টপিকঃ "ঢাকা - সেন্ট মার্টিন - কক্সবাজার - ঢাকা" - পর্ব ২
পর্ব ২-
আশেপাশে তাকালাম। ঠিকই তো আছে, ফকিরাপুল শ্যামলী কাউন্টার। চোখের দেখাতে কোন ভুল নেই। আবার ফোন দিলাম নওশাদ কে। আমি কিছু বলার আগেই নওশাদ বলে উঠলো -
- কি রে, তোর গাড়ী খুঁজে পেতে এতক্ষন লাগে নাকি!
- আমিতো সবার সামনের গাড়ির পাশে দাঁড়ায়ে আছি, কিন্তু তোদেরকে তো আশে পাশে দেখতেছি না।
- তুই কোথায় আসছিস?
- কেন! ফকিরাপুল।
- ধুর ছাগল। ফকিরাপুল কেন? গাড়ী ছাড়বে তো আরামবাগ থেকে। আমরা এখানেই আছি। তাড়াতাড়ি আয়।
- তাই নাকি! তুই একটু ড্রাইভার কে ম্যানেজ কর, আমি এখনি আসছি।
আমি ভুল করি নাই, ঠিক জায়গাতেই আসছি। কাউন্টার এর সামনে কিছু ছোট গাড়ীতে সাতটার বাসের যাত্রীদেরকে আরামবাগ নিয়ে যাচ্ছে। আমি একটাতে উঠে পড়লাম।
ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সোয়া সাতটা। ঠিক সামনের সারির বাসে ওদেরকে পেলাম। জানতে পারলাম, আমাদের জন্য বরাদ্দ গাড়ীটা এ রুটের নিয়মিত বাস না। একটা অফিস থেকে অনেকজন লোক একসাথে পুরো গাড়ীর ম্যাক্সিমাম টিকেট কাটার কারনে তাদের জন্য আলাদা বাসের এরেঞ্জ করা হয়েছে আর আমার মত কয়েজন বাসের শেষের সিটগুলো দখল করেছে। ওই গ্রুপের একজন লোক এখনো আসে নি, তাই গাড়ী ছাড়তে আরো একটু দেরী হবে। অনান্য বাসগুলো এক এক করে ছেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের বাস ছাড়ার কোন নামগন্ধ নেই। এই বাস ধরার জন্য এত কাহিনী করে আসলাম আর এখন বাস আরেক জনের জন্য ওয়েট করতেছে। কি দরকার ছিল এত তাড়াহুড়া করার, ধীরে সুস্থে আসলেই তো পারতাম।
অবশেষে সাতটা চল্লিশের দিকে আমাদের অধীর অপেক্ষার অবসান ঘটলো। বাসের বাকী যাত্রী এসে পৌঁছেছেন। সবাই গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথে বাস ছেড়ে দিল। গন্তব্য টেকনাফ, সেখান থেকে সেন্ট মার্টিন।
আজ এমনিতেই রাস্তায় জ্যাম বেশি হবে। তার ওপর টেকনাফে জাহাজ ছাড়ার সময় ফিক্সড। গাড়ী ছাড়তেও দেরী হয়েছে, সবকিছু বিবেচনা করে দেখা গেলো, টেকনাফের জাহাজ মিস হবার সম্ভাবনা প্রবল। আমি এখানে আসার আগে মনে হয়েছিল বাস মিস হবে, আর এখানে আসার পর মনে হচ্ছে জাহাজ মিস হবে। কি অদ্ভুত!
