টপিকঃ কুসন্থান -অরিজিনাল রাইটার স্বাতি রয়

কুসন্থান

আজ গল্প টা পরে এতো টা মন খারাপ যে লিকতে ইচ্ছে করছে না ।
সত্যি আমার নিজেদের মানুষ বলার পরিচয় দেবার  joghota হারিয়াছি   

সকাল থেকে নিরুদ্দেশ প্রভাদেবী। বয়স তার পঁচাত্তরের ওপরে। শীর্ণ জীর্ণ কায়, চোখে কম দেখেন। হাটেন অনেকটা কুঁজো হয়ে। স্বামী গত হয়েছেন চল্লিশ বছর আগে। সেই থেকে ছেলেকে একাই মানুষ করেছেন তিনি। কিন্তু আজ সকাল থেকে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

চারিদিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে পুলিশে এফ আই আর ফাইল করে সত্যব্রত। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার তিনি। প্রভাদেবী ওনার সাথেই ওনার ফ্ল্যাটেই থাকতেন। অ্যাপার্টমেন্টের সবার কাছে প্রভাদেবী পরিচিত ছিলেন " চকোলেট দিদুন" নামে। রোজ বিকেলে বাচ্চারা তাকে গোল করে ঘিরে বসে গল্প শুনত। প্রভাদেবীর নিরুদ্দেশ হওয়ায় সব চেয়ে বেশি কষ্ট তারাই পেয়েছে।

সকাল থেকে ঠাকুমাকে না দেখতে পেয়ে পাগলের মত কেঁদে চলেছে সত্যব্রতের ছয়বছরের মেয়ে ঈশানী।  ঠাকুমা কাল রাতে তার সাথে ঘুমায় নি। সকালে ঠাকুমাকে না দেখে সে স্কুলে যায় না। ঠাকুমাও তাকে ভীষণ ভালোবাসে। স্কুল যাওয়ার আগে রোজ ঠাকুমাকে হামি খায় সে। আজ ঠাকুমা নেই বলে কেঁদে  কেঁদে স্কুলেও যায় নি সে।

পুলিশ তদন্ত করেও প্রভাদেবীকে খুঁজে পায় না। সম্ভাব্য সকল স্থানে তাকে খোজা হয়। দিনের পর দিন কেটে যেতে থাকে।

ঈশানীর ভীষণ শরীর খারাপ।  জ্বর কমছে না কিছুতেই। অবচেতনমনে সারাক্ষণ ঠাম্মু ঠাম্মু করে চলেছে।

সত্যব্রতের চেনাশুনো বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অর্নবকান্তি সান্যাল তার চিকিৎসা করছে। আজ সাতদিন হল প্রভাদেবী নিরুদ্দেশ এবং একই ভাবে ঈশানীও অসুস্থ। সমস্ত রকম ব্লাড টেস্ট করার পরেও কি রোগ তা জানা যায় নি। দুশ্চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারে না ইঞ্জিনিয়ার দম্পতি। অন্যদিকে মেয়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ থেকে খারাপতর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

অর্নবকান্তি,  সত্যব্রত এবং তার স্ত্রী সুপ্রিয়াকে বললেন,  " দেখো ওর মন ওর শরীর খারাপের জন্যে দায়ী। তোমার মাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো, না হলে ওকে বাঁচানো দু:সাধ্য কাজ হয়ে যাবে। "

উদ্বিগ্নতা আরো একরাশ বেরে গেল তাদের। প্রভাদেবীকে সব জায়গায় খোজা হয়েছে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় নি। কি করছে কোথায় আছে কেউ জানে না। বেঁচে আছে কিনা তাও কেউ জানে না।

