টপিকঃ পানি জীবানুমুক্ত করণের উপায়সমূহ
পানিজনিত রোগের একটা মূল কারণ হল পানিতে থাকা জীবানু। খাবার পানিতে আর্সেনিক বা এই ধরণের বিষাক্ত বস্তুর কারণে যত মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ খুব দ্রুত জীবানুজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে এমনকি মারা যেতে পারে। অতীতে পানিজনিত রোগে (কলেরা, ডায়রিয়া) গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মরে সাফ হয়ে যেত। তাই পানির জীবানুমুক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে এই ধরণের মহামারিগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তবে বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়ে জরুরী ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে পানি বিশুদ্ধকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই আলোচনায় পানি জীবানুমুক্তকরার বিভিন্ন উপায় নিয়ে কিছুটা বিশ্লেষন ও বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক একটা তথ্য জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, পানি পরিশোধণে সমস্ত পরিশোধন প্রক্রিয়ার শেষে সববরাহ করার আগের ধাপে সাধারণত এটাকে জীবানুমুক্ত করা হয়। তবে, ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে এটা সহ পরিশোধনের অন্য ধাপেও পানিতে জীবানুনাশক দেয়া হতে পারে।
১.১ ডিসইনফেকশন বনাম স্টেরিলাইজেশন
জীবানুমুক্ত করণের দুইটি ইংরেজি আছে: ১। Disinfection এবং ২। Sterilization। ডিসইনফেকশন দিয়ে শুধুমাত্র ক্ষতিকারক বা রোগ সৃষ্টিকারী জীবানুগুলোকে ধ্বংস করা বুঝানো হয়ে থাকে যেখানে স্টেরিলাইজেশন দিয়ে ক্ষতিকারক হউক বা না হউক সমস্ত জীবানুকে ধ্বংস করা বুঝায়। পানিশোধনের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমটি অর্থাৎ সরবারহকৃত পানি থেকে শুধুমাত্র ক্ষতিকারক জীবানু দুর করতে চাই। ডাক্তারগণ তাঁদের অপারেশনে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রগুলোকে স্টেরিলাইজ করেন।
কয়েকভাবেই জীবানু দুর করা যায়। এই পদ্ধতিগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: ক) ভৌত পদ্ধতি, এবং খ) রাসায়নিক পদ্ধতি।
১.২ প্রভাবক সমূহ
জীবানুনাশের বিভিন্ন পদ্ধতি বিভিন্ন দক্ষতায় কাজ করে, তবে এই পদ্ধতিই শেষ কথা নয়। পানির এবং জীবানুর পরিমান এবং অবস্থা বা তারতম্য এই প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করে এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রক্রিয়ার সফলতাও এই অবস্থাগুলোর উপর নির্ভর করে। উদাহরনস্বরূপ পানিতে থাকা জীবানুর পরিমানের বা মাত্রার কথা বলা যায়। জীবানুর মাত্রা বেশি হলে বেশি পরিমানে রাসায়নিক জীবানুনাশক লাগবে, অথবা এমন হতে পারে যে ভৌত পদ্ধতি সেই মাত্রায় অক্ষমও হতে পারে। এছাড়া কোন একটা রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মেশানোর পর সেটা কী রূপ ধারণ করবে সেটার উপরেও জীবানুনাশের সফলতা নির্ভর করে। রাসায়নিক জীবানুনাশকের বিভিন্ন রূপ তথা কার্যক্ষমতা আবার পানির তাপমাত্রা, পানির পিএইচ (অম্লতা/ক্ষারকত্বের পরিমাপ), কতক্ষণ ধরে বিক্রিয়ার করানো হচ্ছে সেই সময়, পানিতে জীবানুনাশক মিশানোর পদ্ধতি ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। কাজেই একটা পদ্ধতি অবলম্বন করলেই বা একটা রাসায়নিক পদার্থ নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ করলেই যে প্রতিবারে একইভাবে জীবানুনাশ হবে তা নয়; তাই পানি, জীবানু এবং প্রক্রিয়ার রসায়নটা যেন সর্বোৎকৃষ্টভাবে কাজ করতে পারে সে সম্পর্কেও ভাল ধারনা থাকতে হবে।
২ ভৌত পদ্ধতিসমূহ
২.১ ফুটানো
পানি ফুটিয়ে (Boiling) জীবানু মুক্ত করার পদ্ধতিটা প্রায় সকলেই জানেন। সীমিত পরিসরে এটি উন্নয়নশীল বিশ্বের কিছু অংশে ব্যবহৃত হয়। সরাসরি ডোবা বা জলাশয়ের পানির ক্ষেত্রে অন্তত ২০ মিনিট ধরে ফুটানোর কথা বলা হয়। তবে আমেরিকান সরকারী পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির (USEPA) মতে, ফিল্টারকৃত থিতানো পানি ১ মিনিট ধরে পূর্ণমাত্রায় ফুটালেই কাজ হবে (এক মাইলের চেয়ে বেশি উচ্চতার জায়গায় ৩ মিনিট; কারন, উঁচু জায়গায় পানির স্ফুটনাংক কমে যায়)। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানির জন্য ১ মিনিট টগবগ করে ফুটানো যথেষ্ট কিন্তু সরাসরি ডোবানালার অপরিশোধিত পানি হলে বেশি সময় ধরে ফুটানো দরকার। শক্তি খরচের বিচারে এটা পানি ফুটানোর সবচেয়ে অদক্ষ পদ্ধতি। পৃথিবীর কোনো পানির শোধনাগারে জীবানু দুর করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়না, এমনকি যেসব দেশে সরাসরি কলের পানি খাওয়া যায় সেখানেও হয় না।
