টপিকঃ রাজনীতিবিদগণ না হয় খারাপ, কিন্তু নাগরিক সমাজ কী গর্দভ নয়?

আমেরিকার সাথে প্রায় এক দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, আমাদের এশিয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভিয়েতনাম ১৯৮১ সালে নতুন করে সবকিছু শুরু করেছিল। তাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার নয়-দশ বছর হয়ে গেছে। এখন যদি আমরা ২০১৩ সালের ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের মানুষের জবন যাত্রার মানের দিকটা তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে আমরা তাঁদের চেয়ে ছয়-সাত গুণ পিছিয়ে রয়েছি। স্বাধীনতার আশীর্বাদে জীবনমান উন্নতি যে আমাদেরও হয়নি, এমন নয়। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চললে আমরা আরো ভাল থাকতাম। আমাদের দূর্ভাগ্য যে আমাদের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্মটি একটা গর্দভ প্রজন্ম হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে। এই সত্যটা তাঁদের নির্দ্বিধায় স্বীকারও করে নেওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা গর্দভ বলেই সেটা স্বীকার করবে না। এবং এটা মোটেই অবাস্তব কল্পনা নয়, যে আরো অনেক দিন কাজের কাজ বাদ দিয়ে, আমরা তাঁদের মূখ থেকে শুধু প্রতিপক্ষের চরিত্র হরণের কাহিনীই শুনে যাব।
          আমার মূল উদ্বেগের বিষয় অবশ্য এটা নয়। আমার মনে হয়, অত্যন্ত ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েও আমরা সবাই এসব মেনে নিয়েছি। আমরা ধরে নিয়েছি, যে এই প্রজন্মের নেতৃত্ব থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারি না। আমাদের আশা করা উচিত নয়। কারণ অভিজ্ঞতা বলে, এমন কিছু প্রজন্ম বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এসেই থাকে। তাঁদের কোনো কোনোটা জাতিকে উজ্জল করে, আবার কোনো কোনোটা জাতিকে বিবর্ণ করে রাখে। ভাল প্রজন্মগুলোর উদাহরণ হিসেবে আমরা মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের প্রজন্মের কথা বলতে পারি। যাঁরা মালয়েশিয়াকে মাটি থেকে একেবারে আকাশে তুলে দিয়েছে। আমরা বলতে পারি বর্তমান স্প্যানিশ ফুটবলের কথা। অতীতে কোনো সময়ই ফুটবলে তাঁদের এমন সর্বজয়ী একটি প্রজন্ম ছিল না। এই প্রজন্মটি তাঁদের জাতির মূখ উজ্জল করেছে। পুরো স্পেনবাসীকে চার-পাঁচ বছর ধরে গর্বিত করে চলছে। তাঁরা প্রতিভাবান প্রজন্ম। পক্ষান্তরে আমাদের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্মটি ঠিক তার উল্টো। কিন্তু আমাদের পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থ্য রাখে, এমন আর একটি প্রজন্মও যেহেতু বিদ্যমান রয়েছে, তাই এখানে উচিত হবে না শুধু রাজনৈতিক প্রজন্মটিকেই দোষ দিয়ে যাওয়া। কারণ নাগরিক সমাজের নেতৃত্বদানকারী প্রজন্মটিওতো দীর্ঘদিন ধরে সমভাবে গর্দভের পরিচয় দিয়েই আসছে। আমার এই লেখাটি তাঁদের উদ্দেশ্য করেই। অন্যের চরিত্র হরণের বেলায় তাঁরা যে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ে বসবাস করেন, তাঁরা এই দেশ ও জাতির জন্য কতটুকু কি করার চেষ্টা করেছেন? আদৌ কি কোনোদিন কিছু করার কথা ভেবেছেন?
          আমার মনে হয় না তাঁদের সেই ইচ্ছে বা আগ্রহ কোনোটা আছে। তাঁরা ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট; উভয় মিডিয়ার শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি নিয়ন্ত্রণ করেন। আমরা টক শো-তে তাঁদের কথা বলতে দেখি। আমরা পত্রিকায় তাঁদের কলাম লেখতে দেখি। এভাবে প্রতিদিন তাঁদের উপস্থিতি টের পাই। যদি কোথাও একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে; তাহলে আমরা দেখি প্রতিদিনের কিছু চেনা মূখ একটা গোল টেবিল বৈঠকে টেবিলটাকে ঘিরে বসেছেন। প্রত্যেকের সামনে একটা করে পানির বোতল। সেখানে তাঁরা কিছু অসাড় বক্তব্য দেন। কিন্তু তাতে যেটুকু কাজ হয়, তা বিবেচনায় নিলে মনে হতে বাধ্য, যে এই বক্তব্য আসলে কিছু নয়। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য টিভিতে খবরের একটা অংশ হওয়া; এবং পরদিনের পত্রিকায় ছাপার জন্য ক্যামেরার সামনে সুন্দর একটা পোজ দেওয়া। কিন্তু তাঁদের কে বুঝাবে যে, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর একজন ধর্ষিতা তাঁদের চেহারা দেখার অপেক্ষায় বসে থাকে না। মোট কথা আমরা নাগরিক সমাজের কাছ থেকে আরো বেশি কিছু চাই। কারণ সেটা দেওয়ার ক্ষমতাটুকু তাঁদের আছে। আমাদের সেটা এই মুহুর্তে নেই। যদি থাকত আমরা সর্বোচ্ছ চেষ্টাটাই করতাম।
          তাঁরা প্রতিদিন টিভিতে সবজান্তা সেজে প্রচুর ভাল ভাল কথা বলেন। পত্রিকায় সুন্দর সুন্দর কলাম লেখেন। আমিও এই মাত্র লেখলাম। কিন্তু প্রায় সবাইকেই দেখি একটা না একটা পক্ষ নিয়ে কথা বলতে। পক্ষ নেওয়া খারাপ আমি সেটা বলছি না। পক্ষপাত ন্যায়ের দিকে হলে তার চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে? আমাদের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যে ন্যায় থেকে অনেক দূরে বসে, ন্যায়ের পাশে বাস করছেন বলে মনে মনে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে রয়েছেন, সেটাই জাতির জন্য চরম দূর্ভাগ্যজনক। তাঁরা তাঁদের ওজন সম্পর্কে অসচেতন। তাঁরা হয়তো জানেন না দলীয় লেজুর বৃত্তি পরিহার করে, ন্যায়ের পথে এক জোট হলে তাঁদের সম্মিলিত শক্তি আমাদের দেশের বিরাট সংস্কার বয়ে আনতে পারে। আমি সেই সব সংস্কারের কথা বলছি যা আমাদের এই মুহুর্ত হতেই খুব দরকার। দরকার ছিল আরো আগে থেকেই। আমাদের পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার দরকার। পুরোনো নিয়ম-নীতিতে আর চলে না। এটা কি অসম্ভব? দেশে অনেক বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তারা জীবিত আছেন, যারা এ মুহুর্তে অবসর জীবন-যাপন করছেন। তাঁরাইতো নাগরিক সমাজের একটা অংশ। তাঁদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও আছে নিশ্চয়ই, যে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কি কি সংস্কার দরকার। তাঁরা তেমন একটা ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়েল তৈরী করে, নাগরিক সমাজের সবাইকে নিয়ে সেটা বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ চাপ সৃষ্টি করতে পারেন। নাগরিক সমাজের সম্মিলিত টানা চাপ প্রয়োগ, আর প্রচারণাই পারে পুলিশ বাহিনীকে দলীয়করণের হাত থেকেও চিরতরে রক্ষা করতে।
          ভাবা যায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা বড় ধরণের অপরাধ করে ধরা পড়লেও; আমরা তাঁর শাস্তি হতে দেখি, বড়জোর এক থানা থেকে আর এক থানায় বদলি। অথচ কখনোই চাকরীচুত্য হতে দেখি না। আমি এটা বলছি না যে সবাইকে চাকরীচুত্য করে দিন। আমাদের ভূমি আইনেও সংস্কার দরকার। আইন-আদালতেও সংস্কার দরকার। ছাত্র রাজনীতিতে সংস্কার দরকার। শিক্ষায়ও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। যদি কেউ বলে ঢাকা শহরে সদিচ্ছা থাকার পরও যানজট সরানো, আর শহরটাকে পরিষ্কার পরিছন্ন করার জন্য পাঁচ বছর সময় যথেষ্ট নয়; তাহলে আমি তাঁকে টোকিওর দিকে তাকাতে বলব। আসলে সংস্কার প্রয়োজন এমন সব বিষয়ে ভাল জ্ঞান রাখেন, এমন মানুষের অভাব নেই এই দেশে। কেবল তাঁদের এক হয়ে দেশের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার আনার ইচ্ছে নেই; এটাই আমাদের দূর্ভাগ্য। আমাদের যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করন, এটা কি রাজনীতিবিদেরা