ঘর পরিষ্কার করার সময় আলমারির নীচে থেকে একটা খামে বন্দী চিঠি পেল মাধবী। সত্যব্রতের বাড়িতে ঠিকা কাজে নিযুক্ত সে। প্রভাদেবী নিজের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলেন মা বাবা মরা মেয়েটিকে। সেই থেকে এখানেই আছে। ঈশানীর মত তারও মন খারাপ প্রভাদেবী চলে যাওয়ায়। একজনই অবল্মবন ছিল তার। প্রভাদেবী তাকে অল্পবিস্তর লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বিকেলে পুলিশ এলে চিঠিটা পুলিশের হাতেই তুলে দেয় মাধবী।

চিঠিটা পড়তে পড়তে ইমোশনাল হয়ে পরেন তদন্তের ভারপ্রাপ্ত জাঁদরেল অফিসার সুবিনয় ব্যানার্জী।

"কল্যাণীয়,
      সত্যব্রত,

প্রথমে আমার অনেক ভালোবাসা নিস। বৌমা এবং আমার ছোট্ট রাজকুমারীকে অনেক ভালোবাসা দিস।

জানিস খোকা এখনও মনে আছে সেদিনের কথা যেদিন তুই আমার কোল আলো করে এসেছিলিস। অধিক বয়েসের সন্তান ছিলিস তুই আমার। আমি আর তোর বাবা আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু ঠিক তখনই আমাদের জীবন আলোকিত করতে তুই এলি।  তোর ছোট্ট ছোট্ট হাত আমার একটা আঙুলকে ধরেছিল প্রথমবার। ঠিকমত কাঁদতেও পারতিস না। পাশ ফিরতে পারতিস না।

আমি যখন দিনের সব কাজ শেষ করে রাতে ঘুমোতে যেতাম তখন হঠাৎই তুই কেঁদে উঠলে তোকে সারারাত ঘুম পারাতে পারাতে নিজেরই আর সে রাতে ঘুম হত না। আমার কোল ছাড়া দোলনায় ঘুমোনো তোর পছন্দ ছিল না।

এখনও মনে পরে, তোকে নিয়ে একবার শিয়ালদহ যাচ্ছিলাম। দমদম জংশনে ট্রেনের ঝাঁকুনির শব্দে কেপে উঠে ভয় পেয়ে কি ভীষণ কান্না।  শেষে এক বয়স্ক মহিলার পরামর্শে তোকে সবার সামনে দুধ খাওয়াতে হয়। তবেই তুই চুপ করিস।

আরেকবার তোর মামার বিয়েতে তোকে নিয়ে খেতে বসেছিলাম। তুই সবার সামনেই পটি করে দিল। তোকে জামাকাপড় চেঞ্জ করিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিয়ে এলাম।

একটু একটু করে বড় হলি। হামা কাটতে শিখলি। সারাঘর হামা কেটে ঘুরে বেড়াতে লাগলি। আর হাটা শেখার পর সে তো কোনো কথাই নেই। তোর দুষ্টুমি কয়েকগুণ বেড়ে গেল। এটা সেটা ভাঙা, সব জিনিস্কে আমার দেখা দেখি সেলাই করার চেষ্টা।

ধীরে ধীরে আরেকটু বড় হলি। স্কুলে ভর্তি হলি। আমি আর তোর বাবা মিলেই তোকে স্কুলে দিয়ে আসতাম। স্কুলের প্রথমদিন কি কেঁদেছিলি। তোর কান্না দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছিল।

আমাদের বাড়ির ছোট্ট কুকুর ছানা নিরোকে তুই খুব ভালোবাসতিস। ও মারা যাওয়ায় তিনদিন কিছু খাস নি। তোকে খেতে না দেখে আমিও খেতাম না। কষ্ট হত তোর জন্যে। তাই তো তোর বাবা আবার একটা নিরো তোকে এনে দিল।

আরেকটু বড় হয়ে হাইস্কুলে উঠলি  হঠাৎ তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ভেবেছিলাম আত্মহত্যা করব। কিন্তু তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে তোকে আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

