টপিকঃ খেলাঘর part 2 রাইটার মুক্তা রয় অ্যান্ড unspokenwords
পার্থিব এসেছে।পূর্বার কাছে শুনেছে ঘটনাটা।তারপরই দৌড়ে এসেছে।
- আমারই ভুল মাসীমা।আমি আন্দাজ করেছিলাম।প্রিয়াংশুদার দু-চারটে কথাবার্তা ভালো লাগেনি আমার।
পার্থিবর কথা শুনে সবাই অবাক।কী এমন ঘটনা জানতে পেরেছিল পার্থিব?পার্থিব কিছু না বলে উঠে চলে যায় রত্নার ঘরে।বড় বড় তিনটে পুতুল নিয়ে খেলছে রত্না।
- পূর্বা,তোর ননদকে ওরা তিনবার জোর করে অ্যাবরশন করিয়েছে।শকটা ও নিতে পারেনি।পাগল না হলেও মেন্টালি ডিস্টার্বড।ওর মেন্টাল সাপোর্টের ভীষণ প্রয়োজন।ভালোবাসা না পেলে হয়তো একদিন-
গলা ধরে আসে পার্থিবর।ছলছলে চোখ পূর্বার।
- কী করে জানলি তুই দাদাভাই?
- তিনটে পুতুল নিয়ে খেলছে ও।পাগলামোটা দেখা দিয়েছে ওর বাচ্চাটা নষ্ট হবার পরে।সেরকমই তো তোদের বলেছিল না?কিন্তু আমি-
পূর্বাদের বৌভাতের রাতের ঘটনাটা বলে যায় বোনকে।রত্নার ছোড়দাও দাঁড়িয়ে শুনছে।
- এখন তাহলে কী হবে পার্থিব?ভালো কোন সাইকিয়াট্রিস্ট-
- নিশ্চয়ই ওরা দেখায়নি।বেতো ঘোড়াকে কে আর পোছে?আপোষে ডিভোর্সটা যখন পেয়েই গেল, না পেলে হয়তো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে পাগল প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করত।অ্যালিমনিই তো বাদই দিলাম, স্ত্রীধনও তোমরা ছেড়ে দিলে!পূর্বা, তোর বরের মতো সজ্জন লোক দিয়ে আজকাল চলে না রে।এত কাছে থেকে বোনের ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারেনি!লোক চিনতে না পারলে এই হয়।আমার মতো ব্যাবসাদার হলে দুদিনে ব্যাবসা লাটে ওঠাতে ভায়া।ভাগ্যিস শিক্ষকতা কর।যেমন বোন তেমন দাদা!রামবোকা!
- ঠিকই বলেছিস দাদাভাই।এরা এত ভালোমানুষ!মেয়েটার এখন কী হবে?
ভয়ার্ত গলা পূর্বার।রত্নার মা রমাদেবী আলোচনা শুনে চলে এসেছেন।শুকনো চোখমুখ।
- কত দেখেশুনে ঘরের কাছে বিয়ে দিলাম মেয়েটার।কোনদিন বুঝিইনি ওরা এমন কসাই!জীবন্ত মেয়েটার গা থেকে মাংস কেটে কেটে নিয়েছে!
কান্নায় ভেঙে পড়েন মানুষটা।পূর্বা সামলাচ্ছে ওনাকে।
- আমি অতটা বুঝিনি মাসীমা।শুধু সন্দেহ হয়েছিল।
- আমি অতটা বুঝিনি মাসীমা।শুধু সন্দেহ হয়েছিল।
- তাও তো তুমি আন্দাজ করেছিলে ভাই।আমরা কাছে থেকেও-!ঠিকই বলেছ তুমি।আমাদেরই ভুল।আমরা ভাবি কাছের ছেলের হাতে দেব।খোঁজও নেওয়া যাবে, দেখাও যাবে কেমন আছে।কিন্তু কাছের মানুষকে চিনতেই যে ভুল হয়!তোমার হাতেই যদি ওকে দিতাম!বৌদি এনেছিল তোমার প্রপোজাল।বাইরের ছেলে, কেমন হবে বলে দেইনি।
দুর্ভাবনা-দুঃশ্চিন্তায় অস্হির অবস্থা রত্নার ছোড়দা অপূর্বর।বাবা নেই, দাদা বাইরে।দায়িত্ব তারই।কী হবে এখন?
