টপিকঃ পর্তুগীজ প্রভাবে বাঙালি রসনা
পর্তুগিজ এক পর্যটক তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছেন, ‘ইউরোপের তুলনায় বাংলার ভাত সুস্বাদু। বিশেষত এর সুঘ্রাণ। রান্নার পর এর নিখুঁত সূক্ষ্মতা আর অমায়িক সুবাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, মনে হয় কে যেন বাতাসে কয়েক ধরনের সুগন্ধি ছড়িয়ে দিয়েছে।’
বাঙালির প্রধান খাবার বলতে পাতে ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত। সেই খাবারের গুণগানই করেছিলেন এ পর্যটক। কানাডিয়ান লেখিকা ও ভারতীয় খাবার বিশেষজ্ঞ কলিন টেইলর সেন তার ‘বাঙালি রান্নায় পর্তুগিজ প্রভাব’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস নিয়ে। পাশাপাশি ১৬ শতকে ভিনদেশী বণিকদের হাত ধরে এ অঞ্চলে প্রবেশ করা বিভিন্ন ধরনের ফলমূল-মসলা কীভাবে প্রভাবিত ও পরিবর্তন যোগ করেছে, বাঙালির নিত্য আহারে তা নিয়ে দারুণ সব তথ্য তুলে ধরেছেন তিনি। লেখিকার সে প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত অংশ—
সমুদ্রপথ ধরে এ অঞ্চলে পর্তুগিজ বণিকদের আগমনকাল ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ নাবিক বার্থোলোমিউ দিয়াজের কালিকট বন্দরের পূর্ব উপকূলের পা রাখার ৩৩ বছর পর। বাংলায় তখন মুসলিম লোদি রাজবংশের শাসনকাল, যদিও ১৫৭৬ সালে মোগলদের কাছে নিজেদের ক্ষমতা হারায় তারা। যদিও বাবরের কাছে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির পরাজয় কিংবা এ অঞ্চলে মোগলদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস দখল করে আছে অতীতের দিনপঞ্জি, তবে একই সঙ্গে রয়েছে মজার সব গল্পও। আর তা হলো বাঙালির রান্নাঘরে পর্তুগিজ খাবারের উপস্থিতি।
শুরু থেকেই বাংলা পরিচিত সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে, এর প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আর প্রতুলতা বোঝাতে বাংলাকে ডাকা হতো ‘ভারতের জন্নাত’ হিসেবে। এখানকার উন্নত বীজের ধান, সুগন্ধি চাল, উন্নত মানের তুলাসহ অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য যা কিনা উত্কর্ষের প্রতীক হয়ে দ্বার খুলে দিয়েছে বিলাসী বাণিজ্যের, তাই তো দীর্ঘকাল ধরে পোশাক আর মসলার মতো অভিজাত পণ্যের বিকিকিনির কেন্দ্র ছিল এ অঞ্চল। আর সত্তরের দশকের ঢাকার মসলিনের কদর ও কেচ্ছা দুটোই চর্চিত ইউরোপে। তবে সেসব প্রসঙ্গে না গিয়ে আজ বরং বাঙালির পাত আর পেটপূজার গল্প বলা যাক।
তত্কালীন বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়, আর এর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র বলতে চট্টগ্রাম। বর্তমানের কলকাতার প্রাচীন নাম ছিল কলিকাতা, হুগলি নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ গ্রামটি তখনো কিন্তু বসতি কিংবা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পেতে শুরু করেনি।