কিছু জমানো টাকা দিয়ে সেলাই মেশিন কিনে দর্জির কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ব্যবসাটাও বড় হল। তুইও বড় হলি। কলেজে গেলি বৌমার সাথে পরিচয় হল। কলেজ শেষ করে নামী ইঞ্জিনিয়ার হলি। বিয়ে হল। ঈশানী এল আমাদের জীবনে।

কিন্তু আমার ছোট খোকাটা কোথায় হারিয়ে গেল।

বৌমা বলে আমি ব্যাকডেটেড, তাই প্রায়শই লোকের সামনে কিংবা ওর বান্ধবীদের সামনে আমার জন্যে ওকে লজ্জা পেতে হয়। তুইও তাই ই বলিস খোকা।

কদিম বিছানায় পরে ছিলাম।  বিছানাতেই মলমূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য ছিলাম। আয়া রেখে দিয়েছিলিস। কিন্তু তোরা আমার ঘরে ঢুকতিস না। কারণ তোদের ঘেন্না লাগত। আমি বিছানায় পরে কাঁদতাম।  ছোট্ট ঈশুকেও দূরে রাখতিস আমার থেকে। কষ্ট হত খুব জানিস খোকা।

সুস্থ হলাম। তবুও ঈশানীকে আমার কাছে রাখা তোদের পছন্দ ছিল না।

বৌমার কাছে কিছু শখের জিনিস খেতে চাইলে বৌমা বলত " এই বয়সে এত খাওয়া কিসের?"

আমার জামাকাপড় আমি ধুতে পারতাম না, মাধবী কদিনের জন্যে গ্রামে গিয়েছিল। ওয়াশিং মেশিনে জামাকাপড় দিয়েছিলাম। বৌমা জামাকাপড় লাঠি দিয়ে তুলে নিচে ফেলে দিয়ে বলেছিল " প্লিজ মা এত নোংরা জামাকাপড় আমাদের কাপড়ের সঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে দেবেন না  "

জানিস খোকা মায়েরা কখনো সন্তানের মলমূত্র পরিষ্কার করতে ঘেন্না পায় না। ঘৃণা করে না সন্তানের নোংরা জামাকাপড়ও।

কিন্তু সন্তানেরা মা বাবার মলমূত্র নোংরা জামাকাপড় এত ঘৃণা করে কেন বলত? একটা বয়সের পরে মা বাবাও তো ছোটই হয়ে যায়। তারা জেদ ধরে মনের মত খাবার খাওয়ার জন্যে ঘুরতে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু সন্তানেরা তাদের সারাদিন দুচ্ছাই করে কেন বলত? বয়সে হয়ে যাওয়া মানেই কি আমরা আবর্জনা? অকেজো?

আমাকে নিয়ে তোর আর বৌমার ঝগড়া আমি শুনেছি। তোরা ঠিক করেছিলিস আমায় বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবি। আমার ইচ্ছে করল না স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রম যেতে ।  তাই আমিও আমার স্বামীর কাছেই চললাম।  তুই ভালো থাকিস খোকা ,  বৌমাকেও ভালোবাসা দিস। জানি ঈশানী যখন আমার অনুপস্থিতি বুঝতে পারবে খুব কষ্ট পাবে। কিন্তু খোকা আমার যে আর রাস্তা নেই। রোজ তোদের লাথি ঝাটা মুকঝামটা খেয়ে আমি যে বড় ক্লান্ত খোকা। আমি ঘুমোতে চাই। চির শান্তির ঘুমে।

                                                                                                                                       ইতি,
                                                                                                                            তোর অভাগী মা। "

ইন্সপেক্টর জোরেই পড়ছিলেন চিঠিটা। চিঠিটা শেষ করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। সত্যব্রতের মুখে কোনো ভাষা নেই চোখ বেয়ে শুধু জল পড়ছে। আত্মগ্নানি অনুতাপের জল সেটা। সুপ্রিয়া চুপ করে বসে আছে অপরাধীর।  তারা জানে না ঈশানীর কি হবে। তাদের পাপের শাস্তি হয়ত তাদের ছোট্ট মেয়েটি পাবে।