- ভুলের সংশোধন আছে অপূর্ব।আজও চাইলে দিতে পারো।অবশ্য তোমাদের যদি মত থাকে।জোর করব না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্থিব।রত্নার ফোটটা আজও তার ওয়ালেটে আছে।ফেরত দিতে পারেনি।মাসতুতো দিদি স্মৃতি রত্নার বড়বৌদি।দিদিভাইয়ের বিয়েতেই ওকে দেখেছিল প্রথম।বরযাত্রী গিয়েছিল কলকাতায়।কলেজে পড়ত।পার্থিবও কলেজের ছাত্র তখন।একরাতের দেখা।কতটুকুই বা পরিচয়?রত্না মনে রাখেনি, কিন্তু পার্থিব ভুলতে পারেনি।পরে দিদিভাই স্মৃতি যখন রত্নার সম্বন্ধ আনলো তার জন্য কী যে উত্তেজনা বলার নয়!কিন্তু দিদিভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি রাজী হয়নি এতদূর মেয়ে দিতে।শুনলো রত্নার বিয়ে হয়ে গেছে।কতদিন চুপচাপ বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে, কিন্তু কষ্টটা কাউকে জানায়নি, বুঝতে দেয়নি।এমনকি বুনু পূর্বাও জানে না।আবার এল সম্বন্ধ ওই বাড়ির ছেলের সাথে বোন পূর্বার।পার্থিবর উদ্যোগেই বিয়েটা হল।
- তুমি কী বলছ বাবা?আড়াই বছর একজনের ঘর করা মেয়ে।তিনটে বাচ্চা অ্যাবরশন করা আধপাগল অবস্থা ওর!এমন মেয়েকে তোমার হাতে দেব?আমাদের এত স্বার্থপর ভাবো?তোমার দিক দেখবো না?তোমার বাড়ির মানুষ কী ভাববেন?বৌমারা আমাদের কী মনে করবে?
সজোরে মাথা নাড়েন রত্নার মা রমাদেবী।অবাক হয়ে গেছে অপূর্ব আর পূর্বাও।
- ও আর ঘর করল কোথায় মাসীমা?টাকা কামানোর মেশিন ছিল।একে কী বিয়ে বলে?
- বোনকে আমরা বিয়ে দেইনি ভাই।হাতপা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছি।কী ব্রিলিয়ান্ট উজ্জ্বল মেয়েটা কী হয়ে গেল!ও কী আর ঠিক হবে?
সামলাতে পারছে না অপূর্বও।চোখে অবাধ্য জল।
- কেন ঠিক হবে না?কাল ওকে নিয়ে চল সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।দেখবে তিনিও বলবেন ওর মানসিক শান্তি আর মনের আরামের কতটা প্রয়োজন।
পার্থিবর কথাই ঠিক।আঘাতে আঘাতে জর্জরিত চাপা মেয়েটা।স্বামীর কাছে লাঞ্ছিত।প্রেম-স্নেহ দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কী দৈহিক মিলনেও কুণ্ঠিত ছিল প্রিয়াংশু।পাছে কোনভাবে সন্তান এসে যায়।রাতের পর রাত স্পর্শটুকুও করেনি স্ত্রীকে!অনেক সময় শাশুড়ি এসে শুতেন বৌমার কাছে।ছেলে অন্যঘরে থাকতো এটাসেটা অছিলা করে।প্রোটেকশন নিয়েও সম্পর্ক করতে চাইতো না, একবার রত্না শেষ মূহুর্তে সেটা লুকিয়ে ফেলেছিল বলে।যার ফলে দ্বিতীয় বাচ্চাটা চলে এসেছিল।তারপর থেকে পাকাপাকিভাবেই শাশুড়ির শোওয়ার জায়গা হল রত্নার ঘরখানা।শ্বশুর-শাশুড়ি ছোট মেয়ের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে মার্চে বালুরঘাট গিয়েছিল, আর বন্ধুর সাথে ক্লাবে গিয়ে দুদিন ড্রিংক করে বাড়িতে ফিরেছিল প্রিয়াংশু ফাঁকা বাড়ি পেয়ে।যার ফলে তিন নম্বর বাচ্চাটা আসতে পেরেছিল।সন্তানের তীব্র আকাঙ্খা, পরিশ্রান্ত শরীর, ক্ষতবিক্ষত মন শরীরী চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছিল রত্নার।সাময়িক জৈবিক আনন্দেই খুশি থাকতে চাইতো।হতভাগিনীর সেটুকু একেবারেই জোটেনি।শুকনো মরুভূমির মধ্যে গিয়ে পড়েছিল।সেখানে স্বামীর প্রেম, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল মরীচিকা মাত্র।সমানে খাটতো ঘরে-বাইরে।ভাবতো এই বুঝি ধরতে পারবে মরীচিকাকে -এই বুঝি সুখে সংসার করতে পারবে।
- তুই আমায় খাওয়াতে পারবি না ছোড়দা?আমি আর বিয়ে করব না।আবার ওরা খাটাবে আমাকে দিয়ে!একটুও ভালোবাসবে না-
- তোকে ভালোবাসবে।দেখিস-
- না দাদা!
