টপিকঃ আর্জেন্তিনা বনাম জার্মানি প্রীতি ম্যাচ ও একটি হতাশাবাদী বিশ্লেষণ
আজ রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে এক প্রীতি ম্যাচে মুখোমুখী হতে যাচ্ছে আর্জেন্তিনা ও জার্মানি। খেলাটি সরাসরি সম্প্রচার করবে সনি সিক্স। দুই দলই প্রায় পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে নামবে। বিশ্বকাপের দূঃসহ স্মৃতি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয় আর্জেন্তাইনদের! তাই ম্যাচটা অবশ্যই জিততে চাইবে আর্জেন্তিনা।
হ্যা ঠিকই ধরেছেন, আপনাদের অনেকের মতই আমিও একজন আর্জেন্তিনা সমর্থক। ছোটখাট সমর্থক না, বেশ বড় ধরণের সমর্থক! মনেপ্রাণে চাইছি আর্জেন্তিনা জিতুক। কিন্তু মানতে হবেই, প্রতিবন্ধকতা আছে অনেক।
প্রথম সমস্যা, আর্জেন্তিনার কোচ সমস্যা। ২০০৬ সালে পেকারম্যানকেই বিগত দিনগুলোর সবচেয়ে সফল কোচ হিসেবে বলেন অনেকে। ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের সৌন্দর্যকে বিশ্ববাসীর কাছে আরো একবার চিনিয়েছিলেন তিনি। দূর্ভাগ্য তার, মেসির মত স্টার তখন এতটাই নাবালক যে, তাকে খেলানোর সাহস তিনি দেখাতে পারেন নি। এই জার্মানির সাথেই কোয়ার্টার ফাইনালে এক গোলে এগিয়ে থেকেও টাইব্রেকারে হারতে হয়েছিল আরজেন্তিনাকে। সেদিন গোল কিপার অ্যাবান্ডনজিয়েরী আহত হয়ে মাঠ না ছাড়লে ফলাফল হয়ত অন্যরকম হত। ভুল অবশ্য করেছিলেন তিনি, রিকয়েলমেকে তুলে নিয়ে ডিফেনসিভ খেলার চেষ্টা একেবারেই ভুল সদ্ধান্ত ছিল তার।
এরপর ম্যারাডোনা যা দেখালেন তা আর না বলাই ভাল। গোটা বিশ্ববাসী দেখেছেন এই আরজেন্তাইন ফুটবল ইশ্বরের কীর্তি! কেউ কেউ তার কৌশলগত দক্ষতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “Maradona is a tactical disaster”.আরজেন্তিনাকে অলিম্পিকে সোনা জেতানো কোচ বাতিস্তা যখন দায়িত্ব নিলেন দলের, তখন অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু, কোপায় আবার ব্যর্থ আরজেন্তিনা। মেসি, হিগুয়েন, ডিমারিয়া, তেভেজদের পেয়েও আক্রমনভাগকে সফল করতে পারলেন না বাতিস্তা। বলা হলো,”Argentina is not a team. It is a set of talented players”। ফলাফল; এবারে খেলোয়ারাই বললেন তারা এই কোচের পদত্যাগ চান! অনেক জল্পনা কল্পনা চলল এরপর। কে হবেন আরজেন্তিনার নতুন কোচ? অনেক নাম আসল। শেষপর্যন্ত আলেসান্দ্র সাবেলা হলেন নতুন কোচ। শুরুতেই তিনি কোলকাতায় ও ঢাকায় দুটি প্রীতি ম্যাচ সফলভাবে সম্পন্ন করলেন। কিন্তু সমালোচনা হচ্ছে তার কৌশল নিয়েও। সবার মত তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ একটাই, তিনি ট্যলেন্টেড খেলোয়ারদের কাজে লাগাতে পারছেন না।
আসলে সমস্যা কোথায়? আর্জেন্তিনার মত দেশেও কেন এমন হচ্ছে? সমস্যা অনেকগুলো, প্রথম সমস্যা। আর্জেন্তিনার বড় বড় স্টার খেলোয়াররা কেউই একসাথে খেলার সুযোগ পাননা। তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে। এছাড়াও ডিফেন্সে ভালো মানের খেলোয়ারের খুবই অভাব। আক্রমনভাগ আর রক্ষণভাগের মাঝে চরম সমন্বয়হীনতা। মেসিকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা আজ পর্যন্ত কোন কোচই বুঝে উঠতে পারলেন না। মেসিকে অভিযোগ করা হয় তিনি জাতীয় দলে সফল না। তার মাঝে নাকি দেশের প্রতি কমিটমেন্টের অভাব আছে। কিন্তু মেসির মাঝে দেশপ্রেম না থাকলে তিনি এতদিনে স্পেনের জাতীয় দলে খেলতেন। মূলত তাকে সাপর্ট দেয়ার মত উপযুক্ত খেলোয়ার কিংবা কৌশল কোনটাই নেই আর্জেন্তিনার।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ যার বিরুদ্ধে তিনি হলেন AFA (Argentina Football Association) এর প্রেসেডেন্ট হুলিও গ্রন্ডোনা। যিনি বছরের পর বছর ধরে পদ আগলে বসে আছেন, টাকার কুমীর হয়ে উঠেছেন আর আরজেন্তিনার ফুটবল ঐতিহ্যকে ক্রমেই ধ্বংস করছেন।
