টপিকঃ ছোট্ট জীবনে ভ্রমণ করা স্থানগুলো (পর্ব-৭)
দেশের শত শত ভাস্কর্যের মেলায় স্বমহিমায় ভাস্বর, স্বাধীনতার চেতনা বহনকারী, আর্টিকস্টিক,বাঙালী জাতীয়তার পরিচয় বহনকারী যে ভাস্কর্যটির নাম সর্বাগ্রে তা হল জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
গতবছরের ভ্রমণের সুখস্মৃতি মনে আজও উজ্জ্বল,আর সৌভাগ্যটাও এমন যে, একই দিনে রোদ-বৃষ্টির খেলায় উপভোগ করেছি স্মৃতিসৌধের দ্বিরূপী সাজ।
সাভার শহর থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সটিকে বলা যায় এক সাজানো বাগান।স্মৃতিসৌধটা এমনভাবে তৈরি যেন সামনে পেছনে পূর্বে পশ্চিমে ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমায় দেখা যায়, কিন্তু আবার একইদিক থেকে যেন তাকে বিভিন্নভাবে সুন্দর লাগে।যেমন সৌধের সামনে আছে একটি স্বচ্ছ পানির লেক, পুরো স্মৃতিসৌধের ছায়া পড়ে সেখানে।
আর একটু হেঁটে যদি বা পাশে দু পা ঝাউগাছে ঘেরা প্রাঙ্গনের কাছে যান,তো দেখবেন স্মৃতিসৌধকে একই রকম দেখাচ্ছে,কিন্তু শুধু দৃশ্যপট টা পাল্টে গেছে।এ এক বড়ই অপূর্ব শিল্প।তখন দেখা যাবে স্তম্ভটি যেন একইরকম আছে,শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডটা পাল্টে গেছে।
এবার যদি পূর্ব বা পশ্চিম পাশে যান, দেখা যাবে সাতটি মিনার এর আর্কিটেক্টটা কিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারবেন, চাইলে হাতে এক একটি স্তম্ভ গুনতেও পারবেন।প্রত্যেকটি স্তম্ভকে দেখা যাবে আলাদা আলাদা ভাবে। তখন আবার মনে হবে,সামনে থেকে স্মৃতিসৌধকে যেরকম দেখলাম,পেছনে এসে হুট করে এমন পাল্টে গেল কেন?
পুরো কমপ্লেক্স এর মেঝেটা নির্মান করা হয়েছে লাল ইটে, মাঝে মাঝে সাদা রঙের নকশা, একটু ঢাল কোথাও, কোথাও আবার একটু নিচু। একটু বাঁকা করে ক্যামেরা ধরলেই স্ক্রিনে চলে আসবে সারি সারি ঝাউ গাছ, তখন ক্যামেরার দিকে তাকাবেন আর অবাক হবেন, একটু আগে এত সুন্দর একটা জায়গা দিয়ে হেঁটে আসলেন, বুঝতেই পারবেন না।অথচ ক্যামেরার লেন্সে পুরোটা জায়গা সুন্দরমত ক্যামেরাবন্দি করতে পারবেন,স্মৃতিসৌধের বিশেষত্বটা এখানেই।
সৌধের কমপ্লেক্সটির প্রাচীরের বাইরের দিকটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। সেখানে অসংখ্য বৃক্ষ লাগিয়ে ছোটখাট একটা ঘন বন তৈরি করা হয়েছে,সবুজে সবুজময়। যে সবুজ রাজ্যের ডানপাশেই আছে মেঠোপথের মতো এক ইটের রাস্তা। রাস্তার ডানে অপূর্ব সুন্দর একটা লেক। লেকের চারিদিকে বড় বড় গাছ, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা ব্রীজ। আর তীরে লাগানো হয়েছে অ্যালমান্ডা গাছ তাতে ধরে আছে ছোট ছোট সব হলুদ ফুল। বড়ই অপূর্ব সে সৌন্দর্য।
অনেকক্ষণ ঘোরাফিরার পর স্মৃতিসৌধ মসজিদটা এক ঝলক দেখে রওনা দিবো ঠিক করলাম।মসজিদে যাবার পথের রাস্তাটা খুব সুন্দর।সারি সারি গাছ। হাঁটতে হাঁটতে মেঘলা আকাশে হানা দিলো জোর বৃষ্টি।সামনে দাঁড়াবার মত একটা জায়গা পেলাম।প্রায় আধ ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামল। তাতে ঘাসময় স্থানগুলো হয়ে উঠল আরো সবুজ ও প্রাণবন্ত।
মসজিদটাও খুব সুন্দর।ছোটখাট একটা কার্জন হল বলা যেতে পারে আর্কিটেকচারালি।দৃশ্যপট আর গাঢ় লাল রংটায় ওরকম একটা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
যাবার বেলা হয়ে গেছে। দূর থেকে শেষবারের মত