ভয়ার্ত মুখ রত্নার।ছোড়দাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে।ছোড়দার চোখেও জল।অসহায় চোখে তাকায় পার্থিবর দিকে।পার্থিব রত্নার পাশে এসে বসে।
- না না, বিয়ে দিচ্ছে না কেউ তোমায়।আমাদের সাথে চল বেনারসে।সবাই মিলে মজা করব একটু।তুমি তো যাওনি আমাদের বাড়ি।ভালো লাগবে তোমার ওখানে।তুমি ঘুরতে ভালোবাস না?
- ওখানে কেউ আমার বাচ্চা কেড়ে নেবে নাতো?
- না, কেউ কেড়ে নেবে না।দেখো তুমি।সত্যিকারের একটা ডল দেব তোমায়।
আর্দ্র গলা পার্থিবর।নতুন কেনা একটা ডল এনে রত্নাকে দেয়।দুজনে মিলে খেলতে বসে।ম্লান হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় অপূর্ব।পূর্বা উঠে এসে দাদাভাইয়ের পিঠে হাত রাখে।ভেজা চোখ।দাদাভাইয়ের মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
- আমি গর্বিত বললেও কম হবে দাদাভাই।তুই চিরকালই আমার কাছে ধাঁধা।মা-বাপী তোকে কিছুটা চেনেন।আমাদের সকলের আস্থা তোর ওপর।শুধু দেখিস কেউ যেন আমার স্বামীকে ভুল না বোঝে।এরা সত্যিই খুবই সাদাসিধে।
- সেটাই তো ওর এক্স শ্বশুরবাড়ির সুবিধে হয়েছে।ওদের মুখোশটাকে এরা মুখ ভেবেছিল।তোর দাদাভাইয়ের মতো লোক চড়িয়ে খাওয়া বদখৎ লোক তো এরা নয়।দিদিভাইরা থাকলে হয়তো তাও কিছুটা ধরতে পারতো।উনারা তো আবার গিরগিটির মতো রং বদলাতে ওস্তাদ!সবার চোখে ধূলো দিয়ে মেয়েটাকে মারতে বসেছিল!
ক্রোধ-যন্ত্রণা-ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে পার্থিবর মধ্যে।ভাইবোনের ফিসফিসিয়ে বলা কথার দিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে চেয়ে থাকে রত্না।তারপর আবার পুতুল খেলায় মন দেয়।পার্থিবও যোগ দিয়েছে।রত্নার বড়দা-বড়বৌদি এসেছে।সবাই মিলে আলোচনায় বসেছে।বড়বৌমার আনা প্রস্তাবটায় তখন যে কেন রাজী হলেন না তাই নিয়ে খানিকক্ষণ বিলাপ করলেন রমাদেবী, কাঁদলেন।পার্থিবর বাবা-মা আগামীকাল আসবেন।
- এতদিন ধরে চেষ্টা করেও ছেলেকে বিয়েতে মত করাতে পারিনি, রমাদি।শেষে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
বিয়ে-থা করবে নাতো করবে না।কী করব?মায়ের কষ্ট বুঝল না ছেলে!খালি ব্যাবসার পেছনে ছুটছে!সে এখন নিজের থেকে মত দিয়েছে বিয়েতে।এতেই খুশি আমরা।
পার্থিবর মা প্রতিমা সান্ত্বনা দেন সবাইকে।তবু কিন্তু কিন্তু করছেন রমাদেবী।
- কুমারী মেয়েকে দিলাম না সেদিন, আর আজ এই অসুস্থ মেয়েটাকে কোন প্রাণে দেব আপনাদের এত সুন্দর ছেলের হাতে, দিদি?এ যে ঘোর স্বার্থপরতা!পার্থিব ছেলেমানুষ-
- দেখুন বেয়ান, ছেলে রাজী থাকলে আমরা অরাজী নই।আমাদের ছেলের বয়স বেশি নয় ঠিকই, কিন্তু ভীষণ বুদ্ধিমান।হৃদয়বান তো বটেই।ও যা করতে চায় বেঠিক হয় না কক্ষণো।সংস্কার আমাদের নেই।আজ বলছি আপনাদের, আমার ঠাকুর্দা প্রিয় বন্ধুর বিধবা কন্যার সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন।তিনিই আমার মা।আর বলুন তো, আমার যদি আর একটা মেয়ে থাকতো, তার যদি এমন হত তবে আমি তাকে ভালো করার চেষ্টা করতাম না?বিয়ে দিতাম না?রত্নামায়ের আগের বিয়েটা বিয়েই ছিল না।পূবির কাছে সব শুনে শিউরে উঠেছি।
