টপিকঃ গহীন বান্দরবান: পর্ব-১১
পর্ব-১১ঃ অমিয়খুম/আমিয়াখুম
অনেক পাহাড় পর্বত পার হয়ে অবশেষে আমরা অমিয়খুম পোঁছালাম, বান্দরবানের একদম গহীনের ওয়াটারফল গুলোর মধ্যে অমিয়খুম একটা। এখানে আসার জন্য এত ভয়ংকর রাস্তা পার হতে হয়েছে চিন্তা করতেই রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। অমিয়খুম এক নয়নভিরাম জায়গা, পাথরে ভরপুর চারিদিক, একপাশে প্রচন্ড গতিতে পানি পড়ছে। আর চারপাশে পাহাড়, সবুজ আর সবুজ।
এখন তেমন ভারী বৃষ্টি হয়না বলে ঝর্নায় পানি কম, বর্ষাকালে এ ঝর্না এত ভয়ংকর থাকে যে এখানে তখন কেউই আসতে পারেনা। যেখানটায় ঝর্না শুরু হয়েছে তার একটু পরেই সরু হয়ে আছে আর সেখানে বেশ বড় বড় পাথর। পানির পরিমান কম থাকায় পাথর গুলোর পাশ দিয়ে পানির স্রোত বয়ে গেছে।
অমিয়খুম চলে এসেছি
অমিয়খুম ঝর্না
ঝর্নার এপাশ থেকে
অমিয়খুম ঝর্নার পেছনে একদম খাড়া একটা পাহাড় আছে, পাহাড়টা এত উঁচু যে আমার ক্যামেরায় ঝর্না সহ পুরো পাহাড় আসছিল না। পাহাড়ের গায়ে লতা পাতা ঝোপ ঝুলছে, আর মাঝে মাঝে পানি পড়ার দাগের মত তৈরী হয়ে রয়েছে। গাইড বললো বর্ষাকালে পাহাড়ের গা বেয়ে প্রচন্ড গতিতে পানি নিচে পড়ে, এখন পানি নেই বলে দাগ গুলো দেখা যাচ্ছে। আর এ পানি পড়ার শব্দ তখন অনেক দূর থেকে শোনা যায়। উপরের ছবিতে যে পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে, বর্ষাকালে এগুলো সব পানির নিচে থাকে। সেসময় পানির স্রোতের যে কি অবস্থা হয় তাই চিন্তা করছি!
ছবিতে দেখে মনে হচ্ছে শান্ত পানির স্রোত, আসলে অনেক ভয়ংকর আর তীব্র
পানি অল্প থাকায় ভাবছিলাম গোসল করে নিব কিনা, কিন্তু পানির নিচের পাথরগুল অনেক পিচ্ছিল আর পানির স্রোত বেশি (পানিতে পা না দেয়া পর্যন্ত্য বোঝা যায়না এত অল্প পানিতে কি করে এত স্রোত হতে পারে) যে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকা যায়না, আমরা খালি জায়গা দেখে পানির বোতল ভরে নিলাম। আর ভাল করে হাত পা পানিতে ভিজিয়ে নিলাম।
পেছনের খাড়া পাহাড় থেকেই অমিয়খুম ঝর্নার উৎপত্তি
অমিয়খুম ঝর্নার পানি যেখান দিয়ে বয়ে গেছে, সে রাস্তা দিয়ে আরেক জায়গায় যাওয়া যায় সেটার নাম হলো সাতভাইখুম। সেখানে যেতে হলে ভেলায় করে যেতে হবে। গাইড বললো আমাদের ভাগ্য যদি ভালো হয় তাহলে অনেকের রেখে যাওয়া ভেলা পাওয়া যেতে পারে, আর না থাকলে নতুন করে ভেলা বানাতে হবে।
আমাদের ভাগ্য খারাপ, কোন ভেলা পাওয়া গেল না। নতুন করে বাঁশ কেটে ভেলা বানাতে গেলে আর তিন চার ঘন্টা সময় লাগবে। আর ভেলা বানানোর মত জোগাড়যন্ত্র আমাদের কাছে নেই। তাই সাতভাইখুম যাবার চিন্তা বাদ দিতে হলো। আগের রাস্তা ধরেই আমরা ফিরে যাব।
ফিরে যাবাটা এত ভয়ংকর হবে ভাবতে পারিনি। সেই একরকম খাড়া পাহাড় পার হতে আগের চাইতে আরো বেশি কষ্ট হচ্ছিল। পুরো শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ফিরে যাবার এক পর্যায়ে আমরা সবাই না পেরে পাহাড়ের উপর সবাই লম্বা হয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম, আর পারছিলাম না সামনে এগুতে। গাইডতো আমাদের অবস্থা দেখে হেসে একাকার! কি যে একটা সময় পার করেছিলাম তখন। মনে মনে ভাবছিলাম, আর কখনোই গহীন বান্দরবানে আসার নামও মুখে আনবোনা। এ রকম অবস্থায় ছবি তোলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
অতিরাম পাড়াতে এসে আমরা বেশ খানিকক্ষন বিশ্রাম নিয়েছিলাম। পাড়ার লোকজনের কাছ থেকে পেয়ারা কিনে খেয়েছি। আর ঐ যে বয়স্ক লোকটা ছিল যে আমাদের বন্ধুরা বন্ধুরা বলেছিল, তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তার কিছু সাহায্য দরকার। তাকে দুইশ টাকা দিয়েছিলাম, টাকাটা হাতে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল, মানুষের চাওয়া যখন অল্প থাকে তখন অল্প পরিমান পাওয়া যেন পাহাড়সম আনন্দ নিয়ে আসে। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে চাওয়া পাওয়া এত বেশি যে এরকম ছোট ছোট আনন্দ থেকে আমরা বঞ্ছিত।
চলবে...