টপিকঃ পানি জীবানুমুক্ত করণের উপায়সমূহ - ২
লিংকঃ পানি জীবানুমুক্ত করণের উপায়সমূহ - ১
আগের পর্বে ভৌত পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা হয়েছিল। এবার দেখুন রাসায়নিক পদ্ধতিসমূহ:
৩ রাসায়নিক পদ্ধতিসমূহ
রাসায়নিক পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা করার আগে একটি আদর্শ জীবানুনাশক থেকে কী কী গুনাবলী আশা করা উচিত সেটা জেনে নিলে আলোচনায় সুবিধা হবে। তাই প্রথমে ভাল জীবানুনাশকের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করা হল:
৩.১ একটা ভাল জীবানুনাশকের কী কী বৈশিষ্ট থাকা উচিত
দ্রুত ও কার্যকর ভাবে রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু বিনাশ করতে সক্ষম
সহজে পানিতে মিশে যায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাইপে বা অন্য কোন উৎস থেকে সংক্রমণ হলে সেটাকেও প্রতিরোধ করার জন্য থেকে যায়
পানির স্বাদ, গন্ধ ও বর্ণ নষ্ট করে না; পানিকে ঘোলা করে না
মানব ও অন্য প্রাণীদেহের জন্য ক্ষতিকর বা বিষাক্ত নয়
সহজেই অস্তিত্ব সনাক্ত করা যায় ও ঘনমাত্রা মাপা যায়
সহজে পরিবহন, সংরক্ষণ এবং প্রয়োগ করা যায়
সহজলভ্য এবং সস্তা
৩.২ ক্লোরিন দ্বারা
ক্লোরিন বিভিন্ন রূপে পানির জীবানুনাশ করার জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি কেমিকেল। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পানিশোধনে ক্লোরিন ব্যবহার শুরুর করার পর সারা বিশ্বে পানিজনিত রোগে মৃত্যূহার অনেক হ্রাস পেয়েছে। একটি ভাল জীবানুনাশকের অনেকগুলো বৈশিষ্টই ক্লোরিনে রয়েছে তবে তা সত্ত্বেও ক্লোরিন দিয়ে জীবানুনাশে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এটা বহুল ব্যবহৃত ও সহজলভ্য হওয়াতে এর প্রয়োগের কিছু খুটিনাটি দিক এখানে উল্লেখ করা হল।
পানিকে জীবানুমুক্ত করতে কতক্ষণ ধরে কী মাত্রার ক্লোরিন প্রয়োগ করতে হবে সেটা বেশ কয়েকটা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। অপেক্ষকৃত বেশি তাপমাত্রায় ক্লোরিন দ্রুত কাজ করে - অর্থাৎ শীতকালে সময় একটু বেশি লাগবে। এছাড়া পানির pH এর উপর ক্লোরিনের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। এটা বুঝতে নিচের সমীকরণ দেখি:
Cl + HO → HOCl + HCl এবং এরপরে HOCl <==> H+ + OCl¯
অর্থাৎ পানিতে ক্লোরিন মেশালে সেটা হাইপোক্লোরাস এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপন্ন করে। আবার এই হাইপোক্লোরাস এসিড বিযোজিত হয়ে হাইপোক্লোরাইট আয়ন আকারেও থাকতে পারে। কখন কোন রূপে থাকবে সেটা পানির pH এর উপর নির্ভর করে। কম pH এ সরাসরি ক্লোরিন আকারে থাকে যা জীবানুনাশে সর্বাধিক কার্যকরী। মাঝামাঝি pH এ অর্থাৎ সাধারণ পানিতে এটা হাইপোক্লোরাস এসিড আকারে থাকে – এটাও জীবানুনাশে খুবই কার্যকর; তবে উচ্চ pH তথা ক্ষারীয় পানিতে এটা হাইপোক্লোরাইট আয়ন আকারে থাকে যার জীবানুনাশী ক্ষমতা অনেক কম। পানি শোধনাগারে অনেক ক্ষেত্রেই ম্যাঙ্গানিজ এবং খরতা দুর করার জন্য চুন মেশানো হয় যা পানির pH বাড়িয়ে দেয়। ক্লোরিন প্রয়োগের আগে সেই পানির pH কমিয়ে নিতে হবে।
পানিতে জৈব যৌগ থাকলে সেটার সাথে ক্লোরিনের বিক্রিয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বস্তু/যৌগ উৎপন্ন হতে পারে – যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে পানি সরবরাহের কাজে যে পরিশোধিত পানি ব্যবহার করা হয় তাতে সাধারণত জৈব যৌগ থাকে না - তাই রক্ষে। তা সত্বেও মাধ্যমিক উৎস থেকে জৈব যৌগ পানিতে মিশতে পারে, তাই উন্নত দেশে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় এই ক্ষতিকারক যৌগ আছে (তৈরী হয়েছে) কি না তা নিয়মিত মনিটর করা হয়।
পানির সরবরাহ লাইনের কোন ছিদ্র বা ফাটল দিয়ে কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে মধ্যবর্তী দূষণ ঠেকাতে সরবরাহকৃত পানিতেও কিছু মাত্রায় (০.০৫ মিলিগ্রাম/লিটার) ক্লোরিন মিশিয়ে দেয়া হয়। তবে এই মাত্রার ক্লোরিন পানিতে রাখার জন্য কত মাত্রায় ক্লোরিন মেশাতে হবে তা ল্যাবরেটরীতে পানির নমুনাতে পরীক্ষা করে বের করতে হয়। কারণ প্রাথমিক ভাবে ক্লোরিনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্লোরিন খরচ করার মত অনেক উপাদান থাকে যা প্রযুক্ত ক্লোরিনকে খরচ করে ফেলে। এছাড়া পানিতে অ্যামিন জাতীয় যৌগ থাকলে সেগুলোও ক্লোরিন খরচে বিক্রিয়া করে, শুরুর দিকে এই যৌগে থাকা ক্লোরিন উপস্থিতি জানান দিলেও শেষ পর্যায়ে হুট করে গায়েব হয়ে যায়, ফলে দ্রবণে ক্লোরিনে মাত্রা বাড়ার পর আবার কমে যায়। তাই এই দুই পর্যায়ে ক্লোরিন খরচ পার করে তারপর পানিতে উদ্দিষ্ট মাত্রার ক্লোরিন পেতে যতটুকু প্রয়োগ দরকার সেটা নির্নয় করতে হয়। এই পদ্ধতিকে Break point chlorination বলা হয়। এভাবে প্রযুক্ত ক্লোরিনও মাঝপথে বিক্রিয়া করে শেষ হয়ে যেতে পারে, কিংবা খোলা পানিতে (রিজার্ভ ট্যাংকে) উদ্বায়ী রূপে বাতাসে মিশে যেতে পারে।
বিভিন্ন পদার্থকে ক্লোরিনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেমন: ক্লোরিন গ্যাস, ব্লিচিং পাউডার বা ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট Ca(OCl)Cl (৩৩% পর্যন্ত ক্লোরিন থাকে), হাই-টেস্ট হাইপোক্লোরাইট (৬০ – ৭০% ক্লোরিন), সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (১২ – ১৫% ক্লোরিন)।
এছাড়াও জরুরী অবস্থায় পানি শোধন কাজে হ্যালোট্যাব বা ক্লোরিনের ট্যাবলেট ফার্মেসিতে পাওয়া যায়। কত পরিমাণ পরিষ্কার পানিতে একটি ট্যাবলেট দিতে হবে সেটা ট্যাবলেটের ফয়েলে/মোড়কে লেখা থাকে। ২০০১ সালের দিকে ৫ টাকায় ১০টা ট্যাবলেটের এক পাতা কিনতে পাওয়া যেত, যার একটা ট্যাবলেট দিয়ে ৩ লিটার পানি জীবানুমুক্ত করা যেত। পানিতে কিছুটা ক্লোরিন তথা ব্লিচিংপাউডার টাইপের গন্ধ থাকে। গৃহস্থালীতে এভাবে পানি শোধন করে সেই পানিকে সামান্য গরম করলেই সমস্ত গন্ধ চলে যাওয়ার কথা। আমাদের দেশে মানুষ পানিতে ক্লোরিন তথা ব্লিচিং-এর গন্ধ পেলে নাক সিটকায়, অথচ উন্নত বিশ্বে বরং এই গন্ধ পেলেই পানি পান করতে নিরাপদ বোধ করে মানুষ, আর সরবরাহকৃত পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ না থাকলেই সেই পানি পান করতে ইতস্তত করে।
