টপিকঃ ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন ৩: China Flight (Dynasty) 611
কেউ কি Golden Route এর কথা শুনেছেন ? তাইপেই থেকে হংকং যাওয়ার রুট টা হচ্ছে সবচেয়ে বেশী জার্নি করা রুট এবং কোম্পানীগুলোর জন্য সবচাইতে বেশী প্রোফিটাবল রুট। এতটাই প্রফিটেবল যে এটার নামই হয়ে গেছে "গোল্ডেন রুট"।
কিন্তু সোনায় খাদ না থাকলে সমস্যা। গোল্ডেন রুটে কিছু না ঘটলে কিভাবে হবে ? নিয়তি কিংবা অবধারিত কিছু একটা যাই বলুন, China Flight 611 ছিল সেই খাদ টুকু।
২০০২ সালের ২৫ মে তাইওয়ার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করে একটি Boeing 747 (747-209b)। চায়না এয়ারলাইনস এর হাতে থাকা একমাত্র 747, চমৎকার ভাবেই টেকঅফ করে। কিন্তু চমৎকারভাবে ল্যান্ড করা হয়ে উঠে নি আর। টেকঅফ করার ২০ মিনিট পর সুন্দরী ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট যখন প্যাসেঞ্জারদের দেখভাল করছিলেন, তখন হঠাৎ করেই খুলে যায় প্লেনের পিছনের অংশ, ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট কিছু বোঝার আগেই ছিটকে বের হয়ে গেলেন প্যাসেজ থেকে। বাকিরা কিছু বুঝার আগেই প্লেনটি ৩ ভাগে ভাগ হয়ে সমুদ্রে ছিটকে পড়ে। কি হলো ? পিছনে তো সাধারনত আঘাত লাগার কথা না, লাগলে আগে সামনেই লাগবে বা মাঝে। তবে কি এলিয়েন এ্যাটাক ???
যেটা বলা হয় নি, প্লেনের পিছনের অংশটি যে খুলে গিয়েছিল সেটি কিছু চমৎকারভাবে খুলে যায় নি, প্রচন্ড শব্দে ব্লাষ্ট হয়ে ভেঙে পড়েছিল প্লেনটি। তার পরের ব্রেকটা হয়েছিল ককপিটের ঠিক পিছনদিকে। ৩টি অংশই খুলে পড়ে যায় তাইওয়ার স্ট্রাইটে।
৩টা ৮ মিনিট বিকেলে টেকঅফ করার জন্য প্লেনের ফ্লাইট উচ্চতা (সাধারানত ৩৫০০০ ফিট) এর জন্য ক্লিয়ারেন্স ঘোষনা করা হয়। ২০ মিনিট পড়ে প্লেনটি রাডার স্ক্রিন থেকে হারিয়ে যায়, যার একটিই অর্থ দাড় হয় কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছে, বিমানটি ধ্বংস হয়ে গেছে কোন ভাবে। শুরু হলো উদ্ধারকার্য।
১৭৫ জনকে খুজে পাওয়া গেল, সবাই মৃত, ইনফ্যাক্ট প্লেনের ২২৫ জনের কেউই বেচে ছিল না এই দুর্ঘটনায়। কাউকে পাওয়া গেল সমুদ্রের পানিতে ভাসতে, অনেককে পাওয়া গেল তখন প্লেনের সীটেই রয়ে গেছেন সীটবেল্টে বাধা পড়ে। শুরু হলো প্লেনের উদ্ধারকাজ।
৩৫ হাজার ফিট উচ্চতায় প্লেনটি মোট ৪ ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। প্লেনের বিভিন্ন অংশ খুজে পাওয়া গেল এক্সিডেন্ট থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকেও। খুজেপেতে মোটে ১৫% ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেল। ককপিটটা ছিল সেখানে। দেখা গেল কোন রকম বিস্ফোরন বা গুলির সাইন নেই। ওদিকে ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার খুজে পাওয়ার পর দেখা গেল ক্র্যুইজিং লেভেলে যাওয়ার সময় প্লেনটি অনেক দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটাও প্লেনের সীমারেখার মধ্যেই, কাজেই প্লেনটি উপরে উঠার সময়ও