টপিকঃ ট্যাক্সিওয়ালা - Never judge the book by its cover

যাদের আমার তাথাকথিতিও ভধ্রলকের ছোট মানুষ ভাবি | যদি ও আমার নিজের এই বিষয় যথেষ্ট সন্ধেও আছে আমারে কতটা ভদ্র | যাদের আমরা বাইরে থেকে দেখে ছোটো মনে করি আসলে তারা অত ছোটো নয় এমন কি তথাকথিত অনেক বড় মানুষের চেয়েও মনের দিক থেকে অনেক বড়।ওদের কৃতজ্ঞতা বোধ আত্মমর্যাদাবোধ কারো থেকে কম নয়। বাকিটা গল্পটা পড়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন......।

আজ সন্তোষের মাথায় বিরাট চিন্তা । বেলা একটা হবে । মাসের দ্বিতীয় রবিবার । মালিকের বাড়ী থেকে ট্যাক্সিটা নিয়ে বেড়োচ্ছে আজ দেরিতে। ভবানী সিনেমা হলের পাশের একটি গলিতে থাকে মালিক অনিল বাবু । মালিক জানে আজ দেরিতে গাড়ি নেবে । কারন মালিককে জানিয়ে ছিল আগের দিন । আজ তার মেয়েকে পাকা দেখা দেখতে আসবে। একটু আগের ঘটনা গুলি মনে পড়তে লাগলো ।

একটু আগেই মেয়ে সম্পা কে তার প্রেমিক মানিকের দাদা কমলেশ ও লক্ষ্মী বৌদি দেখে, পছন্দ করে গেছেন । ছেলে মানিক মেয়ের কলেজেই পড়তো। সেখান থেকেই আলাপ । দাদা বৌদি ও ভাই একসঙ্গে ঠাকুরপুকুরের বাছার পাড়ায় থাকে । দুই কাটার মধ্যে ছোট্ট একটি বাড়ী আছে । ছোট থাকতেই মা ও বাবাকে হারিয়েছে । দাদা কমলেশ বেহালায় ফুটপাতে অটো ও টুহুইলার মেরামতির কাজ করে নিজে, পাশেই একটি ছোট দোকান কিছুদিন হয় কিনেছে । স্টেশনারীর দোকান দিয়ে ভাইকে বসাবে। ছোট বেলায় মা বাবা কে হারিয়ে ভাইকে নিয়ে কোনরকম সংসার চালায় । নিজে পড়াশুনো করতে পারেনি , তাই ভাইকে পড়ানোর জন্যে চেষ্টা করে চলেছে। আগে নিজে গ্যারেজে কাজ করতো । তারপর এই কিছুদিন হয় বেহালা চৌরাস্তার কাছে ফুটপাথে নিজেই ছোট গ্যারেজ খুলে বসেছে রাস্তার ধারে একটি দোকানের সামনে। সেই দোকানটি কিনেছে অল্প কিছুদিন হয় । সেটি তার ভাইকে দেবে, কিন্তু এক/দের লক্ষ টাকা হলে দোকানটা ভালো করে সাজিয়ে নেওয়া যাবে। তাই ভাইকে খুশি করার জন্যে তার পছন্দ করা গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বিবাহ দিচ্ছে । নিজেও বছর দুই আগে বিয়ে করেছে । বৌদিও দাদার মত ভাইকে দেওর নয় নিজের ছেলের মত দেখে । দাদা কমলেশ নিজে বিয়ে করার সময় পন নিয়েছিল। পনের টাকা ও কিছু জমানো টাকা দিয়ে ভাইয়ের জন্যে দোকান কিনেছে। ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ী থেকে টাকা চাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা । তবুও একটু তাড়াতাড়ি দোকানটাকে আর্থিক স্বচ্ছল করবে বলেই টাকা নেওয়া । পণ নেবার ব্যাপারে ভাই ও লক্ষ্মী বৌদি রাজী ছিল না। কিন্তু যখন দাদা বললো যে পরে আমরা ওদের সুবিধা অসুবিধায় এই টাকা ফেরৎ দিয়ে দেবো। মানিক তখন এই বিয়েতে রাজী হলো ।

