টপিকঃ :::স্টিলেটোস:::
:::স্টিলেটোস(Stilettos):::
চার বছর কি খুব বড় কোনো সময়? আবার নিশ্চয়ই তেমন ছোট সময়ও নয়! একই ছাদের নীচে একটা লোককে জানতে কত দিন লাগে? অরণি আসলেই এর উত্তর জানে না! কত দ্রুত সময়গুলি গড়িয়ে গেলো! অথচ এখনও ঠিক মন পেলো না সেজান -এর। কত কিছুই তো করে। কী খেতে ভালবাসে, কী পরে, কোথায় যেতে পছন্দ করে ইত্যাদি নানান ব্যাপার অরণির নখদর্পনে। কিন্তু তবুও সেজান ওর হয় না!
আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেলো বেড়াতে এসেছে মামাত বোনের বাসায়। এ ক’টা দিন একবারও নিজে থেকে ফোন করে নি সেজান । অরণিই যেচে ফোন করে খবর নিয়েছে। এই নিস্পৃহতার পেছনে যে অব্যক্ত চোরা গ্লাণিটা আছে, সেটা অরণি বুঝেও বুঝতে চায় না।
আনমনা হয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিলো অরণি। ভুলেই গেছিলো রাস্তার পাশে প্রকাণ্ড শপটায় উইণ্ডো শপিং করছিলো। বড় কোনো জুতোর শপ দেখলেই অরণি থেমে যায়। ঐ দেখাই সার। জানে কখনো কেনা হবে না। অত সাধ্য আছে নাকি তার? সেজান -এর টাকায় সে অবশ্য অবলীলায় কিনতে পারে, কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বোধহয় বলতে পারবে না। তাই কী আর করা, শুধু দেখেই যাও! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণি।
সব জুতোই যে ওর পছন্দ হয়, তা কিন্তু নয়। এক জোড়া স্টিলেটোস বহুদিন ধরে কিনবে কিনবে করেও কেনা হচ্ছে না। না, তার নিজের গরজে নয় – সত্যি বলতে গেলে সেজান -এর আগ্রহের জন্যই কিনবে। লোকটা স্টিলেটোস বড় পছন্দ করে। সোহানার পায়ে নাকি অদ্ভুত মানিয়ে যায়! হুম, সোহানা। নামটা মনে হতেই আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস টুপ করে ঝরে পড়ে।
সোহানা সেজান -এর অরণি পর্বের আগের কাহিনি। সব চুকেবুকে গেছিলো প্রায় বছর পাঁচেক আগে। এক তরফা সম্পর্কচ্ছেদ - সোহানার দিক থেকেই। বিয়ের আগেই সেজান ওকে সব জানিয়েছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কারণটা উদ্ধার করতে পারে নি। প্রত্যাখানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে যে রাগের মাথায় অরণির সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে সেজান, এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলো অরণি। কিন্তু করার খুব বেশি কিছু ছিলো না। মামার আশ্রয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হওয়া একটা মেয়ের বলার কি খুব বেশি কিছু থাকতে পারে?
বোঝাবুঝির আগেই একদিন প্রকাণ্ড যন্তরের পাখিটা ওদের নিয়ে আকাশে ডানা মেলে দিলো। গন্তব্যঃ বিভুঁই।
ভিন দেশে অরণি আতান্তরে পড়ে গেলো। মাঝে মাঝে মনে হয় বাইরের শীতল প্রকৃতি যেন সম্পর্কের শীতলতার কাছে নস্যি! সেজান ঠিক রূঢ় শীতল ব্যবহার করে না ওর সাথে। কিন্তু উষ্ণতাও যে নেই, এটাও ধ্রুব সত্যি। আর মাঝে মাঝে সোহানা আসে। নানান কথায়, তুলনায়। ইচ্ছাকৃত কিনা, কে জানে? পায়ের সৌন্দর্য নিয়ে এক ধরণের অবসেশান আছে সেজান -এর। তাই সোহানার পায়ে স্টিলেটোস হিলের প্রশংসা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। ওরকম সুন্দর পা নাকি দেখাই যায় না! আরো কত কী? আফসোস, অবসেশান থাকা সত্ত্বেও অরণির পায়ের দিকে কখনোই সেভাবে দেখে নি সেজান। সে কি এতটাই ফেলনা? ইচ্ছে করে এক জোড়া স্টিলেটোস কিনে একদিন দেখিয়ে দেয়!
এক্সকিউজ মি প্লীজ, আপনি কি বিশেষ কিছু খুঁজছেন? কোনো সাহায্য করতে পারি?