গাড়ীর কন্ডাকটরের সাথে কথা বলে দেখলাম, তারাও স্বীকার করলো যে জাহাজ মিস হবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে কিন্তু রাস্তায় খুব বেশি জ্যাম না থাকলে সময়মত পৌঁছানো যাবে। কাল ছুটি, তাই আজ রাস্তায় জ্যাম থাকবে না, এটা ধরে না নেয়াটাই ভালো।
আমাদের গ্রুপের বাকী তিনজনের সাথে আলাপ করে দেখলাম, যদি কোন কারনে বাস মিস হয়ে যায় তাহলে ট্রলার দিয়ে যাওয়া যায় কিনা! একজন পুরো না করে দিল, প্রয়োজনে একদিন টেকনাফে থাকব, পরের দিন সকালে সেন্টমার্টিন যাব। বাকী দুইজন তেমন আগ্রহ দেখালো না। অবশেষে আমরা সময়ের হাতেই সব কিছু ছেড়ে দিলাম, আগে টেকনাফ পৌঁছে নেই, তারপর দেখা যাবে।
রাতের অন্ধকারে গাড়ী চলছে। সারাদিন এত ধকল যাবার পর শরীর অনেক ক্লান্ত। বাসের সিট নিচু করে হেলান দিয়ে গা এলিয়ে দিলাম। বাসের ভেতরে লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে, যাত্রীরা মোটামুটি সবাই গভীর ঘুমে। রাস্তায় প্রচুর পরিমাণে গাড়ী, কিন্তু গাড়ী চলছে বেশ ভালো স্পিডে। কিছুক্ষণ পরপর ড্রাইভার হার্ডব্রেক করছে আর আমার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ড্রাইভার কে ফর্মুলা ওয়ান এর রেসে পাঠিয়ে দিলে ভালো করতো। আমি এমনিতেই একটু ভীতু প্রকৃতির, রাতের জার্নি আমার জন্য কখনোই সুখকর হয়না।
ঢাকা টু চট্টগ্রাম এর রাস্তার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো মনে হলো না, আবার বাসের পেছনের সিটে বসার কারনে ঝাঁকুনী কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। সবচাইতে বাজে রাস্তা মনে হল কক্সবাজার টু টেকনাফ এর রাস্তা। মারাত্মক ধরনের এবড়ে থেবড়ে। আমাদের আবার সকালে সময়মত টেকনাফে পৌঁছাতে হবে, তাই ড্রাইভার কোনকিছুর পরোয়া করছে না। গাড়ী চলছে ফুল স্পিডে আর আমরা পেছনের যাত্রীরা কিছুক্ষণ পরপরই প্রবল ঝাঁকুনীতে সিট থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছি। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।
অবশেষে আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা জাহাজ ছাড়ার মিনিট পনেরো আগেই টেকনাফে এসে পৌঁছালাম। ক্ষুধায় তখন সবার একবারে কাহিল অবস্থা। তড়িঘড়ি করে বে ক্রুজ এর টিকিট কাটলাম। এই জাহাজ নাকি সবার আগে সেন্ট মার্টিন পৌঁছায়। বাস স্ট্যান্ড এর পাশে বড় কোন হোটেল দেখলাম না, ছোট একটা টং এর মত দোকান আছে, ওখানেই খাবার খাওয়ার জন্য বসলাম। সে এক আজব পরিবেশ, সবাই পরোটা ডিম ভাজির অর্ডার দিয়ে বসে আছে, কিন্তু খাবার দেয়ার কোন নাম নেই। এখানে বসে থাকার সময়ও নেই, চিল্লাপাল্লা করে কয়েকটা পরোটা জোগাড় করে সবাই মিলে খেয়ে নিলাম। সেন্ট মার্টিন গিয়ে ইচ্ছেমতো খাওয়া যাবে।
জাহাজঃ বে ক্রুজ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড
জাহাজ নয়টার সময় ছাড়ার কথা থাকলেও তা ছাড়লো সাড়ে নয়টার সময়। আগের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পুরো ট্যুর এ ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করবো। এজন্য বে ক্রুজ এ একটা এসি সিটিং টিকেট আর বাকী তিনটা স্ট্যান্ডিং টিকেট কাটলাম। কিন্তু জাহাজের ভেতরে গিয়ে দেখলাম যারা স্ট্যান্ডিং টিকেটের যাত্রীদের দাঁড়ানোর জায়গায় কোন ছাউনী দেয়া নেই, বাইরে যে পরিমান রোদ, পরবর্তী দুই ঘন্টায় পুরো সিদ্ধ হয়ে যাব। টিকেট যখন কেটে ফেলেছি, তখন তো আর করার কিছু নেই। তবে পুরো