টপিকঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণার ভূমিকা - ১
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণার ভূমিকা এবং কৃতবিদ্য প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা -১
যদিও নির্বাচন নিয়ে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা আপাতদৃষ্টিতে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তবুও শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা আশাবাদী যে রাজনীতিবিদদের মাঝে আন্তরিক সংলাপ দেশকে হীন কোন্দল, নির্মম আত্মধ্বংসীতা আর সংঘাত হতে রক্ষা করবে। এতো অনিশ্চয়তার ডামাডোলেও আগামীবার ক্ষমতায় এলে রাজনীতিবিদদের দেশকে বদলে দেবার প্রতিশ্রুতি প্রায় প্রতিদিনই প্রচার মাধমে পরিবেশিত হচ্ছে - যদিও এমুহুর্তে এসবে দেশবাসীর খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এই অহেতুক অনিশ্চয়তার ধুলোঝড় থিতিয়ে আসলে সচেতন নাগরিকরা রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোকে পর্যালোচনা করবে, শিক্ষিত জনগোষ্ঠির জন্য কর্মসংস্থান আর বেকারত্ব নিরসনকল্পে তাদের পরিকল্পনা; জ্বালানী, পানি, পরিবেশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতিমালা; এবং স্বল্প আর দির্ঘমিয়াদী পরিকল্পনাগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করবে। দ্রুতগতিতে উন্নয়ন সাধনকারী নিকটবর্তী এবং দূরের দেশগুলোর সফল পরিকল্পনাগুলোর সাথে আমাদের দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তুলনা করবে। আজকের গ্লোবাল ভিলেজে এটাই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত।
ধরে নেয়া যাক যে সবগুলো রাজনৈতিক দলই আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা, প্রতিহিংসার রাজনীতি না করা সহ সবগুলো গুরত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে দেশবাসীকে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রেরণাদায়ক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হবে। বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, আন্তরিকতা থাকলে এগুলো সহজেই অর্জনীয়। অন্যদিকে আধুনিক রাষ্টের জন্য অত্যাবশ্যক যে দিকগুলোকে উপেক্ষা করলে সমাজ গুরুতরভাবে পেছনে পড়ে থাকে আর অর্থনৈতিক উন্নতির গতি অত্যন্ত মন্থর হয়ে আসে, বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত গবেষণা সে তালিকার শীর্ষে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের মত বিশাল জনসংখা আর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় জর্জরিত দরিদ্র একটি দেশের জন্য গবেষণালব্ধ মৌলিক সমাধান আরও গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখাটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গবেষণা, গবেষণায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সুদক্ষ প্রবাসীদের ভুমিকা এবং সবশেষে আসন্ন নির্বাচনে কিভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে উপস্থাপিত একটি শক্তিশালী বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণার নীতিমালা ভোটদাতাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তার উপরে। সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি গবেষণানীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিভাবে আমরাও অতিদ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক স্থিতি অর্জন করতে পারব, বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তা তুলে ধরা হলো।
আলোচনার শুরুতেই আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো তুলে ধরা যাক। কিছু দিন আগে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এগুলোকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি প্রধানতঃ তিনটি শ্রেণীর পেশাজীবিদের কঠোর পরিশ্রমের ভিতের উপর দাড়িয়ে আছে। এরা হলো গার্মেন্টসের শ্রমিকরা- যাদের অধিকাংশই নারী - যারা আর্থিক এবং শিক্ষাগত সুযোগ থেকে নিত্যবঞ্চিত। দ্বিতীয় দলে আছে নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী শ্রমিকরা। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বছরগুলো তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অধিকারহীন অভিবাসী হিসেবে পরিজন বিবর্জিত পরিবেশে অনাদর আর অবহেলায় শেষ করেন। তাদের রক্ত পানি করা পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ভরে উঠছে। সব শেষের দলটি এই দেশের কৃষক, - রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে যাদের বিরামহীন খাটুনির বিনিময়ে আমাদের জাতির খাদ্যের নিশ্চয়তা পাচ্ছে। এই তিনটি গোষ্ঠীই দেশের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে। অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতে এই তিনটি অর্থনৈতিক খাত হলো একটি গাড়ির তিনটি চাকার মতো। গাড়িটি গতিশীল হতে হলে একটি চতুর্থ চাকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান নতুন প্রজন্মকে চতুর্থ চাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন যে নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির অগ্রগতি কাজে লাগিয়ে মানুষের কঠোর পরিশ্রমকে লাঘব করবে।
উপরের এই গাড়ির উপমাটাকে আরেকটু প্রসারিত করা যাক। আজকের তিনটি অর্থনৈতিক খাতের মন্থরগতির যে তিনটি চাকা আমাদের দেশে আছে, তার সাথে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চতুর্থ চাকা জুড়ে দিয়ে গাড়ী নির্মাণ করতে হলে একজন নকশাকার বা পরিকল্পক দরকার হবে। একটি যুগোপযোগী গাড়ি নির্মাণ করে পরিকল্পক চাইলে চালকের আসনে বসতে পারেন অথবা অন্য একজনকে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। এই উপমার সেই চালক বা আধুনিক পরিকল্পনাকার কে? সে হলো সমবেতভাবে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিষয়ক সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা; গবেষনার জন্য অনুপ্রেরণা এবং তহবিল; বহির্বিশ্বের সাথে প্রযুক্তিগত ঘনিষ্ঠতা; প্রযুক্তি-ভিত্তিক এন্তের্প্রেনার্শিপের (entrepreneurship) জন্য পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ এবং উদার অনুদান। আমাদের দেশে এই ধরনের একজন চালকের আবির্ভাব এখনো হয়নি। সেকারণে অর্থনৈতিক উন্নতির গতি তিন চাকার মালবাহী গাড়ীর অথবা ঠেলাগাড়ীর চেয়ে বেশি গতিতে এগুতে পারেনি। অথচ সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এসময়ে এগিয়েছে দ্রুতগতিময় গাড়ীর বেগে।এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের গাড়িটিকে আমরা যতো বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন করতে চাইবো তত বেশি সুনিপুণ নির্মাতা এবং দক্ষ চালকের দরকার হবে।
গবেষকদের মাঝে একটা সর্বজনস্বীকৃত তথ্য হলো পৃথিবীর ইতিহাসে যতো বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে তাদের অধিকাংশই বর্তমান সময়ে জীবিত আছেন আমাদের মাঝে। কথাটি বর্তমান জগতে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির গভীর ভূমিকাকে এবং জাতিসমূহের মধ্যে গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যাপৃত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের বিশাল সংখ্যাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এই বিপুল গবেষক গোষ্ঠিকে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য উন্নত এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো জিডিপির শতকরা ১ থেকে ৩ ভাগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি ব্যয় করে থাকে। কেন এসব দেশ গবেষনার জন্য এত অর্থ বরাদ্ধ করছে? কারণ দুটো। প্রথমত: একবিংশ শতকের সমাজ এবং জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর জন্য গবেষণা নির্ভর সমাধানের বিকল্প নেই। দ্বিতীয়ত: গবেষণায় বিনিয়োগের সুফল শত শত, এমনকি হাজার গুনে বর্ধিত হয়ে সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে এবং আগামী দিনের অনিশ্চয়তা থেকে জাতিকে আগলে রাখে।
