টপিকঃ ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন ৪: British Airways Flight 5390
১০ জুন, ১৯৯০।
বৃটিশ এয়ারওয়েজ এর একটি বিএসি ১-১১ প্লেন স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এয়ারজার্নিতে বৃটিশ এয়ারওয়েজের মোটামুটি ভালই সুনাম আছে। কিন্তু এই যাত্রায় ভাগ্য একই সাথে তাদের প্রতিকূল এবং অনুকূলে।
বিএসি ১-১১ প্লেনটি ঠিক আগেরদিনই রেগুলার সার্ভিসিং থেকে এসে ফ্লাইটে যোগ দিয়েছে। কিছু যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করা হয়েছে মূলত। সন্ধ্যা ৭:২০ মিনিটে ৮১ জন প্যাসেঞ্জার নিয়ে আকাশে উড়ে প্লেনটি। Co-pilot Atchison রুটিন টেকঅফ করার পর কন্ট্রোল হ্যান্ডওভার করে দেন Tim Lancaster এর কাছে। ক্র্যুজ লেভেলে আসার পর তারা একটু রিলাক্সড হয়ে হালকা কিছু খাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছিলেন। প্লেন তখন ১৭০০০ ফিট উচ্চতায়। সময় ৭:৩৩ মিনিট।
প্লেনের ক্যাপ্টেন তার সিটে অর্থাৎ বামপাশের সিটে বসে ছিলেন। হঠাৎ করে ভয়ংকর একটা বিস্ফোরনে তার সামনের উইনশিল্ড ছিটকে বের হয়ে গেল, কিছু বুঝে উঠার আগে ছিটকে বের হয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন নিজেও। পুরো প্লেন মূহুর্তে কুয়াশায় ঢেকে গেল। প্লেনের গতি তখন প্রায় ৩৫০ মাইল ঘন্টায়, উচ্চতা ১৭,০০০ ফিট।
ক্যাপ্টেন যে পুরোপুরি ছিটকে বের হয়ে গেছেন তাও নয়, বিস্ফোরনে আগে তার মাথা বের হয়ে গিয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে তার পা আটকে যায় ভিতরেই। কাজেই তিনি পুরোপুরি ডিটাচড হয়ে যান নি। কিন্তু ১৭,০০০ ফিট উচ্চতা এবং প্রচন্ডগতি কোনটাই তার জন্য মঙ্গলজনক ছিল না।
১৭০০০ ফিট উচ্চতায় বলাবাহুল্য অক্সিজেনের পরিমান খুবই কম। কাজেই ক্যাপ্টেন শ্বাষপ্রশ্বাসের সমস্যায় পড়ে গেলেন কিছুক্ষনের মধ্যেই। তাছাড়া সর্বপ্রথমে তিনি যে সমস্যাটিতে পড়েছিলেন সেটি হচ্ছে আঘাত্। প্রায় ৩৫০ মাইল গতিতে চলা একটি প্লেনের উপড়ে আছড়ে পড়াটা রীতিমত বিপদজনক। আর তার সাথে আরেকটি ফ্যাক্টর, তাপমাত্রা। ১৭ হাজার ফিট উচ্চতায় তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ সেলসিয়াস। বেচে থাকার কোন সম্ভাবনাই নেই ক্যাপ্টেনের আর।
এদিকে, পুরো প্লেন নিয়ন্ত্রন হারিয়ে নীচে ডাইভ করতে শুরু করেছে। কো পাইলট ক্যাপ্টেনের দিকে না তাকিয়ে প্লেন বাচাতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। কিন্তু ভাগ্য পুনরায় প্রতিকূল। ক্যাপ্টেনের পা আটকে গেছিল স্টিয়ারিং এ। কাজেই কন্ট্রোল করতে গিয়ে বিশাল ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। প্লেন ক্রমাগতই উচ্চতা হারাতে শুরু করলো এবার।
ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট এগিয়ে এলেন এবার সাহায্যে। উনি পাইলটের বেল্ট ঝাপটে ধরে চেষ্টা করছিলেন পাইলটকে ভিতরে নিয়ে আসতে কিন্তু সেটি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়ালো। কিছুক্ষন পরে আরো একজন ক্রু এসে তাদের সাহায্য করার চেষ্টা চালালেন। ততক্ষনে ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট এর ডান হাত আর চোখের কিছুটা ফ্রস্ট এফেক্টেড হয়ে ঝলসে গেছে। কিন্তু আরো বড় সমস্যা তখনো তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
কো পাইলট এ্যটিসন, আগে কখনোই এমন ঝামেলায় পড়েন নি, উপরন্তু ককপিটের জানালা খোলা থাকায় প্রচন্ড শব্দে তিনি কন্ট্রোল টাওয়ারের কোন রেসপন্সই শুনতে পেলেন না। যতটুকু সম্ভব তিনি শুধু জানিয়েই গেলেন প্রথমদিকটাতে।
উচ্চতা খানিকটা কমে এলে, স্টিয়ারিং গিয়ার থেকে পা সরানোর পর মোটামুটি একটা নিয়ন্ত্রনে আনার পর প্রথমবারের মত এ্যাটিসন কনসেনট্রেট করলেন রেডিওতে। সার্বিক অবস্থা জানানোর পরে ইমার্জেন্সী ল্যান্ডিং এর জন্য জানালেন নিকটস্থ এয়ারপোর্টে।