দূর্ঘটনা ঘটে নি। আরেকটি ডেটা চেক করে দেখা গেল ৪টি ইঞ্জিনের মধ্যে একটি স্লো কাজ করা শুরু করেছিল, ওটাই একমাত্র ইঞ্জিন যেটা তারা খুজে পেয়েছিল সাগরের বুকে। তেমন কোন ক্লু পাওয়া গেল না যেটা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কেন প্লেনটি কেন ক্র্যাশ করলো। এবার তারা মরিয়া হয়ে খোজা শুরু করলো, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল অন্যতম বা সবচেয়ে বেশী খরুচে অনুসন্ধান।
প্রত্যেকটি টুকরো তারা তুলে এনে মা্র্ক করে রাখতো, আর সেগুলো রিসার্চ করতে পাঠাতো। প্লেনের টুকরোগুলো থেকে যেন প্লেনের স্ট্রাকচার ঠিকঠাক সাজানো যায় সেটার জন্য একজন এক্সপার্টকে নিয়ে এলেন তারা। ভদ্রলোক একদিন জঞ্জালের ভিতরে পেয়ে গেলেন প্লেনের টেইলেট একটা অংশ, আর সেই অংশটুকুই এনে দিল তাদের এতদিনের প্রশ্নের উত্তর। বের হয়ে এলো এক বিভিষীকাময় কাহিনি। যে কাহিনির শুরু দুর্ঘটনা থেকে ঠিক ২২ বছর আগে একই দিনে।
২২ বছর আগে বোয়িং 747 প্লেনটি ল্যান্ড করার সময় পাইলট টেইল কে একটু বেশী নামিয়ে আনায় টেইলের নীচের দিকটায় খানিকটা ড্যামেজ হয়ে যায়। রিপোর্ট করার পর হ্যাঙ্গারে প্লেনের ওই ড্যামেজ অংশটুকুর উপর দিয়ে তারা আরেকটি মেটাল প্লেট লাগিয়ে দেয়। কিন্তু খুব ছোট্ট একটা ভুল থেকে যায়। সাধারনত এধরনের ক্ষেত্রে মেটাল প্লেট লাগালে সেটি আহত এলাকার সাথে এক্সট্রা ৩০% স্পেস কাভার করে ডাবলিং প্লেটটি লাগানোর নিয়ম। টেকনিশিয়ানরা সেটি না করে কেবলমাত্র ড্যামেজড অংশটুকুর উপরেই ডাবলিং প্লেট লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু রিপোর্ট করলেন আবার ঠিকমতই। এটি অবশ্য টেম্পোরারী ফিক্স, এটার পড়ে ওই অংশটুকু কেটে নিয়ে পুরোটুকু রিপ্লেস করার কথা। কিন্তু সেটা কোনদিনও আর করা হয় নি। আর সেটাই হয়ে গেল কাল।
৩৫ হাজার ফিট উচ্চতায় বেশ ভাল তারতম্য হয় চাপের। প্লেনের ভিতরের ও বাইরের এই চাপের তারতম্য ব্যালেন্স করার জন্য কতগুলো ভেন্টিলেটর ব্যাবহার করা হয়। Boeing 747 টিতে চাপ সইতে সইতে সেই ড্যামেজ অংশটিতে ফাটল ধরে। এবং মুহূর্তেই সেটি ফেটে গিয়ে পুরো টেইলের অংশ নিয়ে ছিটকে পড়ে। তার পরে ?
কখনো টিউবলাইটের এক মাথা ফাটিয়ে দেখেছেন রিএ্যাকশন কি হয় ? যদি না করে থাকেন তাহলে ভুলেও করতে যেয়েন না। আমি এই কাজটা একবার করেছিলাম। টিউবের ভিতরটা একদম ফাকা, একটা পাশ ভেঙে দেয়ার কারনে এত প্রচন্ড গতিতে বাতাস ভিতরে ঢুকতে শুরু করে যে অপর পাশের কানেক্টর প্রায় বুলেটের মত ছিটকে বের হয়ে আসে। খুবই ডেঞ্জারাস একটা ব্যাপার।
Flight 611 এর কপালেও তাই ঘটলো। একটা পাশ ছুটে যাওয়ার বাতাসের চাপের যে তারতম্য হলো তাতে প্লেনটি মূহূর্তেই ৩টুকরো হয়ে ভেঙে গেল।
Flight 611 আজ পর্যন্ত সর্বশেষ 747 যেটি এতবড় দুর্ঘটনায় পড়েছে। ২২ বছর আগের একটি ছোট্ট রিপেয়ার না করার খেসারত দিতে হলো ২২৫ জন যাত্রীকে, ঠিক ২২ বছর পরে একই দিনে। চায়না এয়ারলাইন্স সহ সবগুলো বিমানের জন্য একটি দৃস্টান্ত হয়ে থাকলো এই দুর্ঘটনা।