টালিগঞ্জের বস্তিতেই মেয়েকে দেখতে এসেছিল । দুই পক্ষ কথা বলার পর এই সব জানতে পারে সন্তোষ ।

সন্তোষ ট্যাক্সি নিয়ে ভবানী সিনেমা হলের কাছে আসতেই একজন প্যাসেনঞ্জার হাত দেখিয়ে গাড়ী দাড় করালো।

প্যাসেঞ্জার – এয়ার পোর্ট যাবে?

সন্তোষ – চলুন।

গাড়ী আবার চলতে শুরু করলো। অন্যদিন প্যাসেঞ্জারের সাথে কথা বলে । আজ মেয়ের জন্যে চিন্তা,মনটা ভারাক্রান্ত । কি করে টাকা যোগার হবে? একমাসের মধ্যে দুই লাখ টাকা চাই।

কি করে মেয়ে বুলার বিয়ের জন্যে এক লক্ষ টাকা যোগার করা যায়। তারপর কমপক্ষে মেয়ের জন্যে হাতের বালা, কানের দুল ,চেন এবং ভাবী জামাই এর জন্যে চেন ও আংটি অর্থাৎ প্রায় দুই লক্ষ টাকা দরকার । সময় মাত্র এক মাস । পরের মাসে এই তারিখেই বিয়ে । সন্তোষের ভাবী জামাইকে খুব পছন্দ। তা ছাড়া ছেলের বড়দা ও তার স্ত্রী বলেছে, আপনার মেয়ে আমার ভাইএর স্ত্রী হলেও , আমার বাড়ীতে বোন এর মত থাকবে। তাছাড়া ভাইকে আমি আমার ছেলের মত দেখি , আপনার মেয়েকে মেয়ের মত দেখবো। চিন্তা করবেন না । কমলেশ, মেয়ের বাবা সন্তোষের হাত দুটো ধরে বলেছে যে শুধু পন হিসাবে আমার এক লক্ষ টাকা চাই। এই কথায় খুব আশ্বাস পেয়েছে সন্তোষ । সে ভাবতে লাগলো -

এত আবদার করে নিজের মত কথাটা উত্থাপন করেছে যে সন্তোষ ঠিক করে নিয়েছে , রাত জেগে ট্যাক্সি চালাবে । রাতে ডাবল ভাড়া । তাতে তারও একটু বেশি আয় হবে । খুব খাটবে । নিজের ট্যাক্সি নেই । অন্য জনের ট্যাক্সি ভাড়ায় নেওয়া । দিনে ৮০০ টাকা দিতে হয় । রাত্রে নিলেও আরো দিতে হবে । যা পারবো খেটে টাকা তোলার চেষ্টা করি , তারপর মহাজনের কাছে গিয়ে কিছু টাকা ধার নেবো। মহাজন খুব ভাল। অনেক সময় বিপদে আপদে টাকা পয়সা ধার দিয়েছেন । সময় মত মিটিয়েও দিয়েছেন ।