গবেষনার ভূমিকাকে একটি গাছের বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। একটা জাম গাছের উদাহরণ দেয়া যাক এখানে। জাম ক্যান্সার সহ অনেক রোগের জন্য বিশেষভাবে উপকারী বলে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন। কোনো ধরনের যত্ন আর পরিচর্যা ছাড়া কাকতলীয়ভাবে গ্রামের বনে বাদাড়ে বেড়ে উঠা একটি জাম বৃক্ষ যত উত্পাদনক্ষম হবে, সামান্য পরিচর্যা, সময়মত পানি, সার, কীটনাশক আর আগাছা দূরীকরণের মাধমে সেটাকে কয়েকগুন ফলদায়ক করা সম্ভব। আবার গবেষনা আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে সেই জাম গাছের বীজ অথবা গাছটিকে বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কয়েকগুন বেশি ফলনশীল, ফলগুলোকে আকারে অনেক বড়, রসালো, তুলনামুলকভাবে বেশি মুখরোচক, খরা এবং রোগপ্রতিরোধী করে অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভজনক গাছে পরিনত করতে পারেন। অধিকন্তু, সুসম্বদ্ধ গবেষণা হতে পারে ফল সংগ্রহ করার দ্রুত পদ্ধতি, জামের রস (জুস) সংরক্ষণ করা, এর প্যাকেজিং, এর খাদ্যতালিকাগত সম্পূরক উপাদান হিসেবে ব্যবহার, বহির্বিশ্বে অনুপ্রবেশ, বিজ্ঞাপন এবং বাজার সৃষ্টি, এই ফলের ক্লিনিকাল ট্রায়াল ইত্যাদির উপর। এসবই অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এগুলোর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যক্তিগত বা বেসরকারী উদ্যোগে এধরনের গবেষণার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু গবেষনার এই বিনিয়োগর কয়েকগুন, এমনকি কয়েকশত গুন সুফল আমরা ফিরে পাব কর্মসংস্থান, রাজস্ব এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মাধমে। জামের উপর কৃত গবেষণা যদি বিশাল মুনাফা নাও আনে, অর্জিত অভিজ্ঞতা অনুরূপ কোনো খাতের জন্য নিশ্চিতভাবে কাজে লাগবেই।
যারা বলেন আমাদের দেশের জন্য গবেষণা একটা বিলাসিতা তারা দেখুন কিভাবে আমাদের গবেষকরা বিশ্বমানের গবেষণার বিনিময়ে বাংলাদেশকে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। গত কয়েক দশকে জনসংখা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে আর জমির পরিমান কমেছে ভীতিকর হারে। অথচ আমরা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি আমাদেরই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত পদ্ধতি, বীজ আর সার ব্যবহার করে। সম্প্রতি বাংলাদেশী বিজ্ঞানীরা বছরে চারবার ফসল ফলানোর মত নতুন কৌশলও আয়ত্ত করেছেন। আমদের বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একবিংশ শতকের সমস্যা সমাধানে যে কোনো জাতির বিজ্ঞানীদের মতই দক্ষতা দেশে-বিদেশে দেখিয়ে যাচ্ছেন।একসময় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এদেশে বিশ্বমানের গবেষণা সম্ভব নয় বললেও জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশে ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টার স্থপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের জানা উচিত যে আজকের পৃথিবীতে কোনো জাতিই শুধুমাত্র প্রযুক্তির ভোক্তা হিসেবে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারে না।
যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটির উপাত্ত অনুসারে ২০১১ সালের গবেষণা খাতে কতগুলো দেশের মোট খরচের পরিমান হলো এরকম (মার্কিন ডলারে)। ব্রাকেটে প্রতিটি দেশের গবেষণায় বরাদ্ধ জিডিপির শতকরা অংশও তুলে ধরা হলো। ইথিওপিয়া ১০ কোটি (০.১৭%), ভিয়েতনাম ৫০ কোটি (০.১৯%), মালোয়শিয়া ২৬০ কোটি (০.৬৩%), পাকিস্তান ৩৬৭ কোটি (০.৬৭%), সিঙ্গাপুর ৬৩০ কোটি (২.২%), তুরস্ক ৬৯০ কোটি (০.৭%), ভারত ৩৬১০ কোটি (০.৯%), দক্ষিন কোরিয়া ৫৫৮০ কোটি (৩.৭%), চীন ২৯৬৮০ কোটি (১.৯৭%) আর যুক্তরাষ্ট্র ৪০৫৩০ কোটি (২.৭%) মার্কিন ডলার খরচ করেছে। বেদনাদায়ক সত্য হলো আজ বাংলাদেশ জিডিপির ০.০২% চেয়েও কম খরচ করছে গবেষণায়।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে ২০১২-১৩ সালের বাজেটে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ করেছেন ৪.৬ কোটি মার্কিন ডলার (৩৭০ কোটি টাকা) এই সংখ্যাটা ২০১১-১২ সালের বরাদ্দের চেয়ে প্রায় ২৭% কম। তখন এর পরিমান ছিল ৬.৪ কোটি মার্কিন ডলার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ক্ষুদ্র একটা অংশই গবেষণায় অবদান রাখে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (BCSIR) গত বছরের বাজেট ছিল ১২ কোটি মার্কিন ডলার, যেখানে তার আগের বছরের (২০১১-১২) বাজেট ছিল ১২.৮ কোটি মার্কিন ডলার। গবেষণা অর্থায়নের এই আত্মঘাতী হ্রাস একটি হতাশাদায়ক প্রবণতা এবং এটা আমাদের নীতি নির্ধারকদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত-বিচ্ছিন্নতাকে দৃষ্টিগোচর করে দিচ্ছে।
