টপিকঃ বার্গার এবং কৈশোরের স্মৃতিচারণ
পৌর উদ্যানের ঠিক পাশেই ক্লাব রোড, সেখানে লেটেস্ট বার্গার নামের দোকানটা চালু হয় বোধহয় ৯৭ কিংবা ৯৮ সালে... এবং আমার ছোট্ট পরিচিত গন্ডিতে ওটাই ছিলো শহরের প্রথম ফাস্ট ফুডের দোকান। শুনলাম... দুটো রুটির মাঝে খানিকটা মাংস পুরে দেয়া এক অমৃত বিক্রি হয় সেখানে, যার নাম নাকি বার্গার! স্কুলে বন্ধুদের কেউ কেউ সেই মহার্ঘ্য বার্গার খেয়ে এসে সগর্বে গল্প করতো অমৃত স্বাদের এক অভিজ্ঞতার এবং শৈশব আর কৈশোরের সন্ধিক্ষণের সেই বয়সে (আমার বয়স বোধহয় তখন বারো), জিভ লোভে যেতো ভিজে। দোকানটির সামনে দিয়ে আনমনে হেঁটে যাওয়ার ভান করতে করতেই কখনও নাকে এক অদ্ভুত অচেনা গন্ধ এসে ধাক্কা দিতো! যে খাবারটি কখনও চোখেও দেখা হয়নি, তার স্বাদ আস্বাদনের কি এক আকর্ষণ যে হতো... বোঝানোর সাধ্য কি আমার?
না... পরলোকগত আব্বার আমাকে একটা বার্গার কিনে খাওয়ানোর সাধ্য যে ছিলো না... তা বলছি না। বরং পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হিসেবে এতোটাই আদরে বড় হয়েছি... মুখ দিয়ে কথাটা উচ্চারণ করলেই বার্গার খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা সহজেই হয়ে যেতো! অথচ কেন যেন কখনও বলতে পারিনি... ইচ্ছে করেও বলতে পারিনি একটা বার্গার খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা চাই! কখনও কখনও বড়দের মতো ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিতাম ছোটবেলায়... কিংবা নিজেকে বঞ্চিত করার একটা নায়কোচিত মোহও কাজ করতো হয়তো! নিজেকে বুঝিয়েছিলাম... এই জিনিসটা খেতেই হবে, এমন কিছু তো নয়!
এখন... ৩১ বছর বয়সে এসে ফেসবুকে কিছু কিছু বন্ধুকে জোর করে মধ্যবিত্ত সাজতে দেখে হাসি পায়। তুই মধ্যবিত্ত হলে আমি তো নিম্নবিত্ত ছিলাম... আছি!
না... আমাকে কখনও মধ্যবিত্ত সাজতে হয়নি, বরং চিরটাকাল একেবারে টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত হয়েই বেঁচে থাকতে থাকতে আমি প্রাণপণে উচ্চবিত্ত সাজতে চাইতাম। স্কুলে যাওয়ার সময় দশ টাকা দেয়া হতো আমাকে... রিকশা ভাড়া। কিন্তু কোন কোনদিন টিফিনে 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ'র ডালপুরির লোভ সামলাতে না পেরে ফেরার ভাড়াটা হাপিস হয়ে যেতো। সারাদিন স্কুলের ক্লাস, ফাঁকে ফাঁকে দুরন্ত সময়টুকু কাটিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে ফিরতে দেখতাম সহপাঠীরা রিকশায় বসে ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি আঁকতে আঁকতে চলে যাচ্ছে... সে হাসিটুকু আমিও হাসতে চাইতাম। ইচ্ছেমত স্টিকার, গল্পের বই, ক্রিকেট ব্যাট, ফিলিংস কিংবা আইয়ুব বাচ্চুর ক্যাসেট কিনতে চাইতাম... একটা বার্গার খেতে চাইতাম।
তারপর... সেই বার্গার খাওয়ার সুযোগ এলো একদিন... আব্বা সেদিন ছুটি শেষে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে কেন যে বিশটা টাকার একটা নোট দিয়ে গেলেন, মনে নেই। ব্যাগের পকেটে টাকাটা রেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে স্কুলে গেলাম। ক্লাসে মন বসছিলো না... কখন টিফিন হবে! অনন্তকাল পরে টিফিনের ঘন্টাটা বাজতেই ব্যাগে হাত দিলাম... টাকাটা নেই!! পুরো ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজলাম... নেই। ইউনিফর্মের পকেটগুলো হাতড়ে দেখলাম... নেই। ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো... কিন্তু কাউকে বলতেও পারছিলাম না, কিংবা শোনার মতো কেউ পাশে ছিলো না! মনে আছে, টিংকু কিংবা রানা... আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, কি হয়েছে? আমি মাথা নাড়তেই ওরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো! অনেকক্ষণ ফাঁকা ক্লাসে থেকে নিজের সাথে যুদ্ধে হেরে জীবনে প্রথম স্কুল পালিয়ে ভাসানী হলের বারান্দায় এসে যখন বসলাম, নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। প্রখর রোদের সেই দুপুরটায়... আমার ছোট্ট কিন্তু সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শুধু কান্নাই ঝরছিলো! একটা বার্গার খেতে না পেরে যে অতৃপ্তি... তার কান্না!
পরিশিষ্টঃ আমার আস্তানার ঠিক সামনেই আমেরিকান বার্গারের একটা শাখা খুলেছে সম্প্রতি। আজ দুপুরের খাবারটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুটো বিস্কুট আর কফিতে লাঞ্চের ঝামেলাটা সেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় ক্ষুধায় বাসা পর্যন্ত যাওয়ার তর সইছিলো না। একটা ভেজিটেবল বার্গার আর কোক কিনে কোনের একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। যখন কামড় বসাতে যাবো, চলচ্ছবির মতো আঠারো-উনিশ বছর আগের সেই সময়টা চলে এলো চোখের সামনে! শৈশব আর কৈশোরের সন্ধিক্ষণের যে আমি... তার জন্যে ভীষণ মায়া হচ্ছিলো! নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো... সে পানির ফোঁটাটা টপ করে পরলো মুখের সামনে ধরে রাখা বার্গারে! টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে বার্গারটা মুখে দিলাম... তেতো লাগলো! আচ্ছা... এরা কি লবন বেশি দিয়েছে? নাকি এক ফোঁটা চোখের জল একটা বার্গার তেতো বানিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট??
যদি না আসো... সুস্বাগতম!!