সন্তোষ থাকে টালিগঞ্জের রেল বস্তিতে। বাংলাদেশ থেকে সেই কবে এসেছিল । একটা জমি ছিল তিন বিঘার । মা বাবা মারা গেছেন অনেক ছোট থাকতেই। তাই তিন বিঘা জমি এক মুসলিম বন্ধুর কাছে বিক্রী করে , টাকা নিয়ে দালাল ধরে ভারতে আসছিল । ভালো কিছু করবার উদ্দ্যেশে। কিন্তু বনগা দিয়ে চোরা পথে ঢোকার সময় সব টাকাটাই গায়েব হয়ে যায়। তারপর এসে ইট খোলাতে কাজ করতে করতে এক ড্রাইভারের সাথে আলাপ হয় । সে এখন যে মালিকের গাড়ী চালায় তার বাড়ীতে নিয়ে আসে । সেই মালিকের নাম অনিল বাবু । তার অনেক গাড়ী । এক ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ী চালানো শিখিয়ে, আলিপুর থেকে গাড়ী চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার সব ব্যাবস্থা করেন অনিল বাবু। শুধু বলেন তুই আমার ছাড়া অন্যের গাড়ী চালাবি না। সেই থেকেই বিপদের সময়ের পেটের ভাত দেওয়া লোকটিকে আজও ছাড়েন নি। টালিগঞ্জের রেল বস্তিতে এসে ওঠে , এক দালাল ধরে। সেই থেকেই এই বস্তিতে থেকে যায় । ভাল চেহাড়া, সৎ, বুদ্ধিমান ,সামান্য লেখাপড়া জানে। তাই ধীরে ধীরে ঐ বস্তির একজন আভিভাবক হয়ে যায়। এই বস্তির লোকেদের বিপদে - আপদে, শোকে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকে । নেশা করে না বললে ভুল হবে, মাঝে মাঝে বস্তির লোকের পাল্লায় পরলে অথবা বয়স্ক লোকের কথা রাখার জন্যে অল্প নেশা করে । বস্তিতে বয়স্ক মা ও মেয়ে থাকতো । সেই বয়স্ক মহিলা মারা গেলে ওই মেয়েটিকে বস্তির সকলের পরামর্শে বিয়ে করে নেয় সন্তোষ। এখন তার মেয়ে বুলা বিএ পাশ করেছে । সেই মেয়ের বিয়ে । বস্তিতে অত লোক, সবাইকে নিমন্ত্রন করবে। তাই চাই টাকা।

ট্যাক্সি এয়ার পোর্ট পৌঁছায় । প্যাসেঞ্জার মিটার দেখে ভাড়া দিয়ে দেয় । ভাড়া নিতে নিতে সন্তোষ বলে – বাবু কুড়ি টাকা বকশিশ্‌ দিন না।

প্যাসেঞ্জার – কেনো ? যা হয়েছে তাই দিয়েছি। তোমাদের এই দোষ ... বলতে বলতে টাকা তো দিলেন না , চলে গেলেন । ।

এয়ার পোর্টে পার্কিং এ গেলে অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। তাই এয়ার পোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে মেইন রোডে উঠলো । প্রায় তিনটে বাজে ।

একজন হাত দেখিয়ে গাড়িটাকে থামায়। প্যাসেঞ্জার - নরেন্দ্রপুর যাবে ?

সন্তোষ – বসুন। গাড়ী চলতে লাগলো ।

বার বার তার মনে হতে লাগলো কমলেশের ও তার স্ত্রীর কথা – আপনার মেয়ে আমাদের কাছে আমাদের মেয়ের মত থাকবে। আমি জীবনে কত কষ্ট করেছি । ধীরে ধীরে দুইটি ছোট্ট ঘর ও একটি রান্না ঘর তৈরী হয়েছে । মেয়ের পড়াশুনো করার জন্যে একটি ঘর দিয়েছি। বুলা সেই ঘরটিতে থাকে । স্বামী স্ত্রী একটি ঘরে থাকে । ঐ ঘরে একটি কালীর মুর্তি আছে । সেখানে সন্তোষের স্ত্রী দুইবেলা মা’র কাছে পরিবারের শান্তি কামনা করেন। নিজেও কোনদিন কারো ক্ষতি করেন নি। পারলে উপকার করেছেন। তাহলে ভগবান কি মেয়ের দায় থেকে মুক্তি দেবার জন্যে কিছু করবেন না। এইসব সাতপাঁচ ভেবে মন আস্থির হয়ে উঠলো । যাই হয় হবে , আমি আপ্রান চেষ্টা করে যাই । গাড়ী নরেন্দ্রপুরের মেইন গেটে এসে থামলো।