পার্থিবর বাবা সুব্রতবাবুর সাফ কথা।
দুদিন পর পূর্বা ওর ননদকে সাজিয়ে দেয়।কপালে লাল টিপ।দামি কাঞ্জিভরম শাড়ি।বেণীতে রজনীগন্ধার মালা।হাতে-কানে-গলায় গয়না।সবই নতুন।রত্নার প্রাক্তন শাশুড়ি যথারীতি কিছুই ফেরত দিয়ে যাননি।রত্না হেসে জিজ্ঞেস করেছিল,ব্যাপারটা কী?পূর্বা জবাব দেয় বাড়িতে একটা ফাংশন আছে।তারপর এক ভদ্রলোক রত্নাকে কাগজে সই করতে বলেন।ডিভোর্সের কোন পেপার বুঝি ভেবে সই করে দেয় রত্না।সেই রাতে পার্থিব রত্নার সাথে চার নম্বর ডলটা নিয়ে খেলতে বসে।খেলতে খেলতে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে রত্নাকে জড়িয়ে ধরে পার্থিব।তারপর আরও কাছে টেনে নেয়।জৈবক্ষুধা জেগে ওঠে রত্নার মধ্যে।আঁকড়ে ধরে পার্থিবকে।দেখল প্রিয়াংশুর মতো বকাঝকা করে পাশ কাটিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল না দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছেলেটা!উল্টে-!! নাহ্,ভাবতেই পারছে না রত্না!তারপরও কী সুন্দর মিষ্টি হাসে!আরে,ওতো প্রিয়াংশুর চেয়ে দেখতেও অনেক সুন্দর!
বেনারসে এসেছে রত্নারা।আছে পার্থিবদের বাড়িতে।ওর কাছেই থাকে।পার্থিব বলেছিল ছোট্ট একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান হবে।রত্না যদি কাইন্ডলি ওর বউ সেজে সেখানে পরিচয় দেয় খুব উপকার হয় পার্থিবর।নইলে কী পরিচয়ে রত্না পার্থিবর কাছে থাকবে?এক সাথেই বা থাকবে কী করে?এদিকে শিলিগুড়িতে প্রিয়াংশু নিশ্চয়ই ওঁৎ পেতে আছে রত্নাকে ধরার জন্য?ছ'মাসের মধ্যে ওরা চেয়েছিল দোতলাটা শেষ করতে।সব ভেবেচিন্তে রাজী হয় রত্না।মা-দাদারাও সব ছিল।আনন্দ করল সবাই খুব।রত্নাও খুশি।ছেলেটার কথাটা রাখতে পেরেছে।কিন্তু অনুষ্ঠানটা এত্তো বড় হবে কল্পনা করতে পারেনি রত্না।তারপর থেকে এখানে সবাই তাকে ভাবীজী বলে ডাকে।ডাকটা ভালোই লাগে রত্নার।সবচেয়ে ভালো লাগে যখন যা ইচ্ছে করার মজা।রান্না-সেলাই-গান সবেতেই মন দিতে পেরেছে।
রত্নার উন্নতি দেখে বাড়ির সবাই খুশি।
মা-দাদা-বৌদিরা ফিরে গেলেন।রত্না তিনতলার টবগুলোয় জল দিতে দিতে গুণগুণ করে গাইছিল।ভারী সুন্দর পরিবেশটা বাড়ির।তিনতলা থেকে গঙ্গা দেখা যায়।ছোটর থেকে কাশীধামের নাম শুনে আসছে।আর পার্থিবদের বাড়িটা দেখলে মনে হয় যেন ঊনবিংশ শতকে চলে আসছে।খোলামেলা দেউড়ি-উঠোনওয়ালা বিশাল এক হাভেলী।মাসীমা গল্প করেছিলেন ওনার শ্বশুরমশাইয়ের বাবা স্থানীয় এক ভূস্বামীর থেকে বাড়িটা কিনেছিলেন।বাইরেটা অটুট রেখে ভেতরটা আধুনিক করা হয়েছে।বাড়িতেই অফিস পার্থিবর।দুপুরবেলা ফাঁক পেলেই চলে আসে তার কাছে।জল দিতে দিতেই লাল হয়ে ওঠে রত্না।
- খালি কাজ করে বেরানো,তাই না মেয়ে?আমার দিকে কোন খেয়াল নেই!
