টপিকঃ বাবা!
ছুটির মধ্য দুপুর। দরজায় নক নক শব্দ শুনে গুটি গুটি পায়ে প্রায় চার/পাঁচ বছরের ঐশী এগিয়ে যায়।
‘কে? কী চাই?’
‘আম্মাজান, খুব খিদা লাগছে। কিছু খাইতে দিবেন?’
কথাটা বলেই নিঃশব্দে হেসে ফেলে রায়হান। একেবারে ভিখিরিদের মত কণ্ঠ করেই ডেকেছে। বোঝার উপায় নেই। কিন্তু ঐশী বুঝে ফেলে। ফোকলা দাঁতে মিটিমিটি হেসে, ‘মাফ করেন। বাসায় কেউ নাই।’
‘আম্মাজান, চাইট্টা খাইতে দিলে ভালো অইতো। তিয়াসও লাগছে খুব।’
ঐশী ইতোমধ্যে একটা টুল টেনে এনে পিপহোলে চোখ লাগিয়েছে। ঠিকই ভেবেছে। রায়হান কাকু! আনন্দে কান্না পেয়ে যায়। আবার রাগও লাগে। এতদিনে মনে হলো। নাহ, আর কথাই বলবে না!
‘বললাম তো, মাফ করেন।’
‘আমার লগে একখান বারবিও ছিলো। এরও খুব তিয়াস পাইছিলো...মাফ করতে কইছেন, আয় বারবি, আমরা চইলা যাই। করনের তো কিছু নাই!’
এতক্ষণে বারবি ডলটা খেয়াল করে ঐশী। সাথে সাথেই গলা নরম করে ফেলে, ‘ না, না যাবেন না। দাঁড়ান।’
এইসময় একটা গম্ভীর গলা হেঁকে উঠে, ‘আহ, কী হচ্ছে ঐশী? কে এসেছেন?’
‘মা, একটা ফকির...না, না হি হি রায়হান কাকু...হি হি ...’ হাসির চোটে বাকিটা বলতেই পারে না ঐশী।
‘কী বাজে বকছো? সর, দেখি কে এসেছে? টুল থেকে নামো বলছি। পড়ে যাবে তো! যত বড় হচ্ছো, বুদ্ধি কমে যাচ্ছে!’
দরজা খুলে হকচকিয়ে গেলেও সামলে নেয় অর্পিতা। সত্যি সত্যি রায়হানই তো!
‘আপনি? এই সময়ে? কেন?’
‘এত প্রশ্ন কেন করছো? কেন, আসতে পারি না?’
‘না, পারেন না। আপনাকে তো নিষেধ করেছিলাম।’
‘চলে যাবো? খুব ক্ষুধা পেয়েছিলো...আচ্ছা, ঠিক আছে। চলে যাচ্ছি। একটু ঐশী মামণিকে দেখে যাই, প্লীজ!’
রায়হানের গলায় অনুনয় ঝরে পরে। অর্পিতার হঠাত খারাপ লেগে যায়। কী ভেবে মন পরিবর্তন করে ফেলে।
‘আচ্ছা, ভিতরে আসুন। দেখেই চলে যাবেন।’
রায়হান অবাক হয়ে যায়! এতটুকু সে আশা করে নাই। ভেবেছিলো ডলটা দিয়েই কেটে পড়তে হবে। যাক, ভিতরে ডাকছে। লক্ষণ শুভই বলতে হবে।
‘কই আম্মাজান, আমার আম্মুটা কই? আমারে না দেন, এই বারবিটারে তো কিছু খাইতে দিবেন...’
ঐশী ঘরের কোণে টবে রাখা গাছটির পাতা ধরে পায়ে নখ খুঁটতে থাকে। মুখটা নীচে নামানো। রায়হান এগিয়ে গিয়ে চিবুকটা ধরে উঠিয়ে দেখে চোখে পানি টলমল করছে। বিচলিত হয়ে যায় সে।
‘আরে পাগলী, কাঁদছিস কেন?’
‘না, আমি কান্না করি না। তুমি পঁচা। তোমার সাথে কথা বলবো না, এত দিন আসো নি কেন?’
‘এই তো কথা বলছিস হা হা হা’
‘না, আর বলবো না’
রায়হান বারবি ডল, একগাদা চকোলেট আর একটা স্কুটার দেখিয়ে বলে, ‘তাহলে এগুলোর কী হবে? ফেলে দেই, কী বলিস? কথা না বললে তো আর উপায় নেই!’
ঐশীর মন গলে যায়। তাড়াতাড়ি বলে, ‘ না, না ফেলে দিও না। দেখি, কীরকম?’ উতসাহে ক’পা এগিয়ে যায় ঐশী।
‘উঁহু, এভাবে তো দেখা চলবে না। এখানে এখানে কী দিতে হবে, মনে নেই?’ রায়হান নিজের গালে আর কপালে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়...