প্যাসেঞ্জার ভাড়া মিটাচ্ছেন। সন্তোষের ইচ্ছা হচ্ছে না বেশি টাকা চাইতে । তবুও বললো- দাদা ১৫টাকা বেশি দিন না, চেয়ে নিচ্ছি প্রয়োজনে। এই ভদ্রলোক ১০ টাকা দিলেন । আজ দ্বিতীয় রবিবার । নরেন্দ্রপুর মিশনে অভিভাবকরা আসছেন তাদের ছেলেকে বা ছাত্রদের দেখতে । পাঁচটা বাজে। গাড়ীটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে রাখতেই একজন প্যাসেঞ্জার এলেন ।

প্যাসেঞ্জার – এ ট্যাক্সি কসবা যাবে?

সন্তোষ – বসুন । সঙ্গে সঙ্গে ঐ ব্যাক্তি চিৎকার করে ডাকলেন (পাশের অপেক্ষারত তার পরিবারের লোকজনদের ) - দাদা, দাদা এদিকে এসো , এই গাড়ীতে ওঠো ।

একটি পরিবার। আরোহী চার জন এক ভদ্রলোক আছেন যার বয়স আনুমানিক ৫০ বছর হবে সঙ্গে তার স্ত্রী আছেন ,সঙ্গে আরো একজন সধবা মহিলা আছেন ইনি ঐ ভদ্র লোকের শালী। আরো একজন আছেন যিনি গাড়ী ভাড়া করলেন । তিনি ঐ ভদ্র লোকের ছোট ভাই । সকলের হাতে প্লাস্টিকের অনেকগুলি ব্যাগ।

গাড়ী ছাড়তে বললে, সন্তোষ গাড়ী কসবা অভিমুখে রওনা দিলেন।

বয়স্ক ভদ্রলোক বলছেন তাঁর স্ত্রীকে – ওগো আজ রবিবার দোকান বন্ধ থাকা সত্ত্বেও দোকানদার এসে গহনাগুলি দিয়েছেন । তা না হলে খুব অসুবিধা হতো । কাল সকাল থেকে প্রচুর কাজ । দুইদিনে সব করে উঠতে পারবো কি না? ছেলেকে কাল এসে নিয়ে যাবে স্কুল থেকে । দিদির বিয়েতে আনন্দ করবে বলে আজি ছুটি চেয়েছিলাম । হেডমাষ্টার দেন নি। বলেছেন কাল স্কুল ছুটির পর নিয়ে যেতে । ভাই, তুই এসে নিয়ে যাস আমার ছেলেটাকে। সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছি। ভাই মাথা নেড়ে সন্মতি জানালেন ।

সন্তোষ – আপনার ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে?

ভদ্র মহিলা – ক্লাস টেনে।

ভদ্রলোক স্ত্রীকে বললেন গহনাগুলি তোমার পছন্দ হয়েছে তো?

স্ত্রী লোকটি ভদ্রলোককে গায়ে চিমটি কেটে এবং নানারকম ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন বার বার গহনার কথা গাড়ীতে বোল না। ড্রাইভার আছে শুনবে। ভদ্রলোক চুপ হয়ে গেলেন।

ভদ্রলোক তার ভাইকে বললেন আজ বাড়ি গিয়ে চা খেয়ে গড়িয়া হাট বাজারে যেতে হবে মাছের অর্ডারটা দেবো। ভাই মানুষটি মাথা নেরে সন্মতি দিলেন ।

গাড়ি কসবা এসে গেলো । ভাড়া মেটানোর পর সন্তোষ বললো – গাড়ীটা ভাল করে দেখে নামবেন কিছু ফেলে গেলেন কি না।

সঙ্গে সঙ্গে দুই ভদ্রলোক গাড়িতে ঊঠে বললেন হাওড়া চলো।

গাড়ী হাওড়া অভিমুখে রওনা দিলো । প্যাসেঞ্জার নেমে যাওয়ার পর ,হাওড়াতেও গাড়ি না দাড়িয়ে হাওড়া ব্রীজের কাছে নিয়ে আসতে আসতে দুই তিন জন কিছু জিনিষপত্তর গাড়ীতে ওঠানোর সময় নজর করে সিটের পেছনে একটি ছোট চামড়ার কালো ব্যাগ । ওইটি হাতে নিয়ে একজন বললেন – ড্রাইভার এটা কি আপনার?