পেছন থেকে রত্নাকে জড়িয়ে ধরে পার্থিব।তারপর বুকে তুলে নিয়ে যায় ঘরে।
- আমাকে ডল দেবে না?
অভিমানী গলা রত্নার।চিন্তা করছে পার্থিবও।আজ তিন মাসেও কনসিভ করতে পারেনি রত্না।গাইনির সাথে কথাও বলেছে পার্থিব।মনে মনে বলে তোমার চার নম্বর ডলটা যে আমার ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা, সোনা।ওকে আনতেই হবে।
- কিগো?কবে দেবে?
- এই তো ।দেব এর মধ্যেই।তুমি সাবধানে থেকো।বেশি ওপরনীচ কর না।কেমন লাগছে জায়গাটা আমার রতনের?
খুব ভালো।মাসীমার সাথে গঙ্গার ধারে ঘুরতে দারুণ লাগে!কবে নৌকো করে আবার আমাকে নিয়ে যাবে?
- এর মধ্যেই।যেদিন তুমি বলবে।ডলটা এলে তখন যাওয়া যাবে না আর-
- হুঁ-
একটানে পার্থিবর জামা-প্যান্ট খুলে ফেলেছে রত্না।সাথে নিজেরটা।পাগলীটাকে কাছে টেনে নেয় পার্থিব।এতো তার প্রেমেরই পরীক্ষা।সে ওর ভালোবাসা পায় কিনা।যে মেয়েটাকে সেই তরুণ বয়স থেকে ভালোবাসে এসেছে তার সে আজ শুধুই যৌনসঙ্গী।আকণ্ঠ তাকে পান করে রতন।হয়তো পুরুষজাতের ওপর ওর অবচেতন মনে জমে থাকা ঘৃণা-দ্বেষ তাকে বার বার আঘাত করতে চায়।জানে না সে নিজেকে নৈবেদ্য বানিয়েছে।এছাড়া যে আর কোন উপায় ছিল না ওকে ভালো করার।ক্লান্ত-তৃপ্ত রত্না তার হাতে মাথা রেখে হেসে বলে-
- আমি কিন্তু তোমার সত্যিকারের বউ হব না।এই বলে দিলাম।
- কেন?
- তাহলে তুমি আমাকে খাটাবে-
- নারে মেয়ে না।সবাইকে কী প্রিয়াংশু ভেবেছ?তোমার দাদা বউদের দিয়ে এমন খাটায়?
- নাহ্-
- তবে?
- ওরা তো দাদা।দাদারা ভালো।বররা খারাপ।
- তাই?কিন্তু আমি তো পূর্বার দাদা।তাহলে আমিও ভালো?
- মনে হচ্ছে।আচ্ছা তুমি আমার কে?
- বল কে?এই তো বললে আমাকে বর করবে না।তবে বন্ধু হয়ে থাকি?
- হ্যাঁ, সেই ভালো।জানো মাসীমার সাথে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পূজো দিতে গিয়ে ফেরার পথে তোমার জন্য উল কিনেছি।রংটা দেখতো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?
তাড়াতাড়ি নেমে আলমারি খুলে বের করে আনছে উলের প্যাকেটটা রত্না।একঢাল এলোচুল গা বেয়ে নেমেছে।শরীরে সুতোটি নেই।ঘর বন্ধ থাকলে এমনই থাকে তারা।কাপড় পরতে নিলে রাগ করে।আড়াইটে বছর কিচ্ছু না পেয়ে এমন হয়ে উঠেছে মেয়েটা।দেখা যাক।বাচ্চা হলে যদি ঠিক হয়ে যায়।
- এই দেখো রংটা।কেমন হয়েছে?
পার্থিব চেয়ে দেখল সত্যি সুন্দর রংটা।বাইরে ওর মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই।যা কিছু গণ্ডগোল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে।
- খুব সুন্দর!তুমি বুনতে পারো?
