টপিকঃ হারানো
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হারিয়ে যায় তনয়। তনয় ওর ডাক নাম। এটুকুই জানত ও। ভাল নামটাও জানা নেই ওর। মানুষ হয়েছে একটা এতিম খানায়।এখানে আসার পর ওর ভাল নাম রাখা হলো, ঈষাণ মুখার্জী। নিজেকে ঈষান নামেই পরিচয় দেয় ও। তন্ময় নামটা কাউকে বলে না। জীবনের নিষ্ঠুর দিকগুলোকে নিজের চোখ দিয়ে না, নিজের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে সে। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করছে সে। এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে এখন পড়ালেখা করছে নটরডেম কলেজে। টিউশনি করে পড়ালেখার খরচটাও বেশ চালিয়ে নিচ্ছে সে। নিজের চরিত্রের দৃঢ়তার জন্য জীবনটা এখন মোটামোটি একটা ভাল রাস্তা দিয়েই যাচ্ছে ওর। যেভাবে চলছে সে, এতে তার গন্তব্যটা শেষপর্যন্ত খারাপ হবে না, এটুকু বুঝতে পারে সে।
কিন্তু, মনটা কষ্টে ভরে ওঠে যখন সে দেখে, তার কোন বন্ধুর বাবা-মা, দেখা করতে এসেছে কলেজে। সহ্য করতে পারে না। ভালভাবে কথাও বলে না তখন। নিজেকে লুকিয়ে রাখে কোনমতে। আর মনে মনে সবসময় খুজে বেড়ায় মাবাবাকে।
যার মাঝে এত বড় একটা শূন্যতা রয়েছে, তার মনে রোমান্সের কোন স্থান থাকার কথা নয়। আসলেই তাই। আজও পর্যন্ত কোন মেয়ে তার মনের উপর কোন মেয়েই প্রভাব ফেলতে পারেনি। কৈশর ছেড়ে যৌবনের দিকে এগিয়ে চলেছে সে। এই বয়সে মনে অস্থিরতা আসা খুব স্বাভাবিক। অনেক মেয়েই তাকে পছন্দ করে, ভালকরেই জানে ও। করবেইবা না কেন? অনেক সুন্দর দেখতে সে। মুখটা খুব বেশি রকমের ইনোসেন্ট। এখনও যেন বাচ্চা রয়ে গেছে সে। এতিম খানায় যে মানুষগুলো ওকে মানুষ করেছেন, তারা বলেন, ও নাকি অনেকটা মেয়েদের মত দেখতে ছিল ছোটবেলায়!! এখন অবশ্য চেহারা কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে ওর। গায়ের রং বেশ কালো হয়ে গেছে। তারপরো অনেক সুন্দর। তো, এত সুন্দর, সংগ্রামী একটা ছেলেকে ভাল না বেসে উপায় আছে? সবার ভালবাসা পেয়েছে ও। সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে। আর তাই টিউশনি নিয়ে যখন একটু ঝামেলার মাঝে আছে, ঠিক তখন ওর খুব ভাল এক বন্ধু নাম অনুপ, প্রস্তাব দিল তাদের পাশের বাড়ির ক্লাস এইটের এক ছাত্রকে পড়ানোর। রাজি না হওয়ার কোন কারন নাই তনয়ের।
শুরু করল পড়ানো। ছেলেটার নাম তন্ময়। ওর নামের সাথে দারুন মিল। যদিও ব্যপারটা জানেনা ওরা। কারন ওরাতো ওকে ঈষান নামে জানে। যাইহোক, অল্পদিনেই খুব বেশি ঘনিষ্ট হয়ে গিয়েছে ও। তন্ময়ের মা যেন একটু বেশিই ভালবাসেন ওকে। অনেক ঘনিষ্ট হলেও নিজের ব্যক্তিগত ব্যপারগুলো শেয়ার করতে চায় না ও।
একদিন পড়াতে এসে ও দেখতে পেল, টেবিলের উপরে একটা ছবির এলবাম রাখা। হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করল তনয়। একটা বাচ্চার ছবি। সাথে আছেন তন্ময়ের বাবা মা। তার মানে, তন্ময়ের কোন ছোট বোনের ছবি এইটা। অসম্ভব সুন্দর একটা বাচ্চার ছবি! বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন আনমোনা হয়ে গেল তন্ময়। যে মেয়ে বাচ্চা অবস্থায় এতটা সুন্দর, সে এখন কতটা সুন্দর হতে পারে! ছবির তারিখটাও দেখল ও। সবগুলো ছবি আজ থেকে প্রায় পনের, ষোল বছর আগে তোলা। মেয়েটার বর্তমান চেহারা কেমন হতে পারে অনুমান করতে চেষ্টা করল ও। বয়সটাতো তাহলে ওর মতই হওয়ার কথা! আর একটা ব্যপার খেয়াল করল ও। ছবিতে তনয় কোথাও নেই।ঠিকই আছে, যে সময়ের ছবি, ওই সময় তনয়ের জন্মই হয়নি! তারমানে তন্ময়ের দিদি এটা। কল্পনার চোখে দেখতে লাগল, কেমন হবে তার বর্তমান চেহারাটা? ছোটবেলায় যে এতটা সুন্দর ছিল, সে এখন না জানি কত সুন্দর দেখতে! মনটা বড় বেশি উতলা হয়ে উঠল ওর। প্রেমে পড়ে গেল নাকি?? কিন্তু, হঠাত মনে প্রশ্ন জাগল ওর, কোনদিনতো বাসায় দেখেনি তাকে! কেন? বিয়ে হয়ে যায়নিতো? অস্থিরতা যেন চূড়ান্ত আকার ধারন করল।
“কি হোল ঈষান? তোমাকে ডাকছি তখন থেকে” তন্ময়ের মা পাশে এসে কথন দাঁড়িয়েছেন বুঝতেও পারেনি ও। একটু যেন লজ্জাই পেয়ে গেল। চিন্তার সাগরে ডুব দিয়ে। সবকিছু যেন ভুলে গিয়েছিল ও। অনেক ইতস্তত করে শেষমেষ বলেই বসল,”আচ্ছা কাকিমা, এই ছবিগুলো কার? তনয়ের বোন আছে, আগেতো জানতাম না। ”
মনটা যেন খুব খারাপ হয়ে গেল ভদ্রমহিলার। বলল,”না বাবা, এইটা আমার মেয়ে না, এইটা আমার ছেলে। ছোটবেলায় একদম মেয়েদের মত দেখতে ছিল। সবাই মেয়েই ভাবত ওকে। আজ প্রায় পনের, ষোল বছর আগে হারিয়ে যায় ও। আর খুজে পাইনি।”
ধাক্কা খেল বড় রকমের। এতসময় ধরে একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল ও!! কিন্তু সেইসাথে যেন একটু আশাও জেগে উঠল মনে। স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় ও; তবুও যেন একটা ছোট্ট আসা আচ্ছন্ন করে ফেলল ওর মনটাকে।মনটা আবার খারাপ হয়ে যাবে হয়ত, তবুও জানতে চাইল, নিজের মনকে দমন করতে না পেরে,
“নাম কি ছিল ওর?” জানতে চাইল ভয়ে ভয়ে।
“ভাল নাম রাখাই হয়নি তখনো। অনেকে অনেক নাম বলতো, ডাক নাম রেখেছিলাম, তনয়!!!”