‘ইস, তুমি খুব জ্বালাও, কাকু!’ বলেই টপাটপ রায়হানের গালে আর কপালে কটা চুমু দিয়ে ফেলে। রায়হান ঐশী কে কোলে তুলে নিয়ে জরিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘মা, মাগো আমার। কতদিন তোমাকে দেখি না!’
অর্পিতা অদূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে থাকে। বুকটা কি হঠাত টনটন করে ওঠে?
‘ওহ কাকু, এখন আমাকে ছাড়ো। একটু দেখতে দিবে তো, খেলনাগুলো?’
‘জ্বী মাতাজি...দেখার অনেক সময় পাবে। আমার একটু তাড়া আছে। শুধু তোমাকে একটু দেখার জন্য এসেছিলাম। এখন যেতে হবে যে!’
‘না, আজকে তুমি আমাদের সাথে থাকবে’ ঐশী আবার কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়।
‘না মা, আবার আসবো...খুব শীঘ্রিই...প্রমিস...’
রায়হান দরজার দিকে পা বাড়ায়। এমন সময়ে অর্পিতা হেঁকে ওঠে, ‘ঐশী, তোমার কাকুকে বলো টেবলে খাবার দেয়া হয়েছে। যেন খেয়ে যায়’
রায়হান থমকে দাঁড়ায়। পিছু ফিরে ঐশীর দিকে তাকাতেই সে ফিক করে হেসে ফেলে, ‘মা খেতে ডাকছে। না করলে কিন্তু খুব রাগ করবে’
‘তোর মাকে আমি ভয় পাই?’
‘পাও না? ডাকবো মাকে? মা...’
‘ও মেরি মা...চুপ কর, চুপ কর। হ্যাঁ, হ্যাঁ খুব ভয় পাই’ রায়হান হাতজোড় করে। অগত্যা থেকে যায়। আসলে ওর নিজেরও কিছুতেই যেতে ইচ্ছা করছিলো না। একটা ছুঁতো পেয়ে যাওয়াতে ভালোই হলো।
খেতে বসেছে সবাই। ঐশী, রায়হানের কোলে বসেছে। আর হলে সে অর্পিতার ভয়ে নিজেই হাতে খায়। আজ আহ্লাদে আটখানা হয়ে রায়হানের হাতে খাবে বলে জেদ ধরেছে। মাছের কাঁটা সে কিছুতেই খেতে পারে না। রায়হান একটা একটা করে কাঁটা বাছছে। চমৎকার একটা দৃশ্য! অর্পিতার মনে হয় ঐশী কি বাবার অভাব বোধ করে? মনে হয় করে? ঐটুক মেয়ে যে চাপা! শফিক যদি আজ বেঁচে থাকতো! তিন বছর আগের সেই এক্সিডেন্টের দৃশ্য মনে পড়ে গেলে বিচলিত হয়ে যায়। তার নিজের কপালটা এমন কেন? সবাই ছেড়ে চলে যায়। রায়হানও কি ছেড়ে যায় নি তাকে? একাকীত্বই তার একমাত্র পাওনা হয়ে যায় কেন? এখন ঐশী ছাড়া আর কে আছে ওর?
‘বেশ গরম পড়েছে, তাই না? এখানে টেকাই তো দায়!’ রায়হান অনেকটা গল্প জমাবার ভঙ্গিতে বলে। অনেকটা সময় বসে আছে। কেউ কিছু বলছে না দেখে সেই কথা পেড়ে বসে।
‘তো আপনাকে কে আসতে বলেছে এই দেশে? ম্লেচ্ছদের ওখানে তো ভালোই ছিলেন, আছেন।’
‘তুমি এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলছো কেন? তোমাদের...আই মিনড, ঐশীকে দেখতে আসতে পারি না?’
‘আমার স্মৃতি দুর্বল নয়! বছর আগেই তো সব ফয়সালা হয়ে গিয়েছিলো, তাই না? তারপরও কেন আমাদের জ্বালাচ্ছেন?’
রায়হান ঠিক পুরোটা শুনছে না। তার দৃষ্টি একটু দূরে খেলতে থাকা শিশুটির উপর। চিবুকের গড়ন, চুল আর নাকটার সাথে থাকা সাদৃশ্যটা বরাবরের মত আবার তাকে বিদ্ধ করে। দিস ইস আনমিস্টেইকেবল! কিন্তু এটা কি সম্ভব? অনেক ভেবেছে সে। আচ্ছা, এর সাথে অর্পিতার এই বিদ্বেষি আচরণের কি কোনো যোগসূত্র আছে? সে কি কিছু লুকাচ্ছে? ভাবনায় ডুবে যায় রায়হান।
‘কী হলো, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?’ অর্পিতা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
‘অ্যাঁ, কী বললে?’
‘ফরগেইট ইট!’