ঘোর কেটে যায় অরণির। তাকিয়ে দেখে উজ্জ্বল চোখের একটা তরুণ শপ এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় স্যন্ডি ব্লণ্ড চুল। ওর তন্ময়তা দেখে নিশ্চয় খুব মজা পেয়েছে। ফিকফিক হাসছে।
‘না, না আমি ঠিক আছি। ধন্যবাদ!’ এড়িয়ে যেতে চায় অরণি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।
হেল্প করাই আমাদের কাজ। আসুন, আপনাকে আরো কয়েকটা দেখাই। কত সাইজ আপনার? উম...৫? এদিকে আসুন, দেখাচ্ছি।
এমন আন্তরিকতায় ‘না’ বলাটা অশোভন দেখায়। অগত্যা অরণিকে যেতে হলো। এই ফাঁকে ব্যাজ থেকে সে নামটা পড়ে নিয়েছে – এইডেন।
এইডেন হরেক রকমের স্টিলেটোস দেখিয়ে চলেছে। সেদিকে তেমন মন নেই অরণির। শেষ ক’বে কে এভাবে তাকে এমন উষ্ণ আন্তরিকতা দেখিয়েছে, মনে করতে পারলো না। ব্লণ্ড ছেলেটা অবশ্যই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু তা বাদেও কিছু একটা অরণিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
কেউ কি কখনো আপনাকে বলেছে – কত সুন্দর এক জোড়া পা আছে আপনার! যে কোনো স্টিলেটোসই মানিয়ে যাবে...
অপ্রস্তুত অরণি চট করে উঠে দাঁড়ায়। বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করতে থাকে।
'আমার একটু তাড়া আছে, তাছাড়া পার্সটাও বোধ হয় ফেলে এসেছি। পরে একবার আসবো, কেমন?’ হড়বড় করে বলে বেরিয়ে যায়।
‘স্যরি, আমি আপনাকে অপ্রস্তুত করতে চাই নি। ইয়্যু রিয়েলি হ্যভ আ ফাবিয়েলাস পেয়ার আভ ফিট!’ পেছন থেকে হেঁকে উঠে এইডেন।
এভাবেই শুরু। ক’দিন পর অরণি কেন যে আবার সেই শপটাতে গেলো, সে এক রহস্য বটে! কীসের টানে? উইণ্ডো শপিং, স্টিলেটোস নাকি ঐ ব্লণ্ড ছেলেটা? কোনটা যে ঠিক, ঠাহর হয় না! এমন ভাবনায় পায়ে পায়ে পেছনে এইডেন এসে হাজির হয়।
‘কী? আজকে নিশ্চয় পার্সটা নিয়ে এসেছেন, নাকি? কোন্টা নেবেন? আবার দেখাবো?’ সকৌতুকে জিজ্ঞেস করে এইডেন।
কাজের থেকে খুচরো কথাই হয় বেশি। জানাশোনা ডালপালা মেলতে থাকে সন্তর্পনে। কিন্তু এবারও জুতোটা কেনা হয় না অরণির। যাওয়ার সময় এইডেন জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার নামটাই তো জানা হলো না, মিস্?’
কীভাবে নিশ্চিত হলেন আমি মিস্ – মিসেস্ও তো হতে পারি।
হোয়াটেভা(র)...কী নাম তোমার?
কাল বলবো। হেসে ফেলে অরণি।
‘কাল আসবে?’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এইডেনের চোখ! কিন্তু অরণি কিছু বলে না। কী একটা আনন্দ দুই চোখের তারায় ঝিকিমিকি খেলতে থাকে।
দিনটার গায়ে শত বর্ণের প্রলেপ লেগে যায়। নদীর ধারে রাস্তাটা ধরে এলোমেলো হাঁটতে থাকে। ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যায়। নতুন করে জীবনটা কি আবার শুরু করা যায় না? দমকা হাওয়ার মত আকস্মিক এই চিন্তাটায় থমকে দাঁড়ায় অরণি। কেন এমন ভাবছে?
বেলা পড়ে এসেছে। শীতের এই বিকেলগুলোতে ঝুপ করে নেমে আসে আঁধার। রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিলো অচেনা কতগুলি পাখিকে। হটাত সেগুলি ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায়। বিষন্ন হয়ে যায় অরণি। সবারই ঘরে ফেরার তাড়া; শুধু তারই নেই! তার ঘর থেকেও হলো না কেন? নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা সর্বগ্রাসি ঢেউ উঠেও যেন মিলিয়ে যেতে বসেছে।
হঠাত মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। কে আবার, এই সময়ে? বিরক্তিভরে স্ক্রীনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। সেজান ওকে ফোন করেছে? আশ্চর্য হলেও ফোনটা ধরে না। বেজে বেজে ভয়েস মেলে চলে গেলো। কানে লাগিয়ে শুনলোঃ একটা ভরাট কণ্ঠে শুধু দু’টি শব্দ – কোথায় তুমি? এতদিন পর শুধুই দু’টি শব্দ! আর কি কিছুই বলার নেই? কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে বড্ড প্রতারিত মনে হয়। কিন্তু দোষটা কাকে দেবে সে - ঠিক বুঝে উঠলো না!
চলবে...
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।