টপিকঃ ক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন ২: Air France Flight 4590
কনকর্ড কমার্শিয়াল লাইনআপের একটি অনন্য সংযোজন। সুপারসনিক জেট, গতিময় ভ্রমন সবকিছু নিয়ে সাফল্যমন্ডিত একটি ক্যারিয়ার। কনকর্ড শুধুমাত্র একটি সাকসেলফুল নামই ছিল না, ছিল জাতীয় গর্বের একটি নাম। সব চাইতে নিরাপদ হিসেবে পরিচিত কনকর্ডের ১৯৭৬ সালে প্রথম ইনট্রো করার পর ২০০৩ সালে রিটায়ার করার আগ পর্যন্ত একটি মাত্র দুর্ঘটনার রেকর্ড আছে । আসলে, ওই একটি দুর্ঘটনার কারনেই শেষ হয়ে যায় কনকর্ডের ক্যারিয়ার। ফ্লাইটটি ছিল Air France Flight 4590
২৫ জুলাই, ২০০০ সালে টেকঅফ করার আগ মুহুর্তে হঠাৎ করেই Flight 4590 এর নীচে আগুন দেখা দেয়। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে জানানো হয় যে তারা আগুন দেখতে পাচ্ছে, টেকঅফ এবোর্ট করা হবে কিনা। শব্দের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন গতিতে চলা কনকর্ডের টেকঅফ গতিও কম নয় নেহায়েত, প্লেনের গতি তখন ৩২৮ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। অতটুকু স্পেসে এবোর্ট করতে পারবে না জেনে তারা নাকচ করে দেয় এবং আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায়ই টেক অফ করে। পরিনতি হয় ভয়াবহ, আগুন জ্বলতে থাকার কারনে কনকর্ড উচুতে উঠতে ব্যার্থ হয়, বাকা হয়েই যুদ্ধ করতে থাকে উচুতে উঠার। লক্ষ একটাই, কাছের লে বারগেট ( Le Bourget Airport) এয়ারপোর্টে ইমার্জেন্সী ল্যান্ড করা। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না কনকর্ডের। ককপিট থেকে বারবার একটি কথাই ভেসে আসছিল "Too Late, No Time" কিছুক্ষন পরে প্লেন স্টল হয়ে ক্র্যাশ করে কাছের একটি হোটেলের উপর।
৪জন হোটেল বাসী, ১০০ জন প্যাসেঞ্জার এবং ৯জন ক্রু সবাই মারা যান।
কি হয়েছিল ? ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ওইদিন কনকর্ডে বাড়তি প্রায় ৮১০ কেজি মালামাল ছিল, কনকর্ড সেফলি টেকঅফ করার জন্য ম্যাক্সিমাম টলারেন্স যা থাকার কথা তার থেকে ৮১০ কেজি বেশী তেমন গুরুতর কারন নয়, এর আগেও এক্সট্রা ওয়েট নিয়ে টেকঅফ করেছে তারা। যে প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে আসতে থাকলো, কেন আগুন ধরলো রানওয়েতে থাকতেই। টেকঅফ করার আগমুহূর্তে প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার/ঘন্টায় থাকতে যখন আগুন দেখা যায়, ঠিক সেইসময়, কনকর্ডের বাম পাশের দুইটি ইঞ্জিনেই পাওয়ার লস হয়। মূলত এই কারনেই প্লেনটি টেকঅফের পরে আর অল্টিট্যুড গেইন করতে পারে নি।
এক্সিডেন্টের পরে রানওয়ে ইনস্পেকনে হঠাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লু ধরা পড়ে। রানওয়েতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কনকর্ডের টায়ার। কোনভাবে টায়ার পাংচার হয়ে সেটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, একটা বড় টুকরা ছিল প্রায় সাড়ে ৪ কেজির কাছাকাছি। রেকর্ড ঘেটে দেখা গেল কনকর্ডের টায়ার অনেক বেশী শক্ত বানানো হয় যাতে করে বাড়তি গতির স্ট্রেস নিতে পারে টেকঅফ, ল্যান্ডিং এর সময়, ২৪ বছরে তেমন কোন গুরুতর ঘটনা ঘটে নি। কিন্তু এই প্লেনটির টায়ার গুরুতর ভাবে পাংচার হয়েছে। ধারনা করা হলো এটিই ছিল সূত্রপাত। শুরু হলো খোজা কেন টায়ারটি পাংচার হলো।
রানওয়ে ঘেটে পাওয়া গেল সেই ক্লু, ১৭ ইঞ্চি লম্বা একটি মেটাল স্ট্রিপ পড়ে আছে রানওয়েতে। রেকর্ড ঘেটে দেখা গেল, কনকর্ডের ঠিক আগে টেক অফ করা একটি ডিসি-১০ (বাংলাদেশ বিমানে যেটি বহুল ব্যাবহৃত) প্লেন থেকে ওই স্ট্রিপটি পড়ে যায়। সাধারনত কনকর্ড টেকঅফ করার আগে রানওয়ে একবার ভাল করে চেক করা রুটিন প্রসিডিউর। কোন কারনে সেদিন সেটি করা হয় নি। ফলাফল: ১১৩ জনের মৃত্যু এবং একটি সফল ক্যারিয়ারের শেষ।
প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার গতিতে চলার সময় স্ট্রিপটি আঘাত করে কনকর্ডের টায়ারকে। আর তাতেই পাংচার হয়ে যায় টায়ারটি। তো ? কনকর্ডের প্রতিটি টায়ার সাধারন টায়ার থেকে দ্বিগুন লোড নিতে সক্ষম, কোন সমস্যাই হওয়ার কথা ছিল না তাদের টেকঅফ বা পরে ল্যান্ডিং করতে। তাহলে আগুনের সূত্রপাত হলো কিভাবে ?
টায়ার পাংচার হয়ে যাওয়াটা সমস্যা নয়, কিন্তু প্রায় সাড়ে ৪ কেজি ওজনের একটি টুকরা যদি প্লেনকে আঘাত করে তবে সেটা গুরুতর কিছু করতেও পারে। ইনভেস্টিগেশনে দেখা গেল, টায়ারের টুকরাটি যখন প্লেনের নীচের দিকে আঘাত করে তখন একটা শকওয়েভ তৈরী হয়, আর সেই শকওয়েভে গ্যাসট্যাংকের দুর্বল জায়গাটি ফেটে গ্যাস লিক করা শুরু করে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, গ্যাস লিক থেকে আগুন ধরতে হলে কোন ইগনিশন হতে হবে, সেটা কোথায় হলো।
ইনভেস্টিগেটররা মোটামুটি একটি সমাধানে পৌছালেন যে টায়ারটি প্লেনের নীচে আঘাত করার সময় লোয়ার পার্টের কোন ইলেকট্রিক ওয়্যারে আঘাত করে আর তারটি ছিড়ে যায়। আগুনের সূত্রপাত সেখান থেকেই।
মোটামুটি শেষ পর্যায়ে, কনকর্ড হয়তো কাছাকাছি অন্য একটি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে পারতো, কিন্তু ওই আগুনে প্রথমেই সেকেন্ড ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে, সেটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন পাইলট, এর পরে আগুনের গরমে প্রথম ইঞ্জিনটি সার্জড হয়ে বিকল হয়ে পড়ে, সেটি আর চালু হয় নি। কনকর্ডের ডিজাইন এধরনের গতির ভিন্নতা সহ্য করার মত করে তৈরী করা হয় নি। মোটামুটি ১০০ ডিগ্রীতে বেকে গিয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আছড়ে পরে একটি হোটেলের উপরে।
কনকর্ডের ২৭ বছরের গৌরবময় যাত্রা, অনন্য গতি, সবকিছু থেমে যায় ২০০৩ এ। সবচাইতে বেশী সেফটি রেকর্ড হাতে থাকা কনকর্ডের ইতি টেনে দেয় ডিসি-১০ এর ইঞ্জিন থেকে পড়ে যাওয়া মেটাল স্ট্রিপ।
Up Next: China Airlines Flight 611