জাহাজটি অনেক সুন্দর করে বানানো। যাত্রার একপর্যায়ে জাহাজের মালিকের সাথে কথা হলো। তিনি অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, থাকেন টেকনাফে। জাহাজটি আনিয়েছেন জাপান থেকে। কোন এক সম্পদশালী জাপানীর ব্যাক্তিগত জাহাজ ছিল এটা। তিনি তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে নতুন করে সাজিয়েছেন। সাধারণত পিক সিজনে জাহাজটি টেকনাফ টু সেন্টমার্টিন রুটে চলাচল করে, বাকী সময়টা অন্যান্য রুটে চালানো হয়। গতবার অফসিজনে নাকি এটি ঢাকা টু বরিশাল রুটে চলাচল করছিল।
আমাদের বেশ আগেই অন্যান্য জাহাজ ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু জাহাজের মালিকের কথামতে সবার পরে রওনা দেয়া সত্ত্বেও আমাদের জাহাজটি সবার আগে সেন্ট মার্টিন গিয়ে পৌঁছাবে। যদি জাহাজকে নাকি ফুল স্পিডে চালানো হয়না। যদি ফুল স্পিডে চালানো হতো তাহলে টেকনাফ টু সেন্ট মার্টিন ঘন্টাখানিকের মধ্যেই পৌঁছানো যেত।
প্রশ্ন করলাম, জাহাজ ফুল স্পিডে চালান না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, ফুল স্পিডে চললে সাগরে বড় ধরনের ঢেউ তৈরী হয়, আর সেই ঢেউগুলো সজোরে আঘাত হানে তীরবর্তী এলাকায় যেটা তীর ভাঙ্গনে সহায়ক। অপরদিকে যাত্রার পুরো সময় জাহাজের আশেপাশে প্রচুর পরিমানে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকা থাকে, বড় বড় ঢেউ এ নৌকাগুলো উল্টে যাবার একটা সম্ভাবনাও থেকে যায়। এসব দিক বিবেচনা করেই জাহাজের স্পিড কখনোই সর্বোচ্চ করা হয়না।
তবে জাহাজের মালিক যাত্রীদের অতিরিক্ত অপরিচ্ছন্নতায় পুরোপুরি বিরক্ত। উনি যতই চেষ্টা করে জাহাজকে পরিচ্ছন রাখতে চেষ্টা করেন, যাত্রীদের খামখেয়ালীর কারনে বেশিরভাগ সময়েই সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। ব্যাপারটা আমার কাছে সত্যি মনে হল, আমরা জাতিগত ভাবেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে উদাসীন। সাধারন পরিস্থিতিতেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ধারধারি না, আর আনন্দ ফুর্তি করতে গেলে তো কথাই নেই, অপরিচ্ছন্নতার কোন ওয়ার্ল্ড রেকর্ড থাকলে আমরাই চ্যাম্পিয়ন হব।
জাহাজ থেকে তোলা নৌকার ছবি
সেদিন ছিল ২৬শে মার্চ। সরকারী ভাবে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে সকাল ১১ টায় লাখো কন্ঠে সোনার বাংলা অনুষ্ঠান হবার কথা। জাহাজের মালিক কন্ট্রোল রুম থেকে মাইকে ঘোষনা দিলেন জাহাজে থেকেই ঠিক একই সময়ে আমরাও সমবেত কন্ঠে সোনার বাংলা গাইবো। আগ্রহীরা যেন সবাই জাহাজের কন্ট্রোলরুমে চলে আসি। আমি পাশেই দাড়িঁয়ে ছিলাম, ঘোষনা আসতেই কন্ট্রোলরুমের ভেতর ঢুকে গেলাম। ১১টা বাজতে তখনো ১০ মিনিটের মত বাকী ছিল। এই সময়টাতে সবাই মিলে একসাথে জাতীয় সংগীত গেয়ে একবার ট্রায়াল দিয়ে নিলাম। ট্রায়াল দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, কারোই জাতীয় সংগীত পুরো মনে নেই, শেষ কবে জাতীয় সংগীত গেয়েছিলাম মনে করতে পারছিলাম না। একবার ট্রায়াল দেয়াতে ভালোই হলো।
জাহাজের কন্ট্রোল রুম থেকে তোলা ছবি, জাতীয় সংগীত গাওয়ার ঠিক আগের মুহুর্ত
অবশেষে ঠিক এগারোটার সময় সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গাইলাম, একেবারে গলা ছেড়ে গাইলাম। পুরো জাহাজের যাত্রীরা তখন দাঁডিয়ে জাতীয় সংগীত গাইছে, সে এক অন্যরকম পরিবেশ, অন্যরকম অনুভুতি। (চলবে...)
জাতীয় পতাকা, জাহাজের ডেক থেকে তোলা