শুনে এমন হাসলো মেয়েটা যেন প্রশ্নটা করে মস্ত ভুল করে ফেলেছে পার্থিব।
- তোমার বোনজামাইকে জিজ্ঞেস কর।বুঝলে মশাই?
- কবে পরাবে?
- এই শীতেই।
- এখানকার শীত মারাত্মক।শীতকালে এমন থাকলে কিন্তু ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
হাসছে পার্থিব।রত্নার চোখে জ্যোৎস্নার হাসি।পার্থিব মুগ্ধ না হয়ে পারে না।
- মোটেও না।আমি তোমায় উষ্ণতা দেব।এইভাবে।
রত্না এসে তার গায়ে ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।নরম বাহুবন্ধনে বেঁধে ফেলে।পরস্পরকে সমস্ত শরীর দিয়ে ছুঁয়ে আছে তারা।আবেগে চোখ বোজে পার্থিব।প্রিয়াংশুটা সত্যি এক হতভাগা।খালি টাকাই চেনে।দেহেরও যে এমন স্বর্গীয় স্বাদ হতে পারে বুঝলই না কোনদিন।তুমিই ঠিক রতন।বন্ধ দরজায় তোমার আমার মধ্যে সুতোর সম্পর্কও বা থাকবে কেন?দূর!ও জিনিসে আমাদের দরকার নেই।তোমার মতো মন যখন খালি মনের কথাই শোনে তখনই আমরা সত্যটা দেখতে পাই।তুমি যাকে মিছিমিছি বিয়ে ভেবেছ, আমাদের সেই সত্যিকারের বিয়েটার সাতপাঁক ঘোরার সময় আমাদের সম্পর্কের ভেতর চলে আসা সুতোটাকেও অগ্নিতে আহুতি দিয়েছি।তাই আজ তুমি আমার সবচেয়ে কাছের।আমরা শুধু অর্ধনারীশ্বর।
ছাদে দাঁড়িয়ে আছে রত্না।এতক্ষণ সোয়েটার বুনছিল পার্থিবর।শীত পড়ল বলে।তারপর উঠে আসে ছাদে।পড়ন্ত বিকেল দেখতে তার বরাবরই ভালো লাগে।গোধূলির লাল আলো কী করে যেন কালো আকাশের বুকে লুকিয়ে পড়ে সারা রাতের জন্য।একটা দুটো করে তারারা উঁকি মারে।বাপী ছোট বয়সে তারা চেনাতেন।তারপর দীর্ঘদিন সন্ধ্যা কাকে বলে জানতো না রত্না।ছাদে উঠে আকাশের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য ভীষণ মন চাইত।উপায় ছিল না কোন।সমানে ব্যাচের সংখ্যা বেড়ে গেছে।সাথে দামও চড়েছে।শেষে এমন হল কলিগরা পর্যন্ত আড়ালে তার সমালোচনা করত।রত্না ভীষণ লোভী।একদিন তার প্রিয় বান্ধবী মধুমিতা তো তাকে অর্থপিশাচ-হৃদয়হীন- ছ্যাঁচড়া পর্যন্ত বলেছিল!ওর একজন পরিচিতর মেয়ে তার কাছে পড়ত।হঠাৎ খেয়াল করল মেয়েটা আসছে না।খুবই মনোযোগী ছাত্রী,ভালোও।ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করাতে বলল ও পড়বে না।খারাপ লাগলেও রত্না আর কিছু ওদের বলেনি।ভেবেছিল মধুমিতার সাথে কথা বলবে মেয়েটির ব্যাপারে।তার সেই জন্মদিনের দিন দুয়েক পরই স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখা মধুমিতার সঙ্গে।রিকশায় উঠতে যাবে রত্না,ওকে দেখে হেসে এগিয়ে যায়।মধুমিতা গম্ভীর।শেষে বলল এমন হৃদয়হীন-অর্থপিশাচ দুটো দেখেনি।পিয়ার বাবা অসুস্থ থাকায় একমাস বেতন দিতে পারেনি মেয়েটা।রত্না বলে শ্বশুরকে দিয়ে যা নয় তাই বলিয়েছে।তারপর ওকে পড়তে আসতে বারণ করেছে।কোন শস্তা মাস্টার ধরে নিক পিয়া।শুনে রত্না হাঁ।মধুমিতা শেষে বলে গেল ,কত বড় বড় যে গল্প করত সে শেষ পর্যন্ত শিক্ষাকে ব্যাবসা বানালো?আর দাঁড়াতে পারেনি রত্না।কোনমতে বাড়ি ফেরে।এত শরীর খারাপ লাগছিল যে বলার নয়।শেষে বোঝে তৃতীয় প্রাণটা তার পেটে এসেছে।পালাতে চেয়েছিল রত্না ওই বাড়ি থেকে।