সন্তোষ – হ্যাঁ বলে ব্যাগটা চেয়ে নিয়ে গাড়ির সামনে রেখে দিলো।

প্যাসেঞ্জার - চলো বারুইপুর যাবো । গাড়ী সেই অভিমুখে যাত্রা করলো ।

সন্তোষ গাড়ী চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলো এ ব্যাগটা আমার নয়। কেউ ফেলে গেছে । এর মধ্যে টাকা পয়সা থাকলে এরা নিয়ে নিতে পারে । তাই আমি রাখি । পরে দেখবো। সেরকম হলে থানায় জমা দিয়ে দেবো । এর আগেও এরকম ঘটনা অনেক হয়েছে । বিভিন্ন থানায় সেই সব জিনিষ দেওয়া আছে । কিন্তু প্রকৃত ব্যাক্তি সে জিনিষগুলি পেয়েছে কি না জানিনা । এদিকে রাত হয়ে গেছে । ভাবছে এখান থেকে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আবার বেরোবে । এতক্ষনে মেয়ে বুলা হয়তো তার জন্যে অপেক্ষা শুরু করে দিয়েছে । মেয়ে মা বাবা রোজ একসঙ্গে খেতে বসে। মেয়েটি আর ক’দিন বাদে চলে যাবে। তাই মনটা ভীষন ভাবে কেঁদে উঠছে। রাত দশটা বাজে । গাড়ী বারুইপুর এসে থামে।

প্যাসেঞ্জার নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে ।

সন্তোষ বললে – বাবু একটু বাড়িয়ে দিন , কারন এখান থেকে গড়িয়া যাবার লোক পাবো না ।

প্যাসেঞ্জার – পেয়ে যাবে । পেয়ে যাবে । বলে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অন্য যারা ছিল তারা মিলে ত্রিশ টাকা বেশি দিল ।

গাড়ীটা এবার টালিগঞ্জ নিয়ে যাবে । খাওয়া-দাওয়া করে আবার বেরোবে। তাই এই সময় ঐদিকের প্যাসেঞ্জার তুলবে বলে কিছু দুরের প্যাসেঞ্জার ছেড়ে দিয়ে আসতে আসতে রাজপুর থেকে একজন টালিগঞ্জ এর প্যাসেঞ্জার তুললো। ডাবল ভাড়া পাবে । সেই মত কথা ।

সস্তোষ ভাবছে আজ মা’র কৃপায় ভালোই হোল । রাতে কি হয় ? খাবার পর দেখি।

মনে বার বার টেনশন হচ্ছে । টাকা কি যোগার করতে পারবো?

গাড়ীর প্যাসেঞ্জার কে মেট্রোরেল স্টেশন নামিয়ে নিজের বাড়ির কাছে এসে গাড়ী থামাতেই তার মেয়ে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিলো। এই সময় নামতে গিয়ে সন্তোষের চোখ পড়লো কালো ব্যাগটার দিকে। গাড়ির ভেতরে আলোটা জ্বালিয়ে ব্যাগ খুলতেই চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো । ব্যাগের মধ্যে কয়েক গাছা সোনার বালা, আংটি , গলার চেন ইত্যাদি সঙ্গে ২০০০ ও ৫০০ টাকার নোট দেখে মনে হছে দুই লাখ টাকার মত হবে । দেখে ভাবছে এ থাকলে আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে , কারো কাছে হাত পাততে হবে না। কি করবে?