এদিকে ক্যাপ্টেন তখন উপর থেকে বাম পাশের জানালায় এসে পড়েছেন, জানালা দিয়ে তার চেহারা দেখা যাচ্ছিল। সবাই দেখলো তার দুচোখ খোলা, কিন্তু তার চোখ বন্ধ হচ্ছে না। সবাই ধরে নিলেন ক্যাপ্টেন মারা গিয়েছেন। ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট জানতে চাইলেন মৃত ক্যাপ্টেনকে তিনি ছেড়ে দেবেন কিনা। কারন তাকে এভাবে ধরে রেখে আক্ষরিক অর্থে কোন লাভ হচ্ছে না। বিচক্ষন এ্যাটিসন নাকচ করে দিলেন সেই সিদ্ধান্ত। ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে দিলে তার দেহ ইঞ্জিন বা উইং যে কোনটিকে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে, পরিনতি হতে পারে ভয়াবহ। কাজেই ল্যান্ড না করা পর্যন্ত তিনি তাকে ধরে রাখার জন্যই বললেন।
শেষমেষ অনভিজ্ঞ এ্যাটিসন সাউদাম্পটন এয়ারপোর্টে সেফলিই ল্যান্ড করাতে পারলেন প্লেনটিকে। বেচে গেলেন সব যাত্রী, ক্রু এবং কো পাইলট। চোখের সামনে ক্যাপ্টেনের পরিনতি দেখে ভেঙে পড়লেন এ্যাটিসন।
এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর সেফলি সবাইকে নিয়ে ল্যান্ড করতে পারাটা নিঃসন্দেহে ভাগ্যের ব্যাপার। তবে ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ক্যাপ্টেনকে যখন এ্যাম্বুলেন্সের বেডে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঠিক তখন চোখ মেলে তাকান ক্যাপ্টেন। তিনি তখনও বেচে আছেন। ১৭০০০ হাজার ফিট উচ্চতায় ৩৫০ মাইল বেগে ধেয়ে যাওয়া প্লেনের উপর আছড়ে পরে ফ্রস্টবাইট এবং অক্সিজেনসল্পতায় ভুগেও বেচে গেলেন ক্যাপ্টেন। এতবড় টুইস্টের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না, তবে ফ্লাইট ক্রু, পাইলটদের জন্য এর থেকে আনন্দের কিছুও ছিল না।
ক্যাপ্টেন ল্যানকাস্টার অবশ্য ৫ মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে পুনরায় ফ্লাইটে জয়েন করেন। এবং বছরখানেক পরে ৫৫ বছর বয়সে বাধ্যতামূলক অবসরে যান। পরবর্তীতে অবশ্য তিনি অন্য একটি এয়ারলাইনারের হয়ে কাজ করেন।
সবাই বেচে গেলেও প্রশ্ন থেকে গেল, এরকম একটি দূ্রঘটনা কিভাবে ঘটলো। একের পর এক ঘটনা মিলিয়ে অবশেষে দেখা পাওয়া গেল মূল সমস্যাটির।
সাধারনত প্লেনের জানালা বা উইনশিল্ড ভিতর দিয়ে লাগানো থাকে। ১৭০০০ হাজার বা অনেক উচুতে বাইরের বায়ুর চাপ অনেক কম থাকে এবং ভিতরে স্বাভাবিকভাবেই বেশী চাপ থাকে সমতলের সমান চাপ বজায় রাখার জন্য। কিন্তু বিএসি ১-১১ প্লেনটির ডিজাইন অন্যরকম, এর উইনশিল্ড লাগানো হয় বাইরে থেকে অনেকগুলো স্ক্রু দিয়ে। কাজেই বাড়তি চাপ পড়লে সেটি খুলে যাবে এবং ভিতরের প্রচন্ড চাপে ছিটকে সেটি বাইরে চলে যাবে। কিন্তু সাধারনত সেটি হয় না, হওয়ার কথাও নয়। তাহলে কি সমস্যা ছিল ?
ইনভেস্টিগেটররা চেক করে দেখলেন ফ্লাইট টেক অফ করার ২৭ ঘন্টা আগে প্লেনটির উইনশিল্ড পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ইঞ্জিনিয়ার প্লেনের স্ক্রুগুলো ভুল লাগিয়েছিলেন। মূলত যে স্ক্রুগুলো তিনি লাগিয়েছিলেন সেগুলোর বেশীরভাগ ছিল আসলগুলোর থেকে চিকন এবং বেশ কয়েকটি ছিল সাইজে ছোট। ফলাফল, বায়ুর চাপে স্ক্রুগুলো খুলে গিয়ে উইনশিল্ড ছিটকে বের হয়ে যায়।
ছোট্ট একটা ভুল কিংবা অতিরিক্ত আত্ববিশ্বাস, যেটাই ধরা হোক, সেটির মূল্য দিতে হতে পারতো প্লেনটির ৮৭ জন মানুষকে। ভাগ্যের ক্রমাগত অনুকূল প্রতিকূল ছলাখেলায় অন্তত শেষপর্যন্ত বেচে গিয়েছিলেন সবাই।
মূল ডকুমেন্টারীটির লিংক পুরো দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। ইনভেস্টিগেশনটি AirCrash Investigation Season 02 Episode 01 অবলম্বনে। (আমি অবশ্য ভা্র্সিটির ৫ এমবিপিএস এর সদ্ব্যবহার করতে সিজন ১ থেকে ১০ পুরোটাই নামিয়ে নিয়ে এসেছি )
নাইজেল, যিনি শেষ পর্যন্ত পাইলটকে ধরে রেখেছিলেন, তার নিজের অভিজ্ঞতা কারো পড়ার ইচ্ছে থাকলে পড়তে পারেন।
আংশিক এখানে: