টপিকঃ যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-২
গত পর্বের কিছু অংশ থেকে...
আবেগের এই উল্লম্ফনকে নুয়ান কাজে লাগিয়েছিলো। নিজেকে ঘৃণা করেছে এজন্য কিন্তু সিস্টেমে ঠিকই প্রবেশ করিয়েছিলো। আজ সকালে (হেলিওসেলিনের ডে-মোড) সেটার ফলাফল হাতে পেয়েই ধাঁধায় পড়ে গেছে।
যাচাইয়ের জন্য উচ্চ-যেলড্রিয়ানদের কাপ্পা-নেট(৭) –এ একটা দুর্ধর্ষ চুরি করতে হয়েছিলো। এটা একটা টপ সিক্রেট গবেষণা – যেখানে সীমিত পর্যায়ে একক মানব সত্তার মানসিক অবস্থা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং আরো অন্যান্য কিছু কৃত্রিম লাইফ ফর্মের মানদণ্ডও ছিলো। সেগুলির সাথে যাচাই করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেষ্টা করে নুয়ান। কিন্তু এ যে অসম্ভব!
=========================================================================
কৃত্রিম সন্ধ্যা, ১০১২ যেলড
নুয়ানের লিভিং স্পেস (নিম্ন যেলড্রন)
=========================================================================
নুয়ানের ভাবনায় ছেদ পড়লো হেলিওসেলিনের চন্দ্র মোডে প্রবেশের সময়টাতে। আসল চন্দ্র কী – সেটা কোনোদিনই হয়তো জানা সম্ভব হবে না! তবে আদি বসতি স্থাপনকারিরা চন্দ্রের ধারণাটা হেলিওসেলিনে জুড়ে দিয়েছিলেন। উত্স-গ্রহ পৃথিবীতে নাকি চন্দ্র নামের একটা উপগ্রহ ছিলো, যেটা সেই সোলার সিস্টেমের তারা থেকে আলো ধার করে পৃথিবীতে বিলাত। এখানে সেটার অনুকরণের একটা চেষ্টা করা হয়েছে! উৎস ভুলে না যাওয়াটা একটা চমকপ্রদ গুণ মনে হয় নুয়ানের। সে যাক, একটা অদ্ভুত কোমল আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে – প্রতিদিনই এমন হয়। তবুও নুয়ানের কেন জানি ভালো লাগে – সত্যি বলতে, মেকি এই একটা জিনিসই ওর ভারী পছন্দের!
ঝটপট কাজে লেগে যায়। নুয়ান ওর মিনিমালিস্টিক ডিজাইনের লিভিং স্পেসটাকে নিমেষেই একটা কার্যক্ষম ল্যাব –এ রূপান্তরিত করে ফেলে। আসলে সব যেলড্রিয়ানদের স্পেসগুলোই এমন – যখন যেটা দরকার তখন শুধু সেটার আকার ধারণ করে। খামোখা স্থান নষ্ট করার পক্ষপাতি কেউ নয়!