মেয়ে বুলা – বাবা চল না , ক্ষিদে পেয়েছে...মেয়ে আরো কিছু বলছিল ।

সে কথায় কান না দিয়ে কিছুক্ষন ভাবলো , তারপর মেয়েকে বললো – মা তুই আজ খেয়ে নে মা’র সঙ্গে, আমি একটু পরে আসছি । তোর মাকে বলে দিস্‌ বলে গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা কসবা থানায় রওনা দিলো । চিন্তা করলো যে নরেন্দ্রপুর থেকে যারা উঠেছিল তারাই বিয়ের কথা বলছিল, নেমেছিল কসবা । তা হলে তাদের হবে। তাই গাড়ী নিয়ে এসে কসবা থানার দিকে গতি বাড়িয়ে দিল ।

এদিকে যাদের টাকার ব্যাগ তারা বাড়ীতে গিয়ে সকলে মিলে চা খেয়ে মাছের টাকার জন্যে টাকার খোঁজ পড়লো বাড়ির কর্তার ।

তখন তাঁর গিন্নী বললো - বড় প্লাস্টিকের ব্যাগের উপড়েই ছিল।

কর্তা বললো – আমি তো তাই জানি। কিন্তু নেই ... তারপর যা হয় । ঘরের এখানে অখানে , সব ব্যাগে খোঁজ করে না পেয়ে সকলের মাথায় হাত । নরেন্দ্রপুর মিশনে ফোন করে খোঁজ নিয়েছে কারন আগে ওখানে গিয়েছিল টাকা নিয়ে। টাকা পায় নি। ট্যাক্সিওলার খোঁজ চলতেই লাগলো এতো বলা বাহুল্য। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে না পেয়ে কর্তা মনে মনে ভাবলো । যে ব্যাগটার মধ্যে টাকা ও গহনার ব্যাগ ছিল সেটি ব্যাগের উপড়ে ছিল । ট্যাক্সির পিছনের সিটের ওপড় রাখার সময় নিশ্চয়ই ট্যাক্সিতে পড়েছে । তাই তাড়াতাড়ি দেরি না করে সোজা কসবা থানায় নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়ে একটি ডায়রী করলো। দারোগা বাবু জিজ্ঞাসা করেছিল ট্যাক্সি নম্বর আছে।

কর্তা বাবু বললেন ট্যাক্সিওলা রিসিট দিতে চেয়েছিলেন আমি নেই নি । সেই থেকে ঘরে গিয়ে সকলেই চিন্তা করছে । বাড়ির গিন্নি কান্নাকাটি আর শোক করছে। মাঝে মাঝে বলছে ট্যাক্সিওলা টাকা পেলে কি আর দেবে । বলবে আমি দেখিনি। ও যদি না পায় তবে অন্য লোকেরা পেলে তো আর দেবেই না । হায় আমাদের এ কি সর্বনাশ হলো ।

সন্তোষ গাড়ি নিয়ে কসবা থানায় এক পাশে রেখে সোজা বড়বাবুর চেম্বারে ঢুকে পড়ে। বড় বাবু তখন প্রস্তুত হয়েছে এলাকায় রাউন্ডে যাবেন। বড়বাবু লোকটি খুব ভাল । তার কাজের জন্যে স্থানীয় এলাকার লোকেরা খুব সমীহ করেই চলে।

সন্তোষ জিজ্ঞাসা করে – স্যার, কেঊ কি কিছু হাড়িয়েছে বলে থানায় জানিয়েছেন ?

বড় বাবু জিজ্ঞাসা করলেন – হ্যাঁ তুই কি পেয়েছিস্‌?

সন্তোষ টাকার ব্যাগটি রাখতে রাখতে বললে – হ্যাঁ এই যে, তার সারা শরীর টেনশনে তখন কাঁপছে আর ঘামছে । ভাবছে যদি চুরি করেছি বলে দোষ দেয় ।

বড় বাবু – তুই এখান থেকে কত টাকা রেখেছিস ?