এবছর জুনের শেষ সপ্তাহে আঙ্কারায় এক আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কর্মশালার আমার যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। তুরস্কের বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালযের বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ পুরো তিনদিন ধরে আমন্ত্রিত অতিথি এবং বিজ্ঞানীদের সাথে ছিলেন। উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলু তার সংক্ষিপ্ত অভিভাষণ শুরু করেন এভাবে: “২০১২ সালে তুরস্ক প্রতি কিলোগ্রাম পণ্য রপ্তানী করে গড়ে ১০ ডলার উপার্জন করেছে। একই সময়ে জার্মানি সমওজনের রপ্তানীকৃত পণ্যের জন্য উপার্জন করেছে ১০০ ডলারের উপরে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই যে ষাটের দশকে তুরস্ক এক কিলোগ্রাম পণ্য রপ্তানী করে উপার্জন করতো দশ সেন্টের সামান্য উপরে (বর্তমানের উপার্জনের চেয়ে প্রায় ১০০ গুন কম)। এই যে মূল্যের এবং বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান, এটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনারা?” প্রশ্ন করলেন তুরস্কের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে গেলেন আরো কিছু পরিসংখ্যান। “তুরস্কের বার্ষিক রপ্তানীর পরিমান ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ওজনে সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানী করে জার্মানী অর্জন করে দেড় ট্রিলিয়ন (১৫০০ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ জার্মানির কারিগরের পণ্যের জন্য বিশ্বের ক্রেতারা তুরস্কের তুলনায় দশগুণ বেশি দাম দিতে রাজী। দুই দেশের জনসংখা প্রায় কাছাকাছি, যদিও তুরস্কের আয়তন জার্মানীর প্রায় দ্বিগুন। তাহলে পার্থক্যটা হচ্ছে কি কারনে? কেন আপেল (Apple) কম্পিউটার কোম্পানির প্রতি কিলোগ্রাম পণ্যের গড়পড়তা বিক্রয় মূল্য ২০০০ ডলারের উপরে? ১৯৯৫ সালে তুরষ্কের জিডিপি ছিল ডি-৮ দেশগুলোর অন্যতম সদস্য বাংলাদেশের আজকের জিডিপির সমতুল্য - অর্থাৎ ১১৬ বিলিয়ন ডলার। ১৬ বছর পর ২০১২ সালে তুরষ্কের জিডিপি ৬ গুন বেড়ে হলো ৮০০ বিলিয়ন ডলার। আরো ১২ বছর পর ২০২৫ সালে জিডিপিকে বাড়িয়ে বর্তমান জার্মানীর সমপর্যায়ে নিযে যেতে চাই আমরা। অর্থাৎ আমরা ২০২৫ সালে তুরস্কের জিডিপি আজকের জিডিপির চেয়ে প্রায় সাড়ে চার গুন বাড়িয়ে ৩৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবো এবং অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দশটি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবো।”
২০২৫ সালে তুরস্কের জিডিপি আজকের জার্মানীর জিডিপির সমান হবে! এটা কি অতি উচ্চাভিলাষী উপমন্ত্রীর অবাস্তব স্বপ্ন? অন্য যে কারো মতই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল কথাগুলো এবং আমি হয়ত তার বক্তব্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতাম যদি না জানতাম যে উপমন্ত্রী ক্যালটেক (Caltech) থেকে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি করেছেন, একজন অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালযের সবগুলো ভবিষৎ পরিকল্পনার স্থপতি তিনি। পিন পতনের নীরবতায় আমি তার স্বপ্নিল কথাগুলো গিলছিলাম। “আজ তুরস্কে আমরা জিডিপির ০.৭% গবেষণা খাতে ব্যয় করছি এবং দেশে মোট ৩০ হাজারের মত গবেষক বর্তমানে কাজ করছেন বিভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে।১৯৯৫ সালে তুরস্কে মোট গবেষকের সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের নীচে। ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা গবেষণা খাতে বরাদ্ধ ক্রমাগত বাড়িয়ে আমাদের জিডিপির ৩% পর্যন্ত উন্নীত করবো। তাতে প্রতিবছর গবেষণায় প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে বিনিয়োগ করা হবে। আমরা আশা করছি প্রায় ৩ লক্ষেরও বেশী গবেষক তখন আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখবেন।” অর্থাৎ আগামী ১২ বছরে তুরস্ক গবেষকের সংখ্যা প্রায় দশগুণ বাড়াবে যেন তাদের পণ্যের মান এবং কদর জার্মানীর পণ্যের সমকক্ষ হয়। আর তারা ২০২৫ সালে শুধুমাত্র গবেষণা খাতেই খরচ করবে বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় বাজেটের তিন গুনের উপরে। উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলুর বক্তব্যকে হেসে উড়িয়ে দিতাম যদি না জানতাম যে তুরস্ক গত কয়েক বছর ধরে প্রায় ১০% এর কাছাকাছি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, তারা ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে গবেষণামুখী অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার আর বিপুল সংখ্যক প্রবাসী তুর্কী বিজ্ঞানী, প্রকোশলী এবং শিল্পপতি দেশে ফিরে আসছে দেশের দেয়া অনুকুল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে সেটা ৩ গুন বেড়ে হলো ১১৬ বিলিয়ন। একই সময়ে তুরস্কের জিডিপি বেড়েছে ৬ গুন এবং এরচেয়েও দ্রুত গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে দেশটি গবেষনায় বিনিয়োগ বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নব্বইয়ের দশকে আমি যখন ছাত্র হিসেবে আঙ্কারায় ছিলাম, তখন তুরস্কের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতই। সেখানে যদিও বংশানুক্রমিক গণতন্ত্র ছিলনা, তবুও হতাশ মানুষ ঘুরেফিরে একই নেতাদের যুগের পর যুগ ক্ষমতায় দেখেছে। যুবসমাজ রাজনীতিবিদদের একদল শ্রদ্ধাহীন স্বার্থান্বেষী দস্যুর মতই মনে করতো। রাজনীতিবিদদের একচ্ছত্র প্রভুত্বে যখনি তারা আগাপাশতলা জিম্মি হয়ে যেত, অস্থিতিশীলতা সমাজকে আবৃত করা ফেলত, তখনি সামরিক বাহিনী এসে নির্মম ও আত্মধ্বংসী পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে পিছিয়ে দিত বারবার। আজকের বাংলাদেশের মতই জার্মানি আর মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী তুর্কী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ তুর্কী অর্থনীতির বড় খাতগুলোর একটি ছিল। গবেষণা ভিত্তিক অর্থনীতি তখনও সমাজে গভীরতা পায়নি। সেই দেশটি আজ দুই দশকের কম সময়ে স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদী প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বলে বলিয়ান হয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ধনী দেশের তালিকায় ১৭ নম্বরে আছে। তারা দৃঢ় প্রত্যয়ী - ২০২৫ সালে শীর্ষ ১০ ধনী দেশের তালিকায় স্থান করে নিবেই। তুর্কী প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে বাংলাদেশের সাথেও তারা ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের বানিজ্যিক সম্পর্ক গড়ার অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন। এই গভীর আত্মবিশ্বাসের শেকড়গুলোর জন্ম তাদের বিশ্ববিদ্যালয় আর জাতীয় গবেষনাগার গুলোতে বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। সমষ্টিগত মেধা, স্বজ্ঞা, পরিকল্পনা আর বিশাল গবেষক বাহিনী তুরস্ককে সফলভাবে রক্ষা করেছে, যখন তাদের প্রতিবেশী গ্রীস হয়ে গেছে আর্থিকভাবে দেউলিয়া এবং সিরিয়া আর ইরাক জড়িয়ে পড়েছে ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধে। তুরস্কের উদাহরণটি আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক।
কফি বিরতিতে আমি উপমন্ত্রী দাউদ কাভরানোলুকে জিজ্ঞাসা করি কিভাবে তারা তুরস্কে বছরে ১০% মত প্রবৃদ্ধি সম্ভব করেছেন। তিনি সংক্ষেপে বললেন - বিশাল বৃক্ষের চারা প্রথম কয়েক বছর দ্রুত বাড়তে থাকে যদি ভালো জাতের বীজ বাছাই করে লাগানো হয়, যদি গাছটি ঠিকমত পানি, আলো, বাতাস, সার ইত্যাদি পায় আর যদি গবাদী পশু বা পোকামাকড় তার ডালপালা খেয়ে না ফেলে। পরিনত বয়সে মহীরুহের বৃদ্ধির হার কমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশাল অর্থনীতির ১% প্রবৃদ্ধি আমাদের মত ছোট অর্থনীতির প্রায় ৫% প্রবৃদ্ধির সমান। দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা, প্রযুক্তির অপ্রাতুলতা, সামাজিক অস্থীরতা, স্বজনপ্রীতি আর রাজনীতিবিদদের স্বার্থান্বেষী মনোভাব যদি বাধা হয়ে না দাড়ায়, তাহলে যে কোনো উন্নয়নশীল দেশ সহজেই ২০% হারেও প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। আজারবাইজান, চীন, মায়ানমার, এঙ্গোলা এবং আরো বেশ কিছু দেশ কোনো কোনো বছর ১০% থেকে ৩০% পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তুরস্কের বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রীর সাথে আমার দেখা করার সুযোগ হয়নি, কিন্তু তাদের উপমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন উপদেষ্ঠার জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, ধীশক্তি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা আমাকে অবিভূত করেছে। আমাদের অনুরূপ মন্ত্রনালয়ে সমযোগ্যতার নেতৃত্বের অভাব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।