টপিকঃ মিলার মুক্তি এবং অচেনা এক যুবক পর্ব-১
১.
মিলার মনটা বেশ খারাপ। শিহাব গত রাতেও ফেরে নি। এখন এরকম প্রায়ই হচ্ছে। হুট করে ফোন করে বলে কাজে আটকে গেছে। শিহাবকে চাকরি সূত্রে মাঝে মাঝেই এই শহর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হয়। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতেও কি চাকরি থাকে? জিজ্ঞেস করলেই আগডুম বাগডুম একটা বুঝিয়ে দেয়। মিলা কি সেসব বোঝে না? সে সবই বোঝে। অনাদর কিংবা উপেক্ষাটা চাপা থাকছে না ইদানীং। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। কী লাভ?
চমৎকার সাজানো বেডরুমের শূন্য কিং সাইজ বিছানাটা কি একধরণের নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নয়? মনে হচ্ছে বিশাল সমুদ্রে একা শুয়ে আছে! আজকের সকালটাও কেমন কেমন যেন। থমথমে মুখের মেঘেদের নিয়ে গোপন কোনো অভিমানে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। জানালা দিয়ে টুকরো বিষন্ন আকাশটা দেখে এসবই ভাবছিলো মিলা। এই দু’বছরে বেডখানা কেবল উপহাসই করে গেলো!
বেলা একটু একটু ধীর পায়ে বাড়ছে। ছুটির দিনে উঠতে ইচ্ছে করছে না। উঠে করবেইটা কী? শিহাব নেই তো নাস্তা করবে কার জন্য? নিজের জন্য কোনোদিনই ভাবনা থাকে না মিলার। যাহোক একটা কিছুতে বরাবরই সন্তুষ্ট থেকে এসেছে। নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কখনো উচ্চকণ্ঠ হতে দেখেনি কেউ তাকে। তাই যখন শিহাবের সাথে সম্বন্ধটা এলো, রাজী হয়ে গেলো এক রকম। যোগ্য ছেলে। মাল্টি ন্যাশনালে ভালো চাকরি করে। যদিও বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশিই ছিলো। কিন্তু কেউ গা করলো না! তবে গোপনে কি বুকটা ভিজেছে একটু? রঞ্জুকে কি ভালোবেসেছিলো ও? তবে সেও তো এক তরফাই ছিলো। ঐ যে নিজের কোনো ব্যাপারই গা করে না। ঐটিও এক প্রকারের একটা অপ্রকাশ্য গল্পের মত হয়ে থাকলো!
এইসব গভীর ভাবনায় কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো মিলা। সম্বিৎ ফিরে পেলো ফোনের শব্দে। আলগোছে তুলে নিয়েছিলো তাই খেয়াল করে নি নাম্বারটা।
হ্যালো? কে বলছেন?
অলস ঝিমঝিমে গলায় শুধায় মিলা। ওপাশে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। বেশ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো। বার কয়েক জিজ্ঞেস করেই কেটে দিলো। দেখতেও ইচ্ছে করলো কে করেছে। মরুক সব! আবার ভাবনাতে ডুবে যাবে অমনি আবার বেজে উঠলো। এবার নাম্বারটা দেখলো। রাগে গা জ্বলে গেলো। আবার সেই লোকটা...
ফোনটা বেজেই চলেছে। বাজতে বাজতে এক সময় থেমেই গেলো। ইচ্ছে করলেই মিউট করে রাখতে পারে। কিন্তু আজ কী যে হয়েছে... কেমন যেন উপেক্ষা ভাব সব কিছুতে। ফোনটা খানিক বিরতি নিয়ে আবার বেজে উঠলো। কী সুন্দর একটা রিংটোন সেট করেছিলো – বৃষ্টির একটানা ধারাপাতের শব্দ! সেটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। আবার কিছু বিরতিতে বেজে উঠলো। প্যাটার্নটা পরিচিত হয়ে গেছে। এ সে-ই হবে। আর কেউ নয়! আচ্ছা ছ্যাঁচোড় তো। না ধরা পর্যন্ত জ্বালাতেই থাকবে।
ব্যাপারটা শুরু হয়েছে প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে। কীভাবে নাম্বার যোগাড় করেছে, কে জানে? খুব একটা কথা বলে না। শুধু জিজ্ঞেস করে – ভালো আছেন? আর একটা গুড়গুড়ে হাসি। ব্যস এটুকুই। কখনোই জবাব দেয় না মিলা। এই সামান্য বিষয়টাকে পাত্তা দেবে না বলে ঠিক করেছিলো। তাই কাউকে জানায় নি। শিহাবকেও না। এ কি বলার মত কিছু? কিংবা হয়তোবা কিছু একটা কি আছে? আজকে হঠাত করে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। ঐ আবার বাজছে।
ফোনটা ধরলো মিলা। রাগত স্বরে – কেন জ্বালান আপনি? কথাও তো একটা বলেন না! শুধু জিজ্ঞেস করেন ভালো আছি কিনা! কী চান আপনি? ভালো নেই, আমি ভালো নেই! খুশি? গলা ধরে আসে মিলার।
ওপাশে এই প্রথম বারের মত কণ্ঠটা চিরাচরিত গৎবাঁধা প্রশ্নটা করলো না। হাসলোও না। একটু যেন বিচলিত! গমগমে ভরাট কণ্ঠে একটু কেশে – ভালো নেই? কেন?
মিলা ঝেঁঝে উঠে – সেটা আপনাকে কেন বলবো?
বলবেন না? তাহলে বলতে গেলেন কেন ভালো নেই?
আমার যা ইচ্ছা তা-ই করবো, আপনি কৈফিয়ত চাওয়ার কে, শুনি?
আমি কেউ না।
ঠিক, আপনি কেউ না। দয়া করে আর জ্বালাবেন না। রাখছি।
না, রাখবেন না, প্লীজ।
কেন রাখবো না?
কারণ আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন। একটা খুক করে হাসির শব্দ আসে। রাগ বাড়তে থাকে মিলার।
আপনি অন্তর্যামি, তাই না? আমাকে না চিনেই সব বুঝে ফেললেন।
চিনি না, কে বললো? আলবৎ চিনি।
চেনেন, আশ্চর্য! আমি তো আপনাকে চিনতে পারছি না। মিলার কন্ঠে খানিকটা উষ্মা।
কথা বলতে থাকেন। বলতে বলতেই চিনে যাবেন।
আমার অত চেনাজানায় কাজ নেই। বিরক্তিকর একটা! বলেই খুট করে কেটে দেয় মিলা।
চলবে....
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।