একবার চোখ ফেললাম স্মৃতির মিনারের উপর। এবার পেছন ফিরে বিদায় নেবার পালা। এবার যাবার উদ্দেশ্যে গেটের দিকে মুখ ফিরেছি। তো ফুটে উঠলো আরে কত সুন্দর একটা পথ দিয়েই না প্রবেশ করেছিলাম কিছুক্ষণ আগে!বৃষ্টিস্নাত হয়ে প্রকৃতি সেই সৌন্দর্যকে করেছে আরও একটু সতেজ।
সবমিলে তাৎপর্যের পাশাপাশি এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা আমাদের এ জাতীয় স্মৃতিসৌধ।পরিচ্ছন্নতা,চেতনা,প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,স্থাপত্যশিল্প ও বীরত্বের এক প্রতীক।
স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি আমাদের ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিকদের স্মারক ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও যাবার সৌভাগ্য হয়েছে।(নিম্নের ছবিসমূহ সংগৃহীত) তবে সে স্মৃতি বহু বছর আগের। ২০০৪ সালে।
দিনটি ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারিই।বাসা থেকে ভোর ৬টায় রওনা দিই।তবু ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন বলে কথা।এক ঘন্টার পথ আড়াই ঘণ্টায় পেরিয়ে কোনোমতে দাঁড়ানোর একটু জায়গা মেলে শহীদ মিনার চত্বরে।এক কোণায় দাঁড়িয়ে মোটামুটি চোখের দেখায় দেখে নিলাম।অত:পর ধীরে ধীরে গুটি গুটি পা করে এগোতে এগোতে খুব সামনে থেকে দেখে নিলাম শহীদ মিনার প্রাঙ্গনটিকে।সেই সাখে খালি পায়ে অর্পন করলাম পুষ্পার্ঘ্য। প্রবেশ পথটি পুরোটা লাল সাদা আলপনা দিয়ে অাঁকা হয়েছে।বেদি পেরিয়ে পুরো রাস্তাটুকোও ফুলের কমলা রঙে বর্ণিল হয়ে গেছে।তারপর চারপাশটা একটু ঘুরে দেখতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল।তবে স্মৃতিসৌধের মত এত বড় কমপ্লেক্স নয় শহীদ মিনার, এখানে মিনারটিই মুখ্য এবং চৌম্বক অংশ।
ঠিকমত হাঁটতেও পারলাম না। লোকে লোকারণ্য। নড়ার মত জায়গা নেই।ওতেই সন্তুষ্ট হয়ে বাবার সাথে বাসা থেকে আনা খাবারে দুপুরের খাবার সেরে রওনা দিলাম বইমেলার উদ্দেশ্যে।সেখানেও একই চিত্র।বরং ভিড় বোধহয় একটু বেশি।সবাই বই দেখছে।কেউ স্টল ঘুরে দেখছে। কেউ কিনছে।এমন একটা জায়গায় গেলে বই দেখলেই কিনতে ইচ্ছা করে! কত রকমের কত বিষয়ের বই আছে একেকটা স্টলে তার ইয়ত্তা নেই।বিশেষ করে ছোটদের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে।বড়রাও বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! তাদের পছন্দমতও আছে বইয়ের সমাহার। ইচ্ছে করেছিলো সামনে যে বই পাই সেটাই কিনি।কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। প্রায় সবগুলো স্টল ঘুরলাম। বিভিন্ন স্টল থেকে চারটা বই কিনলাম। দুপুরের সময় হওয়াতে কিছু কিছু স্টলে লোক সমাগম একটু স্তিমিত ছিল।আমারও ঘুরে দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে।যখন বের হচ্ছি, দেখি পিঁপড়ের মত লোক ঢুকছে।বেরোচ্ছেও।এর যেন কোন শেষ নেই। আমাদের মাতৃভাষার প্রতি টান থেকেই যেন বইয়ের প্রতি এই ভালবাসা এক জন্মগত নেশা।হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে।মুখে তবুও হাসি আর আনন্দ। এ হাসি আসে মন থেকে।অবশেষে বাড়ির পথ ধরলাম আজীবন মনে রাখার মত এক স্মৃতি নিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারি,২০০৪ এর সেই রৌদ্রজ্জ্বল দিনে।
বেঁচে থাকুক বাংলা ভাষা।বইয়ের অক্ষরগুলো চিরন্তন হোক।আর যুগ যুগ ধরে লালিত হোক গর্বের স্বাধীনতার চেতনা এসব স্মৃতিফলককে ঘিরে।