আমাদের জন্য করে দেবেন? আমরা জানি স্বার্থ-বিরোধী কাজ তাঁরা কখনোই করতে যাবেন না। তাঁরা সংসদ সদস্য হয়েছেন বলে, সংসদে গিয়ে আগে নিজেদের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আইন তৈরী করবেন। আইন তৈরী করবেন শুল্কমুক্ত গাড়ি যাতে কেনা যায়। আইন তৈরী করবেন, নিজেদের আয়কে কীভাবে করমুক্ত রাখা যায়। আইন তৈরী করবেন, কীভাবে নিজেদের অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য; সব বাহিনী থেকে চৌকস কর্মী নিয়ে, একটা স্পেশাল বাহিনী গঠন করে, নিজেদের গার্ড হিসেবে সব সময় রাখা যায়। কিন্তু আমরাতো আমাদের কাজটি উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা এক সাথে বসে একটা নীতিমালা প্রস্তুত করে, সেটা বাস্তবায়নের কাজে নামতে পারেন। এভাবে আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কার চাই। আর দেখতে চাই না, যে সোনালী ব্যাংকের ৪০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েও; কেবল কোনো স্পষ্ট আইন না থাকার কারণে, একজন অপরাধীকে কিছু করা যাচ্ছে না। দেখতে চাইনা, যে এত বড় শেয়ার কেলেঙ্কারী করেও; কেউ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, শুধু আইনের দুর্বলতার কারণে। দেখতে চাই, না দুদক কাজ করতে পারছে না, অদৃশ্য শেকলে বন্ধি থাকার কারণে। পুলিশ খুনিকে ধরতে পারছে না, বড় সাহেব না বলে রাখার জন্য। আমরা সবকিছুর পরিবর্তন চাই। আমরা এ দেশে আমেরিকার মত গণতন্ত্র চাই। যাঁরা বলেন এটা অসম্ভব। তাঁদের উচিত সব ছেড়ে দিয়ে, অন্ধকার ঘরে গুটিসুটি মেরে থাকা। কারণ তাঁরাই আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার করেছেন।
          আমরা গাড়িতে চড়লে, দুর্নীতি করে কেনা ড্রাইভারের অদক্ষতা, আর দুর্নীতি করে তৈরী ভাঙা রাস্তায়, এক্সিডেন্টে তাঁদের জন্যই মারা যাচ্ছি। তাঁদের জন্যই আমরা গ্র্যাজুয়েট হয়েও; ঘুষ অথবা দলীয় পরিচয় ছাড়া একটা চাকরী পাই না। তাঁদের জন্যই একটা খুনের জন্য, ত্রিশ জন আসামী হয়ে আমরা নিরপরাধ মানুষেরা দৌঁড়ের ওপর থাকি। তাঁদের জন্যই আমরা গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের জন্য বৈদেশিক মূদ্রা আয় করেও; জীবনের নিরাপত্তা পাই না। তাঁদের জন্যই আমরা প্রবাসীরা, সবগুলো অর্জিত বৈদেশিক মূদ্রা দেশে পাঠিয়ে দিয়েও; দূতাবাস থেকে গরু-ছাগলের অনুরূপ ব্যবহার পাই। তাঁদের জন্যই আমাদের রক্ত দিয়ে অর্জিত বৈদেশিক মূদ্রা আবার চলে যায়, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ গুলোর ব্যাংকে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া, কিছুই করতে পারি না। এজন্য আমি মনে করি গর্দভ নাগরিক সমাজের দায়টা সবচেয়ে বেশি বললেও ভূল হবে না।
          আমার লেখাটা শেষ করব, একজন খুবই বিখ্যাত ব্যাক্তির বিখ্যাত একটা উক্তি দিয়ে। তিনি একবার বলেছিলেন, “পৃথিবী খারাপ মানুষদের খারাপ কাজের জন্য কখনোই ধ্বংস হবে না। পৃথিবী ধ্বংস হবে এ কারণে যে, ভাল মানুষেরা তাঁদের বাঁধা দেবে না বলে”। সত্যিই তাই। আপনারা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি যত তুলসী পাতাই হোন, দায়টা কখনোই এড়াতে পারবেন না। আমাদের ভবিষ্যত ধ্বংস করার জন্য; ইতিহাসের তৈরী জাহান্নামের লাইনে, মাথায় লাল পট্টি বেঁধে আপনারাই থাকবেন সামনের সারিতে।

Re: রাজনীতিবিদগণ না হয় খারাপ, কিন্তু নাগরিক সমাজ কী গর্দভ নয়?

লাল টেলিফোনে রেকর্ডিং করা যায় না তাই লাল টেলিফোন ব্যাবহার করাই হয়নি কিন্ত বলা হয়েছে লাল টেলিফোনে ফোন করা হয়েছিলো - আমরা আমজনতা সবই বিশ্বাস করি

Re: রাজনীতিবিদগণ না হয় খারাপ, কিন্তু নাগরিক সমাজ কী গর্দভ নয়?

Re: রাজনীতিবিদগণ না হয় খারাপ, কিন্তু নাগরিক সমাজ কী গর্দভ নয়?