১৫৮০ সালে সম্রাট আকবর হুগলি নদীর তীরে পর্তুগিজদের বসতি গড়ার অনুমতি দিলে কালেক্রমে এ স্থানটি বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনাবেচার খুচরা বাজার হিসেবে বেশ পরিচিত লাভ করে। সস্তা দামে পণ্য কিনতে ভারতের পাশাপাশি চীন, মালাক্কা আর ফিলিপাইনের বণিকরা ভিড় জমাতে শুরু করেন এখানে। বিশেষ করে বাংলা থেকে অল্প মূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ।
১৬৭০ সালের দিকে বাংলায় প্রায় ২০ হাজার পর্তুগিজ অধিবাসীর বসবাস ছিল, যার মধ্যে অর্ধেকই তাদের বসতি গড়েছিল হুগলিতে আর বাকিরা থাকত সাতগাঁও, চট্টগ্রাম, বানজা, ঢাকাসহ আরো কয়েকটি স্থানে।এদের জীবনযাপন ঘিরে ছিল আভিজাত্যের উপস্থিতি। শরীরে শোভা পেত নবাবি সাজের ধোপদুরস্ত পোশাক। সেবক, বাবুর্চি থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য আলাদা লোক থাকত তাদের চারপাশে। ডজনখানেক সেবাদাসী আর চাকর রাখত পর্তুগিজরা, যাদের কাজ হতো বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন আর আচার তৈরি করা। বিশেষ করে আম, কমলা থেকে মিষ্টান্ন তৈরি করত তারা।খেতে সুস্বাদু ওই খাবার দিয়ে বাঙালির মন জয় করতে খুব একটা কালক্ষেপণ করতে হয়নি তাদের। কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালির বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর উত্সবে খাবার তালিকায় জায়গা করে নেয় ওইসব খাবার। বিশেষ করে পর্তুগিজ বেকারির রুটি, কেক আর বিভিন্ন ধরনের পেস্ট্রি; খেতে মিষ্টি আর দারুণ সব স্বাদের ওই কেক-পেস্ট্রি মুখে পুরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে ভোজনরসিক বাঙালি।
তত্কালীন ভারতের অন্য অঞ্চলের ব্রাহ্মণরা যেখানে ভাতের থালায় মাছ-মাংসের উপস্থিতিকে ধর্মনষ্ট বলে জ্ঞান করতেন, তখন কিন্তু এ অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের খাবার তালিকায় ঠিকই জায়গা পেত আমিষজাতীয় খাবার। এ অঞ্চলের মাছ-মাংসের সহজপ্রাপ্যতা এই খাদ্যভাসের অন্যতম কারণ বলেই মনে করেন কলিন টেইলর।
ভারতের অন্যান্য অংশের গোঁড়া হিন্দুরা কিন্তু আমিষের পাশাপাশি বাদ রাখতেন পেঁয়াজ, রসুন কিংবা মাশরুমজাতীয় খাবার। বাধ্যবাধকতা ছিল মাছের ক্ষেত্রেও। কী ধরনের মাছ কখন খাওয়া যাবে নিয়ম ছিল সেখানেও। তবে বাঙালি ব্রাহ্মণ বাবুরা জিভের স্বাদের সঙ্গে খুব একটা আপস করেনি।
একটু অতীতে ফেরা যাক। নবম ও দশম শতকে বাংলা সমৃদ্ধ ছিল হরেক রকমের শস্য-ফলে। এ অঞ্চলের মাটিতেই জন্মেছে ৪০ ধরনের ধান, ৬০ রকমের ফল আর ১২০ প্রজাতির বেশি শাকসবজি। এর মধ্যে ছিল শসা, গাজর, বিভিন্ন ধরনের লাউ, বেগুন, রসুন, মেথি, মুলা, মাশরুম, ইত্যাদি।
