোধহয় বাবার মত ছেলেকেই ভালোবাসতে চায়। বুকটা কেঁপে ওঠে সোহার। না না মেয়েকে শুধুই সাবধান করবে আর বেশি কিছু বলা ঠিক হবেনা।
          রুন্না ছোট নয় ও সবটাই বুঝতে পারে মা কি বলতে চায়। তবুও রুন্নি বলে কেউ ডাকলে সত্যি বুকের ভেতরটা তির তির করতে থাকে। আজকাল ওর মুখের হাসিটা একটু মিস্ করেন মিঃ শুভম সান্যাল ওদের স্যার। মেয়েটা কেন যেন একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে অথচ ওর মুখের হাসিটাই তো ম্যাজিক, জানতে চান কোন প্রবলেম হয়েছে কিনা। অনেকদিন ওকে ক্যান্টিনেও দেখেননা।
                সেদিন কলেজের গেট থেকে বেরোনোর সময় রুন্নাকে দেখেন শুভম,হয়ত মেয়েটা লিফ্ট নেবেনা তাই আর কিছু বলেননা।কলেজের সামনেটা বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে অথচ বাস আসছেনা। ছুটি হতে হতেই প্রায় সন্ধ্যে নেমে যায়। "নাহ্ আর অপেক্ষা করবেনা এবার যা বাস পাবে তাতেই উঠে যতটুকু যাওয়া যায় যাবে তারপর দরকার হলে আবার অটোতে উঠবে। পার্সটা বার করে দেখতে যায় টাকা আছে তো?হঠাৎই ওর গায়ে একটা ধাক্বা অনুভব করে বিরক্ত হয়ে তাকাতেই আরেকটা ধাক্বা,বেশ কয়েকটা ছেলে এদের কোনদিন আগে দেখেনি। অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। ও বলে "এসব কি হচ্ছে?"..." চলো মামণি,তোমাকে পৌঁছে দিই আমরা তো আছিই।"..এবার সত্যিই একটু ভয় লাগে। জোরে পা বাড়ায় সামনের দিকে ওরাও এগোতে থাকে পেছন পেছন। অসহায় ভাবে বাসের দিকে তাকায়,দৌড়তে থাকে প্রায়। হঠাৎই সামনে থেকে আসা গাড়ির হেডলাইটে চোখটা ধাঁধিয়ে যায়। " রুন্নি উঠে এসো। কোন কথা নয় একদম তাড়াতাড়ি।"....গাড়ির পেছনের সীটে বসে হাঁপাতে থাকে রুন্না,কথা বলতে পারেনা। কলেজ থেকে কয়েকটা স্টপেজ যেতেই হঠাৎ গাড়ীটা ডিস্টার্ব করলো,কেমন যেন অস্থির লাগছিলো শুভমের নিজেই একটু দেখে নিয়ে আবার ব্যাক করেন,ভাগ্যিস সময়ে এসেছিলেন!"তোমার বাড়ির আ্যড্রেসটা একটু বলতো?"..স্যারের গম্ভীর গলাটা শুনে আর বলার সাহস পায়না ইটস ওকে,আমি চলে যাব স্যার। ওর বলা আ্যড্রেস শুনে স্যার গুগলে লোকেশনটা দিয়ে দেন। ওর দিকে জলের বোতলটা বাড়িয়ে দেন।
            সোহা অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে,এতো দেরি কেনো যে করছে মেয়েটা,এদিকে ফোনটাও নট রিচেবল্ বলছে। আসলে মাকে ফোন করার পর ওর ফোনটা সুইচড্ অফ হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎই একটা গাড়ি থামতে দেখে নিচে। দেখে মেয়েকে,গাড়ী থেকে নেমে হাত নাড়ছে,কি যেন বলছে।
       তাড়াতাড়ি নিচে নামতেই দেখে রুন্নাকে বারান্দায়,দরজাটা খুলে দেয়। মেয়ের কাছে সবটা শুনে শিউরে ওঠে ভয়ে। কি বিপদ হত কে জানে! শুধু মেয়েকে বললো,"ওনাকে ভেতরে আসতে বললিনা কেন?"..."বলেছিলাম মা,বললেন পরে একদিন আসবেন।"
            রুন্না সাবধানী হয়েছে,আর তেমনভাবে একা হয়নি কখনো। যদিও স্যার বলেছেন আর যেন কোনদিন ঝুঁকি না নেয়। স্যারকে থ্যাংকস জানাতে গেলে স্যার বললেন একদিন আসতে হবে স্যারের ফ্ল্যাটে। প্রস্তাবটা খুব একটা ভালো লাগলোনা রুন্নার ও জানে মাকে বললে মা খুব অশান্তি করবে।..."আসবে তো?"..একদম না করতে পারেনা শুধু গজদাঁতটা বার করে মিষ্টি হেসে ঘাড়টা নাড়ায়।..."গুড গার্ল।"
            ওদের এক্সামের পর বেশ কিছুদিন ছুটি গেছে,তারপরেও কেটে গেছে কয়েকটা মাস। মাঝে মাঝেই মনে হয়,স্যার বলেছিলেন বাড়িতে আসতে,ও কথা রাখতে পারেনি বরং একটু এড়িয়েই চলেছে নাহ্ লিফ্টও নেয়নি। তারপর ক্লাশে ছাড়া খুব একটা কথা হয়নি শুধু হাসি বিনিময় ছাড়া।
         কয়েকদিন ধরে ক্লাসে গিয়ে একটু ফাঁকা লাগে শুভমের রুন্নিকে দেখেননা। অথচ কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছেননা। এভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক নয়। দেখতে দেখতে দুইসপ্তাহ পার হয়ে গেলো। এরপর আর না জিজ্ঞেস করে পারলেননা,জানতে পারলেন ওর টাইফয়েড হয়েছে। সত্যিই মনটা খারাপ হয়ে গেলো,ইশ্ আগে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো। যদিও শুনলেন এখন একটু ভালো আছে।
                  "রুনি,আর বায়না করিসনা। চিকেন স্যুপটা খেয়ে নে সোনা।"...." আমার ভালো লাগেনা মা শুধু গা গোলায়।"..."ইশ্ এইসময় আবার কে এলো? মেয়েটাকে একটু খাওয়াচ্ছি।"
     দরজাটা খুলে একটু আশ্চর্য লাগে সোহার।.."আপনি আমায় চিনতে পারবেননা আমি শুভম রুন্নির স্যার।"...রুন্নি নামটা ধাক্কা দেয় সোহাকে,কতদিন বাদে শুনলো নামটা। একসময় এই নামটা বাড়িতে হৈ চৈ ফেলে দিতো। সিদ্ধার্থ সারাক্ষণ এই নামেই ডাকতো মেয়েকে।
               স্যারকে দেখে অবাক হয়ে যায় রুন্না ওর ক্লান্ত মুখটা দেখে মায়া হয় শুভমের। তবুও বলে ওঠেন,"এই এতটা ড্রাইভ করে এলাম তোমার হাসিটা দেখবো বলে রুন্নি। রিয়েলি মিসিং ইওর স্মাইল ডিয়ার।"...আশ্চর্য লাগে সোহার,এমন স্যার হয় নাকি,ছাত্রীর জন্য একদম বাড়িতে! তাও আবার কলেজের স্যার। মুখে হাসির ঝিলিক খেলে যায় রুন্নার, স্যার বলেন এ বিগ স্মাইল প্লিজ। ওর হাতে একবাক্স চকোলেট আর কিছু ড্রাইফ্রুটস দিয়ে বলেন,"হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে ডিয়ার।" কি বলবে ভেবে পায়না রুন্না তবুও থ্যাঙ্কস বলে।" এবার বকুনি খাবে ফ্রেন্ডকে কি কেউ থ্যাঙ্কস বলে?"