‘আচ্ছা অপি, তুমি কি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?’ দুম করে প্রশ্নটা করেই বসে রায়হান।
‘মানে? কী লুকাবো আপনার কাছে? আর আমার ডাকনামে ডাকার কোনো অধিকার নেই আপনার!’ জোরালো কন্ঠে বলে ওঠে অর্পিতা!
‘স্যরি, ভুল হয়ে গেছিলো। আর হবে না। কিন্তু অর্পিতা, আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু দিলে না?’
‘জবাব দেবার কিছু নাই বলে’
‘সত্যিই তো, না? তোমার চোখে ছানি পড়তে পারে, কিন্তু আমার পড়ে নি! ঐশীর দিকে ভালো করে তাকাও। মিলটা কি দেখতে পাও না?’
রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে অর্পিতা। চিৎকার করে বলে, ‘কী যা-তা বলছেন?’
‘চিৎকার করো না। চিৎকারেই সত্যটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। বলো, সত্যটা বলো, অর্পিতা। আমাকে আর যন্ত্রণা দিও না! আর কত প্রায়শ্চিত্ত করবো?’
‘আপনি এখন আসতে পারেন। পুরানা কথা তুলে কার কী লাভ?’
‘লাভ নেই? কিন্তু আমার তো দায়মুক্ত হতে হবে। তোমাকে ঘরে আনবার সময় আমি আসলেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঘরে আমার মন ছিলো না। জোরাজুরিতে রাজী হয়েছিলাম... তারপর ...আমি সত্যিই দুঃখিত!...’
‘আপনি দুঃখিত? হাসালেন...বছর না ঘুরতেই একদিন দুম করে ছেড়ে গেলেন সবকিছু। কাউকে কিছু জানালেন না। আপনি সবই পারেন, তাই না? কোনোকিছুই বাদ রাখবেন না...এখন আবার কী সর্বনাশ করতে এসেছেন?’
‘এভাবে বলো না, অর্পিতা! আমি সত্যিই অনুতপ্ত। তাকাও, এই যে আমার দিকে তাকাও। ভালো করে দেখো এখানে কোনো মিথ্যা দেখতে পাও কিনা?’
ক্ষণমাত্র তাকিয়েই চোখ সরিয়ে ফেলে অর্পিতা। কী দেখে সে-ই জানে। বিহ্বল হয়ে বলে, ‘দোহাই লাগে আপনার...আমাদের একা থাকতে দিন। বারে বারে এসে কেন তছনছ করতে চান সবকিছু?’
‘জানো না, কী চাই? কেন বুঝেও বোঝো না! আমি তোমাদের, তোমাদের চাই... তুমি...ঐশী...’
‘খবরদার! আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন...ঐশীকে নিয়ে খেলবেন না! প্লীজ!’
রায়হান কিছু বলে না। ছাইমুখে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আবেগ যখন ভারী হয়ে আসে, তখন কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। প্রচণ্ড দোলাচালের সেই সময়টাতে অস্বীকারি সমস্ত সত্তা নির্বিবাদে নতজানু হয়ে পড়ে। ভারাক্রান্ত চোখের থেকে সত্য এ জগতে আর দু’টি নেই!
অর্পিতা সেই সত্যের সম্মুখীন হয়ে হঠাত সমস্ত কাঠিন্য খুইয়ে ফেলে। এতদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অপমান, বঞ্চনা, আর দুর্বহ একাকীত্ব – সব একসাথে গলে গিয়ে বাঁধভাংগা জল হয়ে গাল বেয়ে নামতে থাকে। রায়হান এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে অর্পিতার অনন্য স্নিগ্ধ মুখখানি তুলে ধরে খুব আলতো করে জিজ্ঞেস করে, ‘ অপি, ঐশী আমার, তাই না?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐশী তোমার, তোমার...’
কান্নায় ভিজে চলে রায়হানের কাঁধের কাছটা।
শিশুরা বড়দের অনেক জটিল ব্যাপারও খুব সহজে বুঝে যায়। কেউ খেয়াল করে নি ঐশীকে। সে কিছু একটা গভীরভাবে বুঝে গিয়ে ফিকফিক হাসতে থাকে। গুটি গুটি পায়ে বাঁ হাতে বারবিটা বগলদাবা করে পৌঁছে যায় রায়হান-অর্পিতাদের কাছে।
‘কাকু, মা, তোমাদের কী হয়েছে?’
রায়হান সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। ঐশীকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, ‘মাগো, আমাকে ‘বাবা’ ডাকবি? একটু ডাক না? একবার ডাক, মা’
ঐশী কী মনে করে অর্পিতার দিকে তাকায়। অর্পিতা নীরবে মাথা দোলায়। আর তারপর ছোট্ট মৃদুস্বরে ডেকে ওঠে, ‘বাবা!!’
কেউ জানে না ছোট্ট ঐশী কতদিন রায়হানকে বাবা বলবে বলে মনে মনে ভেবে এসেছিলো!
উদাসীন
১২/০৪/১৩
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।