সন্তোষ – স্যার কি যে বলেন ! একটি পয়সাও রাখি নি।

বড় বাবু একটু অবাক হয়ে বললে – এক টাকাও না।

সন্তোষ – না । যেমনকার ব্যাগ তেমন আছে । আমি গরীব বাবু । কিন্তু লোভী নই।

বড় বাবু – আচ্ছা !! তুই এই চেয়ারে বস। আমি তাদের ডেকে আনার ব্যাবস্থা করছি । এই বলে থানার ডায়রীর পাতা খুলে সেখান থেকে নম্বর নিয়ে তাদের ডেকে পাঠালো ।

এই সময় থানায় রিপোর্ট নিতে এক সাংবাদিক ঢোকে । প্রতিদিন একবার আসে খোঁজ নিতে স্যারের কাছে , ভাল কিছু খবর আছে কি না জানতে ।

বড় বাবু হাত ও চোখের ঈশারায় তাঁকে বসতে বললো। তাঁর পাশেই সন্তোষকে বসিয়ে স্নেহের স্বরে নানা প্রশ্ন করতে লাগলো। সন্তোষ একটু সাহস পেয়ে ও বাংলাদেশ ছিল এবং ভারতে আসা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সব বলে গেলো ।

এর মধ্যে বড় বাবু চা আনালো । সাংবাদিকের সঙ্গে ড্রাইভার ভাগ পেলো।

যাদের জিনিষ খোয়া গেছে তারা কর্তা গিন্নি ও বাড়ির আর সকলে থানায় উন্মাদের মত ছুটে আসছে । থানায় বড় বাবুর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে গিন্নিমা বলছেন কর্তাকে – আমি তখনি গাড়িতে উঠে বলেছিলাম ব্যাগ সামলে রাখতে। শোনেনি । ড্রাইভাররা পেলে দেয় না কি? ভাগ্যিস সঙ্গে সঙ্গে থানায় ডায়রী করেছিলে তাই বড় বাবুর কৃপায় ট্যাক্সিওলাকে ধরা গেলো ।

সন্তোষ এক পাশে দাড়িয়ে ঐ কর্তাটিকে বললেন – টাকা গুনে নিয়ে আমাকে রেহাই দিন ।

কিছুক্ষন সময় কাটার পর কর্তা খুব খুশি । কারন দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকা এবং প্রায় এক লাখ টাকার গহনা ছিল । কিছুই নরচর হয় নি । কর্তা খুশি হয়ে ২০০০ টাকা বের করে ট্যাক্সিওলাকে দেবার জন্যে থানার বড় বাবুর সামনে দিতে গেলেন ।

সন্তোষ বললেন – বাবু আমি গাড়ি চালিয়ে উপার্জন করি । চোর নই। কোলকাতার বুকে প্রায় ৩০বছর আছি । লোকের উপকার করেছি । কিন্তু আমি অসৎ হতে পারিনি। ও টাকা আমি নেব না।

কর্তা বললেন – আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি নাও , এটা বকশিষ । বড় বাবুও বললেন নাও, ভয় নেই।

সন্তোষ বললো – আপনার বকশিষের টাকা নিয়ে আমি আমার সততা বেঁচতে পারবো না গো বাবু।

এই বলে থানা ছেড়ে বাড়ির উদ্দ্যেশে বেড়িয়ে পড়লেন। সকলে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। গাড়িটি থানা থেকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

গল্পটা এখানে শেষ করতে পারতাম । কিন্তু পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে তারপর সন্তোষ কি তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারলো ? টাকা যোগার করতে পারলো । তাই শেষটা বলি