      অবাক লাগে সোহার আশ্চর্য এই ভদ্রলোক,মেয়েটাকে কেমন যেন জাদু করে নিয়েছেন। কফি নিয়ে এসে অনেকদিন বাদে মেয়ের মুখে একচিলতে মিষ্টি রোদ্দুর দেখলো,হাসছে মেয়েটা একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।.."মেয়ের কাছে শুনেছি,খুব ভালো রান্না করেন আপনি,একদিন টেস্ট করতে হবে।"
         তার মানে রান্না খেতে আরেকদিন আসবেন তবুও মুখে হাসি এনে সোহাকে বলতেই হলো,"নিশ্চয় আসবেন,শুধু রুনিকে দিয়ে আগের দিন বলে দেবেন তাহলেই হবে। বাঙালী রান্না খান তো? আমি ওটাই পারি।"....জোরে হেসে ওঠেন শুভম," আরে আমি তো বাঙালী রান্নাই খাবো।"
                  আরো একসপ্তাহ বাদে কলেজে যায় রুন্না যদিও এখনো উইক। তবে স্যারের সাথে বন্ধুত্বটা বেশ পাকা হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন বাদে হঠাৎই একদিন মাকে বলে," মা এই উইকএন্ডে স্যারের বার্থডে,ওনার ফ্ল্যাটে আমাকে ইনভাইট করেছেন।"...মাথাটা গরম হয়ে যায় সোহার হঠাৎ করে," রুনি তোকে কিছুতেই যেতে দেবোনা আমি একা একা,যা করেই হোক আ্যভয়েড কর।"..." আমি ওনাকে অনেকদিন আগে প্রমিস করেছি মা।"..." তোমার কি কোন গার্জেন নেই নাকি,আমি যেতে দেবোনা ব্যাস। একটা বয়স্ক স্যারের সাথে কিসের বন্ধুত্ব!"
           " রাগলে সত্যি তোমায় খুব সুন্দর লাগে মা,আচ্ছা তাহলে অনীশের বাড়ি যাই একা? সত্যি তুমি আমার বোকা মা,উনি তোমাকে নিয়েই যেতে বলেছেন। কিছু ভালো রান্না করে নিয়ে যেয়ো মা আর তোমার ঐ স্পেশাল পায়েশটা।"
               অনেক ভেবে কয়েকটা স্পেশাল বাঙালী রান্না করে সোহা,সব ঠিকমত গুছিয়ে মা মেয়ে বেরোয়,মেয়ের উৎসাহ দেখে একটু বিরক্ত লাগে। এই দিকটায় কখনো আসেনি ওরা তাই একটু অসুবিধে হলো,বাপরে বেশ উঁচুতে স্যারের ফ্ল্যাট একদম নির্জন জায়গাটা আর এখানে মেয়েটা একা আসতে চাইছিলো!
     দরজা খুলে ওদের স্বাগত জানান স্যার,আজ স্যারকে বেশ অন্যরকম লাগছে পাঞ্জাবীতে। ঘরে ঢুকে একটু আশ্চর্য লাগে এত ফাঁকা কেন,আরো গেস্টরা কোথায়?"আর কেউ নেই,আজ আমরাই একটু সেলিব্রেট করবো,বুড়োদের আবার জন্মদিন কিসের?"...রুন্না হেসে ফেলে,"আপনি বুড়ো? আমার তো মনে হয় আপনি আমার থেকেও বাচ্চা।"...." এই তো আমার বেষ্ট গিফ্ট,রুন্নির হাসি। জাস্ট ফিদা হয়ে গেলাম।"..একটু বিরক্ত লাগে সোহার ওনার কথা শুনে। রুন্না ততক্ষণে ব্যাগ থেকে বের করে খাবার গুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখছে।...." ওহ্ এতো কিছু!সত্যিই আপনি ম্যাজিক জানেন। আমার ফেভারিট ডিশ সবকটাই।".....পায়েশের কৌটোটা খুলে দেয় সোহা। " ওহ্ পায়েশ!মা মারা যাবার পর কতবছর খাওয়া হয়নি।"
       সব কিছু গোছানো প্রায় শেষ,এ এক অদ্ভুত জন্মদিন। এমন জানলে সোহা আসতো না কখনো। ভীষণ বোরিং লাগছে,একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। কেন যে মেয়ের বায়নায় রাজী হলো!কেকের সামনে ক্যান্ডেলটা জ্বালিয়ে দেয় রুন্না। " ওয়ান মিনিট রুন্নি"..বেডরুমে চলে যান শুভম, বেড়িয়ে আসেন একটু বাদেই। কেকের পাশে একটা ল্যামিনেশন করা বড় ফটোগ্ৰাফ রাখেন। একজন বিদেশী মহিলা আর পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে খুব মিষ্টি হাসি বাচ্চাটার। কেক কাটেন স্যার রুন্না আর সোহা উইশ করে। প্রথম কেকটা রুন্নাকেই খাইয়ে দেন উনি। কেক খেতে খেতে বার বারই চোখ চলে যাচ্ছিলো ছবিটার দিকে।