কিন্তু উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে বমিটমি করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।দুদিন ঘোরের মধ্যে ছিল।এত দুর্বল যে পালাবে সেই শক্তিও ছিল না।এদিকে তার মতো স্বাবলম্বী একটি মেয়ে কিভাবে হাত পেতে সাহায্য চাইবে বাপের বাড়ির?কোথায় যেন আত্মমর্যাদায় ঘা লাগছিল তার।তৃতীয় দিন শরীর এত অসুস্থ হল যে ট্যাক্সি ডেকে প্রিয়াংশু আর ওর মা তাকে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।বলল গাইনি নয়,ফিজিসিয়ান দেখাবে।শুধু মনে আছে সাদা একটা আলো জ্বলছিল।কেমন ঘোর ঘোর লাগছিল, ঘুম পাচ্ছিল ভীষণ।একজন ডাক্তার আর নার্সের ব্যস্ত হাঁটাচলা।ভালো করে জ্ঞান ফিরতেই টের পেল সে শ্বশুরবাড়িতে।ভীষণ ব্লিডিং শুরু হয়েছে!কত রক্ত!কাপড়-জামা ভেসে যাচ্ছে!তার সন্তানের রক্ত-
উফ!মাথাটা টলছে কেন?কোনমতে ছাদের রেলিং ধরে বসে পড়ে রত্না।কেমন বমি বমি লাগছে!ছাদে আশেপাশে কেউ নেই।তাড়াতাড়ি দোতলায় তাদের ঘরে চলে আসে।বমি করে হাতেমুখে জল দিয়ে সোফায় এসে বসে।আর একটা প্রাণ তার শরীরে আসেনি তো?এটার কথা কাউকে বলবে না।প্রিয়াংশু স্বামী হয়ে যেখানে তার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলত সেখানে পার্থিব তো তার স্বামীই নয়।ও যদি মেরে ফেলে তার প্রাণটাকে?না না!আর এমনটি হতে দেবে না রত্না।উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়ায়।তারপর এলোমেলো হাতে কোনমতে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ফেলল।সন্ধ্যা লেগেছে।পার্থিব এল বলে।তার আগেই পালাবে রত্না।দৌড়ে নীচে নামছে, কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠে চোখে অন্ধকার দেখে।পড়েই যেত যদি না-
- তুমি কোথায় যাচ্ছিলে আমাদের সোনাটাকে নিয়ে?ও আমার কাছে কতটা দামি জানো?যদি পড়ে যেতে সোনাটার কী হতো?
- তাই তো!পড়ে গেলে ওর-
- চল ঘরে।এখন থেকে শান্ত-লক্ষ্মী হয়ে থাকবে।সমানে একতলা-দোতলা-তিনতলা করবে না।ঠায় রান্নাঘরেও আটকে থাকবে না।যদিও তোমার রান্নায় আমরা মুগ্ধ, কিন্তু সোনাটার জন্য একটু না হয় কষ্ট করবই।কী বল?
- হুঁ, তোমরা ওকে মেরে ফেলবে নাতো?
বউকে ধরে নিজেদের ঘরে এনে শুইয়ে দিয়েছে পার্থিব।গঙ্গা বলে কাজের মেয়েটাকে বলে রেখেছিল ভাবীজীর কাছাকাছি সব সময় থাকতে।ভাবীজীর শরীর ভালো নেই।সেরকম কিছু দেখলে তার মোবাইলে ফোন করতে।যার জন্য গঙ্গাকে একটা মোবাইলও কিনে দিয়েছে পার্থিব।রত্না জানেই না গঙ্গা সব সময় ওর ওপর নজর রাখে।ডিপ্রেশনে ভোগা পেশেন্টকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না।গঙ্গাই একটু আগে তাকে ফোন করে জানায়,ভাবীজী কেমন অস্থিরভাবে দৌড়ে নীচে নামলো!ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।শুনে আর দেরী করেনি পার্থিব।বাইরে কাজে বেরচ্ছিল।সোজা গাড়ি ব্যাক করে বাড়িতে।
- কী বোকা তুমি!আমি ওর বাবা।কত গর্ব হচ্ছে আমার জানো?মা-বাপী শুনলে যে কী খুশি হবেন!নিশ্চয়ই বাবা বিশ্বনাথের কাছে দৌড়বেন।কাল তোমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব,কেমন?