নুয়ান ওর খুলিতে ইমপ্ল্যান্টেড ফ্রাক্টাল এলিমেন্ট এন্টেনা(৮) –এর সজ্জাটাকে চালু করল। উচ্চ এবং নিম্ন – সকল যেলড্রিয়ানদের জন্য এই ব্যবস্থা আছে। উদ্দেশ্যঃ একটা একীভূত ক্লাস্টার (৯), যেটা প্যারালাল প্রসেসিং –এর মাধ্যমে প্রায় তিনশ কোটি যেলড্রিয়ান মস্তিষ্ক কিংবা মস্তিষ্কের অনুরূপ প্রসেসরের (যেমন, মেকা-মস্তিষ্ক) কম্পিউটিং ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। এফইএ –এর মাধ্যমে আলট্রা লো ফ্রিকয়েন্সি ব্যাণ্ড (৩০ – ৩০০০ হার্টস) ব্যবহার করে নোডগুলি যুক্ত হয়ে মেকা-বায়ো-ফাই (১০) গঠন করে। এরকম কতগুলি ছোট ছোট মেকা-বাই-ফাই সিস্টেম একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহত্তর নেটওয়র্ক স্থাপিত হয়। তবে, উচ্চ এবং নিম্ন যেলড্রিয়ানদের ক্লাস্টারে পার্থক্য বিদ্যমান। যাই-নেট(১১) কাপ্পা-নেটের সাথে শর্তসাপেক্ষে যুক্ত হতে পারে – স্পর্শকাতর ব্যাপারে, বিশেষ করে গবেষণায় বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। যাই-নেট বিশেষত নিম্ন যেলড্রিয়ানদের জন্য।
নিজস্ব গবেষণার জন্য নুয়ান মেকা-বাই-ফাই –এর একটা বিশেষায়িত সংস্করণে নিজেকে যুক্ত করল। নিজেকেই দাঁড়া করাতে হয়েছে – নির্দিষ্ট কম্পাংকের রেঞ্জে সকল সদস্যদের অবচেতনার একটা বিশেষ অবস্থা আবিষ্কার নুয়ানের জন্য অত্যন্তের গর্বের বিষয়, কিন্তু আফসোস কাউকে জানানো যায় নি! অবচেতন ঐ অবস্থার তুখোড় বিশ্লেষণী শক্তি অংশগ্রহণকারীদের অজান্তে কোনোরকম অসুবিধা ছাড়াই ব্যবহারের উপায় বের করেছে নুয়ান। সবচে’ মজার ব্যাপার হলো কাপ্পা-নেট এযাবৎ এই বিশেষায়িত সংস্করণের হদিশ বের করতে পারে নি!
এক ধরণের গর্ব মিশ্রিত আনন্দ নিয়ে নুয়ান সিমিতের মানসিক অবস্থা-ক্ষেত্র পুনঃনির্ণয় করার কাজে লেগে গেলো। প্রথম পরীক্ষাটা ছিলো আনন্দজনিত আবেগ নিয়ে। এবার সিমিতকে রূঢ় ব্যবহারে বেশ কষ্ট দেয়া হয়েছে। দুঃখ, অভিমানজনিত আবেগের পরিবর্তন একীভূত চেতনা-ক্ষেত্রে একটা সুস্পষ্ট নেগেটিভ ডাইভারজেন্স নির্দেশ করছে। এই অবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রন বলয়ে নিয়ে নুয়ান সিমিতের মানসিক অবস্থা-ক্ষেত্র বের করে ফেললো। ফলাফল ঐ আগের মতই। কোনো ভুল নেই – সিমিত নিশ্চিতভাবে একটা মেকা-প্রাণ (১২)!
নুয়ান গভীরে আঘাত পায়। ভিতরে ভিতরে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো – হয়তোবা তার কম্পিউটেশান ভুল প্রমাণিত হবে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ফলাফল মেকা-প্রাণ এসেছে! সত্যটা মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। এতদিনের মান-অভিমান, হাসি-কান্না, চুম্বক আবেদন – সব কি ভয়ংকর জটিল ইভেলুশ্যনারি এলগরিদমের কারসাজি! তবে একটু আতংকিতও হয়ে পড়ে – কে বা কারা ওকে এত নিখুঁত মানব সদৃশ করে তৈরি করেছে? তাদের ক্ষমতা বিষম চিন্তিত করে ফেলে নুয়ানকে। সাথে একধরণের বিবমিষা – মেকি কোনো কিছু নুয়ানের সহ্যের বাইরে!
সিমিত সেরিন (মেকানো আইডি –এসএস১১২৩৫৮) ফ্লোট-পোর্টারের চ্যানেলে নিশ্চল হয়ে যায়। একটা তীব্র বেদনা, আতংক এবং ঘৃণার সম্মিলিত মনোবস্থা সিমিতকে মুহূর্তে বিহ্বল করে দেয়। সিমিতকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো ভালোবাসা, ঘৃণা, ভীতি আর অদম্য অনুরক্তি – এই চারটি আবেগীয় অবস্থায় অসাধারণ সংবেদী করে। প্রফেসর ফেরিন ফ্যারিহাড তাঁর ফ্যারিহাড্রিক মডেলিংয়ের অনন্য প্রয়োগে সিমিতের বিকাশ সাধন করেন। এইমাত্র লজিকের একটা প্রচণ্ড ঝড়ে সিমিতের উপর ক্রিয়ারত নুয়ানের অবচেতন স্তরের বাধা চুরমার হয়ে গেলো। যা কখনো ঘটে নি, তাই প্রথমবারের মত ঘটল। সিমিত অবচেতনের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গভীর মনোসংকটে থাকা নুয়ানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেললো। খুব কোমলভাবে বহুদূর হতে ক্ষীণ ডাকের মত শুধালো – নুয়ান!