            সোহাকে নিজে সাজিয়ে স্ন্যাকস সার্ভ করেন শুভম। "আসুন ব্যালকনিতে বসে একটু গল্প করি আমরা,সবসময় তো একাই থাকতে হয় আমায়। চিন্তা নেই আজ ড্রাইভার ছেড়ে দেবে আপনাদের।"
....." ঐ ছবিটা কার স্যার?"..." আজ সেই গল্পই করবো তোমাদের,আমি প্রথমে হোটেলে জব নিয়ে এদেশ ওদেশ ঘুরে জার্মানিতে চলে যাই আর সেখানেই আলাপ হয়ে যায় ডোরার সাথে,বিয়েও হয়ে যায় আমাদের। এলিজা আমাদের বেবি,কি সুইট ছিলো ওর স্মাইল একদম ম্যাজিক। কিন্তু বিয়েটা কেন যেন বেশিদিন টিকলোনা। হয়ত দোষটা আমারই ছিলো,আমি একটু বেশি কনজারভেটিভ ছিলাম ওদের লাইফস্টাইলের সাথে মেলাতে পারলামনা। তাই ছাড়তে হয়েছিলো সবটাই একসময়। আমার বেবির খুব প্রিয় ছিলো রুন্নি কথাটা,ছোট ছোট একটা দুটো বাংলা বলতো,আমিই শিখিয়েছিলাম। কিচেনটা আমাকেই সামলাতে হত বেশিরভাগ। ওর মা এলেই বলত পাপা রুন্নি ইন দ্য কিচেন। মানে বাবা রান্না করছে।"....হা হা হা করে হেসে ওঠেন শুভম।ডোরা আবার বিয়ে করেছিলো ওর বিজনেস পার্টনারকে, এলিজাকেও ওরা আমায় দেয়নি। সামনে বছর আঠেরো হবে ওর,হয়ত ওর পাপাকে আর মনেই নেই। রুন্নির হাসি আর ওর বার্গার খাওয়া দেখে কেন যেন ওর মধ্যে এলিজার শ্যাডো দেখতে পেয়েছিলাম কতই তো স্টুডেন্ট আছে কিন্তু অদ্ভুত এক ভালোলাগার টান হলো ওর জন্য। নিজেকে কন্ট্রোল করতে চাইতাম বাট পারতামনা। ওকে না দেখলে ভালো লাগতোনা,ওর হাসিটা মিস্ করতাম। তাই হয়ত কখনো একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি,হয়ত আপনারও অস্বস্তি হয়েছে। প্রত্যেকবার বার্থডেটা ওদের ছবির সামনেই সেলিব্রেট করি একা একটা ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে। আজ কেন যেন ইচ্ছে করলো এই বার্থডেটা রুন্নির সাথে এনজয় করি। হয়ত এলিজার মত রুন্নিও একদিন মেমোরি হয়ে যাবে আমিও ট্রান্সফার হয়ে যাব অন্য কোন কলেজে। "
          কিছুক্ষণের জন্য কেউই কথা বলতে পারেনি,ব্যালকনিতে বসে দূরের আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে আজ বড্ড চোখ ছলছল করছিলো সোহার। ইশ্ এমন সম্পর্কের আস্বাদ কেন যে ওদের মত অনেকেই পায়না! চারিদিকের কঠোর বাস্তবে পুরুষেরা বোধহয় বেশিরভাগ সময়ই প্রতারক আর ধর্ষক হয়েই ধরা দেয় আমাদের কাছে। কিন্তু ভাবতেই পারেনি একটা স্যুটেড বুটেড পলিশড্ মানুষের ভেতরে এমন একটা পিতৃত্ব লুকিয়ে ছিলো যা হয়ত কত রাত একলা লুকিয়ে কাঁদে সন্তানের মুখের এক চিলতে হাসি দেখার জন্য। নিজের সন্তানের প্রতিচ্ছবি খোঁজে অন্য কারো মধ্যে। বাঁধতে চায় তাকে স্নেহের পবিত্র বন্ধনে।
             হঠাৎই কথা বলে ওঠে রুন্না,"পৃথিবীটা এখন খুব ছোট হয়ে গেছে স্যার,এলিজাকে আমরা ঠিক খুঁজে পাবো একদিন।"...একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শুভম,হয়ত ওরা সবাই আছে খুব মনের কাছাকাছি তবে বাবা আর মেয়ের মধ্যের অদৃশ্য গন্ডী পেরিয়ে এলিজা কি কোনদিন আসতে পারবে তার কাছে?