স্নেহার্দ্র গলা পার্থিবর।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে রত্নার।ডাক্তারের নাম শুনে শিউরে ওঠে রত্না।
- না না!ডাক্তার ওকে মেরে ফেলবে!
- না মারবে না।দেখো তুমি-
- সত্যি তো?
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে রত্না।
- আমার ওপর একটু বিশ্বাস রাখো সোনা।সব মানুষই কী সমান?মানবসভ্যতা তাহলে বহুদিন আগেই ধ্বংস হয়ে যেত।তোমার একটু বইটই পড়া দরকার।আমাদের লাইব্রেরিটাতে যেতে পারো সময় করে।তোমাকে ডেল কার্নেগী পড়তে দেব।দুজনে মিলে পড়ব,কেমন?
রত্না অবাক হয়েছে মানুষটার যত্নে।ওর বাবা-মাও কেমন অমায়িক!প্রিয়াংশুর মা মিছরির ধার ছুরিটি চালাতেন ভালোই,মনে রাখিস প্রিয়, বৌমার সবই উর্বর-যেমন মাথা তেমন পেট।বুঝেশুনে চলিস,না পারলে বাইরে যা।ডাক্তারকে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালতে কী যে গায়ে লাগে!তোর যত আদিখ্যিতে!ভালো ডাক্তার লাগে-নার্সিংহোম লাগে!তোর বাবার কাছে মুখ শুনতে হয় আমাকে।কোয়াক ডাক্তার তো কী?
তোর বাবার আনা লোকটাই ভালো ছিল।গব্বো নষ্ট হলে হতো।-গী দেখ,তেজ দেখিয়ে খাবার নষ্ট করল!চাকরি দেখে কালাকুষ্টিকে ঘরে এনেছি।সেই চাকরি ছাড়বে বলছে!আর পারা যায় না।তোর বাবা বলেছে কাল ওর উকিল বন্ধুর কাছে যাবে।মানে মানে পাপ বিদায় করতে চাই।আচ্ছন্নের মতো সেদিন পড়েছিল ঠিকই রত্না,তবে কানে সবই এসেছিল।এক লহমায় দুনিয়াটা যেন বিষ হয়ে গিয়েছিল।
এখানে সবাই তার কথা এত চিন্তা করেন যে লজ্জাই করে রত্নার।স্বামী না হয়েও মানুষটা তাকে কী ভালোটাই না বাসে!ভালোবাসার কাঁচা রং পাকা হয়ে বসেছে রত্নার মনে।উন্মুখ হয়ে থাকে মানুষটার অফিস থেকে ফেরার প্রতীক্ষায়।ওর দরকারে অদরকারে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে।ওর আপত্তি না শুনে রান্নাঘরে গিয়ে ওর জন্য কিছু না কিছু বানাবেই।নিজের হাতে বেড়ে খেতে দেবে।মাসীমা-মেসোমশাইকে কখন যে মা-বাবা ডাকতে শুরু করেছে নিজেও জানে না।মার সাথে গল্প করে অনেকটা সময় কাটে।বাবার ওষুধটা ফাইলটা এগিয়ে দেওয়া তো আছেই।উনি হেসে না করেন।সাবধানে থাকতে বলেন।একদিন হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের সামনে সিঁদুর পরতে গিয়ে মনে হল স্বামীর হাতের সত্যিকারের সিঁদুর পরবে।মানুষটা তো তার স্বামী।ঠাকুরঘর থেকে সিঁদুরের কৌটোটা এনে রাখলো ঘরে।পার্থিব ফিরে এসে মেয়েটাকে দেখে হাসে।মাতৃত্ব ওর শরীরে যেন সৌন্দর্যের জোয়ার এনেছে।চাঁপা রঙের বেনারসী আর গা ভরা গয়নায় অসামান্যা!সিঁদুরের কৌটো হাতে এগিয়ে এল।
- পরাও-
- আমার ভালোবাসা রাঙা সিঁদুর হয়ে তোমার মনেই লেগে আছে সোনা।এর কী আর প্রয়োজন আছে?ঠিক আছে, তুমি চাইলে আমি না করতে পারি?
একটু হেসে সিঁদুর পরিয়ে দেয় বউকে পার্থিব।টুক করে রত্না প্রনাম করলে তাড়াতাড়ি তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে।
- বরকে ভয় পাবে নাতো?
- একদম না-
উজ্জ্বল হাসি রত্নার মুখে।