টপিকঃ সীরাতুন্নবী (সাঃ)-১৪ সিনা চাকের ঘটনা
সিনা চাকের ঘটনা
দুধ ছাড়ানোর পরও শিশু মোহাম্মদ বনু সা’দ গোত্রেই ছিলেন। তাঁর বয়স যখন চার অথবা পাঁচ বছর তখন সিনা চাক এর ঘটনাটি ঘটে।
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত রয়েছে। বর্ণিত আছে যে, রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হযরত জিবরাঈল (আ) আগমন করলেন। এ সময় রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য শিশুদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরাঈল (আ) তাঁকে শুইয়ে বুক চিরে দিল বের করলেন। তারপর দিল থেকে একটি অংশ বের করে বললেন, এটা তোমার মধ্যে শয়তানের অংশ। এরপর দিল একটি তশতরিতে রেখে যমযম কূপের পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেন। তারপর যথাযথ স্থানে তা স্থাপন করলেন। অন্য শিশুরা ছুটে গিয়ে বিবি হালিমার কাছে বললো, মোহাম্মদকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরিবারের লোকেরা ছুটে এলো। এসে দেখলো তিনি বিবর্ণমুখে বসে আছেন।
মায়ের স্নেহ ও দাদার আদরে
এ ঘটনার পর বিবি হালিমা ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি শিশুকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরেয়