টপিকঃ যত রঙ্গ বংগদেশে ০১- বাঙ্গালির পরিচয় সংকট
ছোটবেলায় সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে পড়েছিলাম- আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি। কিন্তু চারপাশের মানুষ জনকে দেখে আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা আমরা আসলে কী! আধুনিক বাঙ্গালীর খিচুড়ী টাইপের সংস্কৃতি আমাকে খুব পীড়া দেয়। আমি খুবই মূর্খ টাইপের মানুষ। দুনিয়াদারি সম্পর্কে খুবই কম জানি। পড়াশোনাও তেমন একটা করা হয়না। তাই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা আমাদের সংস্কৃতিটা আসলে কেমন! যেমন ধরুন মাসিক সংস্কৃতি এর কথা যদি বলি! ইংরেজী বছরের শুরু থেকেই শুরু করি। ধরুন থার্টি ফার্স্ট নাইটের কথা(কদিন পরেই আসছে তো তাই এটা দিয়েই শুরু করলাম )। ঐদিন এদেশের একটা বেশ বড় সংখ্যক তরুণ-তরুণী বেশ দামাল হয়ে যায়। অনেকের কাছেই হয়ত স্রেফ বন্ধুদের সাথে আনন্দ করার একটা উপলক্ষ এটা, তবুও এদিন উচ্ছৃংখল আচরণ করার হারও কিন্তু ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হল এটা কি আমাদের সংস্কৃতি? চোখ বুজে বলতে পারি- না! অবশ্য কেন না বা কিভাবে,কোথা থেকে এই ট্রেন্ডটা চালু হয়েছে-সেই প্রশ্ন করলে আর উত্তর দিতে পারব না! ঐ যে বললাম না- আমি গর্দভ টাইপের মানুষ
যাই হোক, জানুয়ারীর বাকি সময়টা মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই কেটে যায়। আমার বিষ্ময় চরমে পৌছে ফেব্রুয়ারীতে। হ্যা ভাই ঠিকই ধরেছেন। বাংলা ভাষার মাস এটা। অবশ্য এই ব্যাপারে আমার কিঞ্চিত ব্যাক্তিগত ক্ষোভ আছে। ২১ ফেব্রুয়ারির বদলে শহীদ দিবসটা ৮ই ফাল্গুন উদযাপন করা হলে হয়ত এই ক্ষোভটা থাকত না। যাইহোক যেই প্যাচাল পারছিলাম সেখানেই ফিরে যাই। বাংলা ভাষার মাস তো তাই এ মাসের শুরুতেই তরুণদের আদিক্ষ্যেতা চরম পর্যায়ে চলে যায়। ফেসবুকে নিজের বাংলা নামের আদ্যক্ষর দিয়ে প্রো-পিক দেয়া, “আমার ভাইয়ের...” কলার টিউন সেট করা...ইত্যাদী আরো হাজার রকমের দেশ ও ভাষাপ্রেমের নমুনা(!)। এরপর আসি পহেলা চৈত্রের কথায়। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে পরিমাণ মানুষ থাকে তা বুঝি পহেলা বৈশাখকেও হার মানায়। মানুষ উৎসব করবে ঠিক আছে, কিন্তু এমন একটা নন-হলিডেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে ভীড় করার কী দরকার বুঝি না। ঢাকা শহরে আর জায়গা আছে কিনা এই বিতর্কে যাব না, তবে ঐদিন ঠিক কি রকম ঝামেলা পোহাতে হয় সামান্য একটু বলি। ঢাবি ক্যাম্পাসে ঐদিন এতটাই ভীড় হয় যে গাড়ি কার্জন হল থেকে টিএসসি পর্যন্ত আসতে ২-৩ ঘন্টা লেগে যায়। আমরা সাধারণ মানুষ তো বটেই, ঢাকা মেডিকেলের রোগীদেরও এই মৌসুমী বাঙ্গালীদের জন্য ঐদিন চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। এর পরেরদিন-ই আবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে! লে হালুয়া...পোলাপাইন রাস্তাঘাটে যেমনে ভালোবাসা দেখাই, অনিচ্ছাস্বত্তেও চোখে পড়ে যায় আর ভাবি-“হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও...”। এতকিছুর পরেও যেগুলো ভালো লাগে তাহলো বইমেলা আর শহীদ দিবসের প্রভাতফেরী। তবে বইমেলার সময় দুপুর থেকে জিমনেশিয়ামের সামনের চওড়া রাস্তায় কতিপয় বিত্তশালীদের কারপার্কিং এর ফলে সৃষ্ট জ্যাম দেখেই আবার মেজাজটা খিচড়ে যায়। মার্চ মাসটা মোটামুটি নানারকম রাজনৈতিক ক্যাচালেই কেটে যায়। এরপর এপ্রিলে আবার শুরু হয় বাঙ্গালীয়ানা প্রদর্শনীর হিড়িক। আর এভাবেই মোটামুটি সারাটা বছর জুড়ে চলতে থাকে আমাদের সাংস্কৃতিক দীনতা প্রদর্শনের মহড়া...
কিছু কিছু জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য আমাকে মুগ্ধ করে। যেমন- জাপানী, চীনা কিংবা স্প্যানিশদের ঐতিহ্য। একটু খেয়াল করলেই ওদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা টের পাওয়া যাবে। ওরা হয় শাষকের জাত অথবা ওদের সংস্কৃতির মূল এতটাই গভীর যে ক্ষণিকের পরাধীনতাও তাদেরকে মূল থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ওদের মত বিশুদ্ধ সংস্কৃতি(এটলিস্ট থিওরিটিক্যালি) আমাদের নেই। হ্যা, ধর্ম অবশ্যই সংস্কৃতির উপরে বিশাল ভূমিকা রাখে। তবে আমরা মনে হয় বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না যে আমাদের সংস্কৃতি নিখাদ ধর্মনির্ভর। যুগ যুগ ধরে আমরা আর্য, মৌর্য, গুপ্ত, সেন, পাল, মুঘলসহ কতিপয় মুসলিম সুলতান ও ইংরেজদের কাছে পরাধীন ছিলাম। অনেকটা বেশি সময়ই হয়তো পরাধীন ছিলাম; তাই হয়ত আমরা আমাদের মূল হতে অনেক দূরে সরে এসেছি। একারণেই সম্ভবত বায়োলজিক্যাল ভাবে( ) আমরা একটু বেশি-ই বৈচিত্রময়। এটাও হয়ত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের এই জগাখিচুড়ি কালচারের প্রভাবক। ত্যানাটা না হয় আরো একটু প্যাচাই। আমার আসলে জানতে ইচ্ছা করে আর্যদের আসার আগে এই ভূখন্ডের মানূষ কেমন ছিল; তাদের সংস্কৃতি কেমন ছিল! সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তাধারা বদলাবে, আরো অনেককিছুই বদলাবে কিন্তু সংস্কৃতিটা সেভাবে বদলায় না। হয়ত কিছুটা বদলায় কিন্তু সেই বদলানোর হারটাও তুলনামূলকভাবে ভাষার পরিবর্তনের চেয়েও অনেক অনেক ধীর- আর অবশ্যই সেটা পোষাকী পরিবর্তন। মৌলিক পরিবর্তন যদি হয় তাহলেতো নিজেদের মূলকেই আমরা হারিয়ে ফেললাম, তাইনা? আসলে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল আমরা জাতি হিসেবেই সম্ভবত বিশুদ্ধ কোন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার না(নো অফেন্স ইন্টেন্ডেড); তাই আমাদের কালচার বা সংস্কৃতিটাও হয়ত স্বাভাবিকভাবেই এমন। তারওপর ধর্ম, রবীন্দ্রনাথ, নাস্তিক আর মৌলবাদীরা মিলে আমাদের কনফিউশন আরও বাড়িয়ে তুলছে। পহেলা বৈশাখ পালন করবেন- হয়ত আপনারই এক বন্ধু বলে বসবে- ব্যাটা তুই তো নাস্তিক অথচ সেই বন্ধুই হয়ত ঘরে বসে রবীন্দ্র সংগীত শুনছে। কিংবা কোন বন্ধু হঠাৎ করে ধার্মিক হয়ে গেলে, পাঞ্জাবী পায়জামা পড়া শুরু করলে তাকে আনস্মার্ট ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন অথচ আপনি নিজেই হয়ত ফেসবুকে ১৮+ পেজের ধর্মীয় পোস্টে লাইক শেয়ার দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের অশেষ নেকী হাসিল করে ফেলেছেন বলে ভাবছেন। যাইহোক এত বকর বকর করার উদ্দ্যেশ্য একটা কথাই পরিস্কার করা যে- আমরা ভীষন কনফিউজড জাতি। সেটা কালচার হোক আর যাই হোক- সবদিক দিয়েই...আর আমাদের কালচারটাও ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত; ভারতীয় কিংবা ইংরেজ অথবা আরবীয়দের থেকে! যাইহোক লেখায় বিতর্কিত বিষয়গুলো চলে আসছে। আপাতত ডাইভার্ট করি; পরে সু্যোগমত আবার এই বিষয়গুলোতে আসব।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের উপর সনাতনীয়, ইংরেজ ও প্রাচ্যের মুসলিমদের প্রভাব রয়েছে। যেকোন একটার প্রভাব থাকলেও হয়ত আজ আমাদের এতটা বেহাল দশা হত না। যেমন-মেক্সিকান ও স্প্যানিশ জাতি। তাদের মধ্যে আমি অনেক মিল খুজে পাই(যদিও অমিল অনেক আছে)। অবশ্য এই বৈচিত্র বাড়াটা আমাদের জন্য ভাল নাকি খারাপ হয়েছে সেটা বোঝার মত জ্ঞান আমার নেই। খোলা চোখে যেমনটা দেখি- আমাদের মা,বোনরা সারাদিন হিন্দী সিরিয়াল দেখে ওদের মত চালচলন শিখছেন; বাচ্চারা ছোটবেলায় মীনা কার্টুন না দেখে ডোরেমন দেখছে আর বাংলার বদলে হিন্দী শিখছে(চাক্ষুশ প্রমাণ আমার পিচ্চি মামাতো ভাই), বাংলা লিখা কস্ট বলে আমরা ইংরেজী হরফে বাংলা লিখে এক এক জন মুরাদ টাকলা হচ্ছি কিংবা আরজে দের উদ্ভট বাংলা উচ্চারণকে স্মার্টনেস হিসেবে ধরে নিয়েছি। ফ্রেন্ডরা মেটালিকা ছাড়া গান শুনে না, আবার গার্লফ্রেন্ডের পছন্দ “তুম হি হো”। কেউ একজন প্রচলিত নিয়মের দিকে আঙ্গুল তুললে তিনি নাস্তিক হয়ে যান; আবার তেতুল বাবারাই ধর্মের ধারক-বাহক হয়ে থাকেন। বোমা ফাটিয়ে মানুষ মারলেও তারা ধর্মের সৈনিক অথচ ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেওয়া হয় ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে(ইংরেজী থেকে অনুবাদ করলে মূর্তি আর ভাস্কর্যের পার্থক্য নেই; পার্থক্যটা আসলে ভাবের প্রকাশে!)। খেলার মাঠে কি রাজনীতিতে আমাদের কেউ কেউ এখনো মন থেকে অন্য দেশকেই সাপোর্ট করি। বিশ্বকাপের সময় বেহায়ার মত অন্যদেশের পতাকা বাড়ির ছাদে গর্বভরে ওড়াই; অথচ কিনা নিজ দেশের পতাকার প্রাপ্য সম্মানও অনেক সময়ই আমরা দেই না। আর জ্ঞানী-গুনীর অনাদরও মনে হয় আমাদের মত কেউ করে না! দূর্নীতি থেকে শুরু করে ক্ষমতার লালস; মাতৃভুমির অবহেলা থেকে বিজাতীয় শক্তির আগ্রাসনকে প্রশ্রয়; পোষাক-আশাকের ট্রেন্ড থেকে শুরু করে সুন্দরী প্রতিযোগীতা- কোনটা যে আমাদের সংস্কৃতি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনে। অবশ্য এটাও হতে পারে সবই ঠিক আছে; শুধু আমার বুদ্ধিতেই কুলোচ্ছে না বলে হয়ত আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেছি
আসলে আমার মনে হয় আমরা সম্ভবত কোন একটা বিশুদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নই আর আমাদের সংস্কৃতিটা শতভাগ কেমন সেটাও হয়ত আমরা জানিনা তবে এটুকু বুঝতে পারি যেগুলোকে আমরা সত্যিই আমাদের নিজস্ব বলে মনে করি সেগুলোকে যদি আমরা পরম মমতায় আকড়ে ধরি; আর বিজাতীয় অরুচিকর জিনিষগুলো বর্জন করি তাহলে হয়ত জাতি হিসেবে আমরা আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারব ।
(মুখবন্ধ এর জন্য সংরক্ষিত জায়গা)
বাধা ছিল মন কিছু স্বার্থের মায়াজালে...