সন্তোষ মনটা খারাপ করে বাড়ী আসে। মনে মনে ভাবছে। আমরা বস্তিতে থাকি বলে কি মানুষ

না ? লোকে যা পারে তাই বলে। যাইহোক আমি একটা ভাল কাজ করেছি টাকা ফেরৎ দিয়ে । তাতে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে পারি আর নাই পারি । মনটা এই ভেবে খুব ভালো লাগছে।

গাড়ী মালিকের বাড়ীতে রেখে রাত ২টোর সময় ঘরে ঢুকে দেখে মা ও মেয়ের খাওয়া হয়ে গেছে, মেয়ে ঘুমাচ্ছিল। সন্তোষ খেয়ে-দেয়ে নিজেও একটি বিড়ি খেতে খেতে মেয়ের বিয়ের টাকা কি ভাবে যোগার করা যায় ! চিন্তা করতে করতে শুয়ে পড়লো এবং গভীর নিদ্রায় মগ্ন হলো।

পরেরদিন সকাল বেলা ৬টার সময় গাড়ীর মালিক খোঁজ করতে করতে সন্তোষের বাড়ী এসে উপস্থিত । ঘরের বাইরে থেকে দরজায় কড়া নারছে আর সন্তোষ সন্তোষ বলে ডাকছে।

সন্তোষ তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে ঊঠে বাইরে এসে দেখে গাড়ীর মালিক। অবাক কান্ড । সাত সকালে হাজির । হাতে একটা পত্রিকা ভাঁজ করে ধরা। কি ব্যাপার ? আজ পর্যন্ত একদিনও আমার বাড়ীতে আসে নি। প্রয়োজনে লোক পাঠাতো । তা হলে থানা থেকে কেউ কিছু এসে বলেছে। আমরা গরীব। যে কোন একটা দোষ দিয়ে দিতে পারে । এইসব ভাবছে...।

গাড়ির মালিক – (হাসতে হাসতে) কি রে এত ঘুমালে মেয়ের বিয়ের টাকা তুলবি কি করে ?

সন্তোষ – দশটায় বার হবো। আজ থেকে রাতেও গাড়ী চালাবো মালিক।

গাড়ির মালিক – তা হবেখন। আগে দেখ পত্রিকাটি । সন্তোষের হাতে দিতে দিতে মালিক আবার বললেন – প্রথম পাতার নিচের দিকে তোর ছবি বেরিয়েছে , আমার ট্যাক্সির ছবিও আছে । আমার সম্বন্ধে তোকে নিয়ে অনেক কথা লিখেছে।

সন্তোষ পত্রিকাটিতে চোখ বোলাতে বোলাতে তার স্ত্রী ও মেয়ে চলে এলো । মেয়ে পেপারটি হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো আনন্দে ও বাবার গর্বে ।

মালিক – তুই কালকে একবারও আমাকে কিছু খবর দিলি না তো ? আমি তোর কাজে গর্বিত । আবার আমার নামও তোর জন্যে কাগজে বেরিয়েছে। তাই আমার কর্তব্য আমি করবো । তোর মেয়ের জন্যে যত টাকা পারিস এইভাবে সৎপথে খুব খেটে যোগার কর । তবে বেশী রাত করবি না। শরীর ঠিক রাখিস । যে টাকা যোগার হবে না , সেটা আমি দেবো । তুই পরে পরে শোধ করিস যতটা পারিস।

সন্তোষ তো কিছুই বুঝতে পারছে না। মালিকের কথা গুলি শুনে তার বুক ফেঁটে কান্না এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে করজোরে প্রনাম করে, মালিককে বললো – আমি আর এমন কি করেছি । হারিয়ে যাওয়া ব্যাগটা ফেরৎ দিয়েছি । এটা এত বড় কাজ বুঝতে পারছি না। কারন ওটা আমার কর্তব্য ছিল। শুধু যেন হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ যার, তার কাছে পৌঁছায়, আমার ইচ্ছেটা তাই ছিল । সততার দাম ভগবান এমন করে ফিরিয়ে দেন ।


Sent from my iPhone