যাইহোক আজকের খেলায় আর্জেন্টিনার কৌশল কেমন হতে পারে তা একবার দেখে নেয়া যাকঃ
———————–রোমেরো———————-
যাবেলাতা——-ফারনান্দেজ—–গ্যারায়———রোজো
সসা———-মাচেরানো—-গ্যগো——-ডিমারিয়া
—————মেসি———-হিগুয়েইন/অ্যাগুয়েরো
রদ্রিগেজের ইঞ্জুরির কারনে সসা প্রথম একাদশেই স্থান পাবেন। হিগুয়েইন ও আগুয়েরোর মধ্যে সম্ভবত হিগুয়েইন শুরু করবেন ও হাফ টাইমের পরে তাকে সাবস্টিটিউট করে অ্যাগুয়েরোকে নামানো হবে। এই একাদশই নামানো হবে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও ৪-৪-২ ফরম্যাটে যে আর্জেন্তিনা খেলবে তা মোটামোটি নিশ্চিত। ৪-৩-৩ এর বদলে ৪-৪-২ এ খেলার কারন হিসেবে কোচ সাবেলা বলেছেন, ৪-৪-৩ জার্মানির সাথে কিছুটা অসুবিধাজনক। মজার ব্যপার ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপেও তাদের এই ফরম্যাট ছিল আর এই ফরম্যাট নিয়েই তার বিশ্বকাপ জিতেছিল। দিন পাল্টিয়েছে কিন্তু ফরম্যট ঘুরেফিরে সেই একই!!
যাইহোক, অভিযোগ কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। কেন প্যাস্টরের মত একজন প্রতিভাবন উদীয়মান তারকাকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে? সসার জায়গায় প্যাস্টরেকে দেখতে চান অনেকেই। শুধু তাই নয়, কথা হচ্ছে তেভেজকে নিয়েও। কোপা আমেরিকায় তেভেজের খেলা ছিল কিছুটা স্বার্থপরের মত। তিনি যেন কোনদিকে না তাকিয়ে নিজেই বল নিয়ে ছুটতেন গোল স্কোরারের তকমা গায়ে লাগানোর জন্য। তাই বাদ দেয়া হয়েছিল জাতীয়দল থেকে। নিজের ক্লাব ম্যান সিটিতেও বাদ পড়েছিলেন কোচের সাথে ভুলবুঝাবুঝির জন্য। অনেকে ভেবেছিলেন তার ক্যরিয়ার হয়ত শেষ! কিন্তু কয়েকদিন আগে চেলসির সাথে দারুন খেলেছেন এবং গোলও করেছে তেভেজ। এবার কি তিনি জাতীয় দলে একটা সুযোগ পাওয়ার দাবি করতে পারেন না? বানেগা, বিলার্দোর মত খেলয়ারেরাও দাবি রাখেন দলে চান্স পাওয়ার।
মূল সমস্যাটা আসলে আমাদের দেশের মতই। হুলিও গ্রন্ডোনা পছন্দ করেন “চাটুকারিতা”। অন্তরমুখী চরিত্রের খেলোয়ারদের ঠাঁই নেই বললেই চলে তার দলে। তাছাড়াও আর্জেন্তিনার মত ফুটবল পাগল মানুষের দেশে ইয়থ ফুটবলের অবস্থা এতটাই খারাপ এখন যে, গত বারের চ্যম্পিয়নরা এবার কোয়ালিফাই করতেই পারেন অলিম্পিকে। আরজেন্তিনার বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধার মতে তাদের মূল এখন একটাই, হুলিও গ্রন্ডোনা। তার নির্দেশেই চলতে হয় প্রত্যেক কোচকে। আর্জেন্তিনা বারবার ব্যর্থ হয়, কোচ পরিবর্তন হয় কিন্তু AFA এর প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয় না।
যাইহোক, আমরা আর্জেন্তিনার উন্মাদ সমর্থক। বিশ্বকাপ আসলে আমাদের মাথা ঠিক থাকে না। বিশ্বকাপ ছাড়া অন্যান্য সময় অবশ্য খেলা নিয়ে এতটা মাথা কেউ ঘামান না, অনেকে মেতে থাকেন ক্লাব ফুটবল নিয়েই। তবুও আজকের খেলার প্রতি অন্তত আর্জেন্তিনা সমর্থকদের একটা আগ্রহ যে থাকবে তা একদম নিশ্চিত। আর আমার নিজের কথাতো বলাই বাহুল্য!!
(বিশ্বকাপের সময় এরকম লেখা হয়ত অনেকেই লিখবেন, কিন্তু অন্যান্য সময় এরকম লেখা কমই লেখন সবাই আর এই লেখা পড়ার প্রতিও আগ্রহ থাকবেনা সবার জানি। তবুও লিখলাম। একটু অবশরে পেয়েছেতো! অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে একটা পোস্ট দেব আশা করছি।)