এবার আসা যাক, রান্নার উপকরণ প্রসঙ্গে। ১২ শতক পর্যন্ত বাঙালি রান্নার মসলা বলতে হলুদ, আদা, সরিষা, লং পিপার (লম্বা পিপুল), পেস্তাবাদাম, হিং আর লেবু। একসময় লং পিপারের জায়গা দখল করে নেয় কালো গোলমরিচ, পরবর্তী সময়ে আগমন সস্তা কাঁচামরিচের, যা কিনা বাংলার মাটিতেই বিস্তারলাভ করে ব্যাপক পরিসরে। মসলা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাংলায় প্রবেশ দারুচিনি, এলাচ ও লবঙ্গের।
ভাজা-পোড়া থেকে তরকারি রান্নায় নানা পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে বাঙালির হেঁসেল ঘরে। সেখানে রান্নার অন্যতম উপকরণ হয়ে এসেছে ঘি, তবে বিলাসী এ দ্রব্যটির ব্যবহার খানিকটা ব্যয়বহুল বলে এর পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে সরিষা কিংবা তিলের তেল। আর মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি এখানকার অধিবাসীর আগ্রহটা অশৈশবের।
আলু, টমেটো কিংবা কাঁচামরিচ ছাড়া কি বাঙালি কোনো খাবারের পদ কল্পনা করা যায়। রোজকার রান্নার এ উপকরণের সঙ্গে কিন্তু পর্তুগিজদের হাত ধরে বাঙালির পরিচয়। পরবর্তী সময়ে ভাতের সঙ্গে তারকারির অন্যতম উপাদান এ সবজিগুলো। মাছের ঝোলে আলুর সঙ্গে একখানা টমেটো কিংবা মসলাদার মাংসে সাদা গোলআলু ছাড়া ভোজ অসমাপ্ত বাঙালি কর্তাবাবুদের। তাই বিদেশ বিভূঁই থেকে আসা এ সবজিগুলো কখন যে হেঁসেলের তাকে জায়গা করে নিয়েছে তার খোঁজ কে রাখে!
আইরিশদের পর বিশ্বের অন্য জাতিদের মধ্যে খাবার হিসেবে আলুর কদর করে বাঙালিরাই। অন্য প্রচলিত ফল আর সবজির মধ্যে ঢেঁড়স, মিষ্টি আলু, বেগুন, পেয়ারা আর পেঁপের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় পর্তুগিজদের বরাতেই। সে সময় চীনাবাদাম বা কাজুবাদাম কখনই প্রধান খাবারের সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন ছিল না বাংলায়। তবে মহারাষ্ট্র কিংবা কেরালায় কিন্তু চীনাবাদামের সঙ্গে আলু ভাজি অথবা চিংড়ির তরকারিতে কাজুবাদাম দেয়ার প্রচলন ছিল।
মারাঠিরা আলুকে, এর পর্তুগিজ নাম ‘বাটাটা’ বলেই ডাকত। গুজরাটিরা কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে রুটি তৈরি করত কিংবা মহারাষ্ট্রে তরকারিতেও মিশিয়ে দেয়া হতো ভুট্টাদানা। কেবল বাংলাতেই এ খাবারটি ভিন্নভাবে খাওয়ার প্রচলন। ভুট্টা থেকে দানাগুলো আলাদা করে সঙ্গে একটু তেল আর কাঁচামরিচ মাখিয়ে তৈরি করা হয় এ খাবার। বেশির ভাগ সময় এ খাবারটি কেনা হতো রাস্তার পাশের বিক্রেতার কাছ থেকে।
তাই বাঙালি খাবারে পর্তুগিজ প্রভাব গভীর ও স্থায়ী। পর্তুগিজদের সুদূরপ্রসারী বাণিজ্য প্রথার হাত ধরে আফ্রিকা থেকে শুরু করে ওশেনিয়া, এশিয়ায় পৌঁছে বিভিন্ন ধরনের ফল আর সবজি। আলু, টমেটো, লংকা, ঢেঁড়স, ভুট্টা, পেঁপে, আনারস, কাজুবাদাম, চীনাবাদাম, পেয়ারা আর তামাকের সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় পর্তুগিজদের মাধ্যমে। আর বাংলায় দুধ থেকে ছানা ও দই প্রস্তুতের কৌশলটিও শিখিয়েছে ওই পর্তুগিজরা; যা কিনা পরবর্তী সময়ে বাংলার মিষ্টান্ন শিল্প বিকাশে সহায়তা করে।