নুয়ান চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে চেনা স্বরের অধিকারিণীকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও কেউ নেই!
=========================================================================
শব্দ কোষঃ
১. ফ্লোট-পোর্টারঃ কাল্পনিক, এক ধরণের যাতায়াত এবং যোগাযোগ মাধ্যম। উচ্চ শক্তির সনিক ওয়েভ ক্যারিয়ার, বস্তু এবং তথ্য – উভ্য় পরিবহনে সক্ষম।
২. যেলড্রনঃ কাল্পনিক, পৃথিবী হতে ৪.৫ আলোকবর্ষ দূরের মনুষ্যবসতি (২২০০ এ.ডি)। নিম্ন এবং উচ্চ – এ দুইভাগে বিভক্ত। যেলড্রিয়ানরা এর অধিবাসী – মূলত মানব সম্প্রদায়।
৩. হেলিওসেলিনঃ কাল্পনিক, কৃত্রিম সূর্য সদৃশ যন্ত্র বিশেষ; সময় বিশেষে চাঁদের মত কাজ করে।
৪. হাই-হাইপারসনিক মাইক্রোক্যাননঃ কাল্পনিক, অত্যন্ত কার্যকর ২৫ ম্যাক রেঞ্জের উচ্চ শক্তির শব্দ-তরঙ্গ ঘাত ভিত্তিক ক্ষুদ্রাকৃতির অস্ত্র বিশেষ। উচ্চ-যেলড্রিয়ানদের কুক্ষিগত!
৫. ফ্যারিহাড্রিক মডেলঃ কাল্পনিক, তাত্ত্বিক সাইকো-ফিজিসিস্ট ফ্যারিহাড ১২০ যেলড –এ বুদ্ধিমান স্তরের প্রাণের চেতনার গাণিতিক মডেলের ধারনা দেন।
৬. রেন সমুদ্রঃ কাল্পনিক, রেন নামক মধ্য বুদ্ধিমত্তার তরল সদৃশ প্রাণে পরিপূর্ণ সাগর। সাধারণ বিচারে বন্ধুত্বপূর্ণ!
৭. কাপ্পা-নেটঃ কাল্পনিক, উচ্চ-যেলড্রিয়ানদের অন্তর্জাল।
৮. ফ্রাক্টাল এলিমেন্ট এন্টেনাঃ বাস্তব, ডিটারমিনিস্টিক ফ্রাক্টাল (বেনোয়া ম্যান্ডেলব্রোট দ্বারা সংজ্ঞায়িত) আকারে সজ্জিত এন্টেনা বিশেষ। মূলত আরএলসি রেসোনেটর – সেলফ লোডিং এবং ফ্রিকোয়েন্সি উদাসীন।
৯. ক্লাস্টারঃ বাস্তব, অনেকগুলো কম্পিউটিং মেশিনের সমাহার যেটা একত্রে একটা একক মেশিনের মত কাজ করে।
১০. মেকা-বায়ো-ফাইঃ কাল্পনিক, মানুষ এবং অন্যান্য মানুষ সদৃশ প্রাণের সম্মিলিত নেটওয়র্ক!
১১. যাই-নেটঃ কাল্পনিক, নিম্ন-যেলড্রিয়ানডের স্বতন্ত্র নেট।
১২. মেকা-প্রাণঃ কাল্পনিক, একধরণের জীবন ধারা – জৈব এবং যন্ত্রের অসাধারণ সম্মিলন। সাধারণ বিচারে মানুষের থেকে পার্থক্য করা দুঃসাধ্য!
চলবে...
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৩
যেলড্রিয়ান প্রহেলিকা পর্ব-৪
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।