২.২ আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি
পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানি থেকে জীবানু দুর করার জন্য অতিবেগুনি বিকিরণ (ultra violet radiation) খুবই কার্যকরী একটা পদ্ধতি। যে কোনো ধরণের ব্যাকটেরিয়া, সিস্ট এবং স্পোর মারতে এই অতিবেগুনি রশ্মী অত্যন্ত শক্তিশালী একটা অস্ত্র; তবে ঘোলা পানিতে কিংবা পানিতে নাইট্রেট, সালফেট বা ফেরাস (আয়রন) আয়ন একে কাজ করতে বাধা দেয়। এছাড়া অতিবেগুনি রশ্মী পানির বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে না, তাই পানিকে অগভীর ধারায় প্রবাহিত করতে হয় (সর্বোচ্চ ৩০ সেমি বা ১ ফুট)। পানিকে তাৎক্ষনিক ভাবে জীবানুমুক্ত করলেও পরবর্তীতে সেই পানি সরবরাহ লাইনে/পাইপে অন্য কোন জীবানু উৎস থেকে দুষিত হলে সেটা ঠেকানো যায় না; এছাড়া এটার খরচও বেশি। তাই এই পদ্ধতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে সীমাবদ্ধ। তবে জেনে রাখতে ক্ষতি নাই, হয়তো কখনো কোনো পরিস্থিতিতে কাজে লেগে যেতে পারে।
২.৩ সৌর পদ্ধতি
দুষিত পানিকে সূর্যালোকে রেখে দিলে সেখানকার ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া অকার্যকর হয়ে যায়। ধারণা করা হয় রোগবাহী জীবানুগুলো সূর্যালোকের প্রভাবে দুর হওয়ার পেছনে তিনটি কারন কাজ করে: ক) অতিবেগুনি-এ রশ্মীর কারণে ব্যাকটেরিয়ার বিপাক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয় এবং কোষ কাঠামো ধ্বংস হয়। খ) ৩২০-৪০০ মিমি তরঙ্গদৈর্ঘের অতিবেগুনি রশ্মী পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে এবং অক্সিজেনের অত্যন্ত সক্রিয় রূপ উৎপাদন করে (ফ্রী রেডিক্যাল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড); এগুলোও রোগজীবানুগুলোর দফারফা করে দেয় বলে ধারণা করা হয়, এবং গ) সৌরশক্তি সঞ্চয়ে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ৫০°সে. এর অধিক তাপমাত্রায় এই জীবানুনাশী প্রক্রিয়াগুলো তিনগুন দ্রুততর হয়।
সৌর পদ্ধতিকে ইংরেজিতে SODIS বলে। এই পদ্ধতিতে জীবানুমুক্ত করতে ৩০°সে. তাপমাত্রায় প্রায় ৫ ঘন্টা পূর্ন সূর্যালোকে রাখতে হয় পানিকে। এসময়ে সৌর বিকিরণের মাত্রা থাকতে হয় ৫০০ ওয়াট/বর্গমিটার (সব তরঙ্গদৈর্ঘ মিলিয়ে)। 45°সে. এর অধিক তাপমাত্রায় অতিবেগুনি রশ্মি এবং তাপমাত্রার সম্মিলিত ক্রিয়ায় জীবানুনাশী দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পায়। চিত্র ১ এ এই পদ্ধতিটি সহজ চিত্রে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে - যা প্রচার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিত্র ১: SODIS বা সৌর পদ্ধতিতে পানি জীবানুমুক্তকরণের ধাপসমূহ (সূত্র: উইকিপিডিয়া, EAWAG)
এই পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় পানি শোধন করা যাবে না, কিন্তু যেসব প্রত্যন্ত স্থানে পরিশোধিত পানির অন্য কোনো উপায় নেই সেখানে এটা জীবন রক্ষা করতে পারে। দূর্গম এলাকায় ভ্রমনকারী (জঙ্গল, চরাঞ্চল, পর্বত ইত্যাদি) এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্থ অঞ্চলে দুষিত পানি জনিত রোগ ঠেকাতে এই পদ্ধতি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
(চলবে) (?)
====
পরবর্তী পর্ব (বা পর্বগুলোতে) থাকবে:
৩ রাসায়নিক পদ্ধতিসমূহ
৩.১ একটা ভাল জীবানুনাশকের কী কী বৈশিষ্ট থাকা উচিত
৩.২ ক্লোরিন দ্বারা
৩.৩ ওজোন দ্বারা
৩.৪ আয়োডিন এবং ব্রেমিন দ্বারা
৩.৫ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্বারা
৪ কিছু সাধারণ ব্যবহারিক প্রয়োগ পদ্ধতি
৪.১ পানির ট্যাংকি, সরবরাহের পাইপ জীবানুমুক্তকরণ
৪.২ টিউবওয়েল জীবানুমুক্তকরণ
৪.৩ পাতকূয়া এবং পুকুর জীবানুমুক্তকরণ
৫ তথ্যসূত্র
এই পুরা প্রবন্ধটির পিডিএফ ডাউনলোড লিংক।