বলাই বাহুল্য যে, ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত পানির একটা বড় অংশ ডিপ টিউবওয়েলের পানি, যাতে শুরুতে জীবানু থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে সরবরাহ লাইনে লিক দিয়ে দূষণ হওয়া অসম্ভব নয়। অনেক এলাকাতেই পানির লাইন পয়ঃনিষ্কাশন নালার মধ্যদিয়ে গিয়েছে – যা অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ। বিশেষত আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় পাইপগুলোতে সর্বদা পানির চাপ থাকে না, বরং দিনের নির্দিষ্টি কিছু ঘন্টায় পানি ছাড়া হয়। যখন এই পাইপগুলোতে পানি সরবরাহ হয় তখন চাপের কারণে বাইরের দূষণ এর ভেতরে ঢুকতে পারবে না বরং ভেতরের পানি-ই ছিদ্র বা লিক দিয়ে বের হয়ে আসবে; কিন্তু অন্য সময়ে প্রবাহের চাপ না থাকায় বাইরের দূষিত পানি পাইপে প্রবেশ করতে পারে। এছাড়া বাসা-বাড়ির নিচতলায় এবং ছাদে পানির ট্যাংকিগুলো পানিতে জীবানু প্রবেশের অন্যতম পথ। তাই এই ট্যাংকিগুলো এবং ব্যবহারের শুরুতে পুরা পানি সরবরাহ পাইপগুলোকে জীবানুমুক্ত করে নেয়া জরুরী। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে একটা জেরিকেনে ব্লিচিং গুলে সেখান থেকে ট্যাংকির পানিতে ফোটায় ফোটায় পড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিয়মিতভাবে দৈনিক ফ্রেস ব্লিচিং দ্রবণ দিলে জীবানুর সম্ভাবনা তো কমবেই, বরং পানি ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ফুরাতে পারে।
৩.৩ ওজোন দ্বারা
ওজোন হল অক্সিজেনের একটা অস্থিতিশীল আইসোটোপ যার মধ্যে তিনটি অক্সিজেন পরমানু রয়েছে (O)। ওজোনের অনুটি ভেঙ্গে দুই পরমানু বিশিষ্ট এবং স্থিতিশীল অক্সিজেন হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় একটি মুক্ত এবং ভীষণভাবে সক্রিয় অক্সিজেন পরমাণু উৎপন্ন হয়। এই সক্রিয় অক্সিজেনের ফলে সমস্ত জীবানু নষ্ট হয়ে যায়, এছাড়াও পানির বর্ণ ও গন্ধ সৃষ্টিকারী বাকী সব উপাদানও দুর হয়ে যায়। ওজোনকে প্রাকৃতিক জীবানুনাশক বলা হয়, এবং এটা জীবানুনাশে খুবই কার্যকরী একটা গ্যাস।
ওজোন ব্যবহার করে পানির জীবানু দুর করলে সেখানে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছু উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই এটা নিঃসন্দেহে ক্লোরিনের চেয়ে ভাল। তবে সমস্যা হল, এটি একটি অস্থায়ী গ্যাস: তাই সরবরাহকৃত পানিতে অন্য উৎস থেকে আগত কোন জীবানু মারার জন্য এটাকে প্রবাহিত করানো যায় না। উন্নত দেশগুলোতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ওজোনের ব্যবহার বাড়লেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এটার প্রাথমিক উচ্চ বিনিয়োগের কারণে তেমন ব্যবহৃত হয় না।
এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে গৃহ বা হাসপাতালে কলের পানির জীবানুমুক্ত করার জন্য ছোট ওজোন জীবানুনাশক বের হয়েছে। এগুলো কলের সাথে লাগিয়ে দিলে সেই পানির গতিশক্তিকে ব্যবহার করে ওজোন উৎপন্ন করে, ফলে যন্ত্রের অন্য প্রান্ত দিয়ে জীবানুমুক্ত পানি বের হয়। এই পানি দিয়ে ক্লিনিকে ডাক্তারগণ যেমন হাত ধুয়ে জীবানুমুক্ত করতে পারবেন, তেমনি ফলমূল ধুয়ে খেলেও সেগুলো জীবানুমুক্ত হয়ে যাবে।
চিত্র ২: কলের সাথে লাগানোর উপযুক্ত ওজোন উৎপাদক জীবানুনাশক
৩.৪ আয়োডিন এবং ব্রেমিন দ্বারা
আয়োডিন এবং ব্রোমিন ছোট পরিসরে পানি পরিশোধনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। স্বচ্ছ পানিকে জীবানুমুক্ত করতে এটা সর্বোচ্চ ৮ – ১৫ মিগ্রা/লি. ঘনত্বে প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে। ওষুধ ওষুধ গন্ধের কারণে এটা মানুষের পছন্দ হবে না, তাই শুধুমাত্র অতি জরুরী প্রয়োজনেই এগুলোর ব্যবহার সীমিত রাখা হয়।
এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে, টিংচার আয়োডিন নামক একটি আয়োডিন দ্রবণ অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে এখন ওটার চেয়ে কম বিষাক্ত পোভিডন আয়োডিন নামক বাদামী বর্ণের একটি দ্রবণ ডাক্তারগণ জীবানুনাশক হিসেবে ক্ষতে ব্যবহার করেন।
চিত্র ৩: ক্ষতে পোভিডন আয়োডিন দেয়া হচ্ছে (উৎস: উইকিপিডিয়া)
৩.৫ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্বারা
পানিতে মেশালে গোলাপী বা বেগুনী রং ধারণ করা এই কেমিকেলটি পাউডার সদৃশ পদার্থ আকারে পাওয়া যায়, এর রাসায়নিক সংকেত: KMnO। এই শক্তিশালি জারকটি কলেরার জীবানুর বিরূদ্ধে খুবই কার্যকর হলেও অন্য রোগ সৃষ্টিকারী জীবানুর জন্য তেমন কার্যকারীতা লক্ষ্য করা যায় নি। এর রঙের কারণে এটা পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় কার্যকর জীবানুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। তবে পানি পরিশোধনের আগে জমা রাখার আধারে (লেক, জলাশয়) জীবানু নিয়ন্ত্রণে এটা বেশ ব্যবহৃত হয়।
এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে, অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবেও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষত হাত পায়ে ফাংগাল ইনফেকশনে জীবানুনাশক বা ঔষধ হিসেবে এটি লাগানো হয়।
চিত্র ৪: পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবন (উৎস: উইকিপিডিয়া)
(চলবে ?)
===
শেষ পর্বে যা থাকবে:
৪ কিছু সাধারণ ব্যবহারিক প্রয়োগ পদ্ধতি
৪.১ পানির ট্যাংকি, সরবরাহের পাইপ জীবানুমুক্তকরণ
৪.২ টিউবওয়েল জীবানুমুক্তকরণ
৪.৩ পাতকূয়া এবং পুকুর জীবানুমুক্তকরণ
৫ তথ্যসূত্র
পুরো ডকুমেন্টটির প্রিন্টযোগ্য পিডিএফএর ডাউনলোড লিংক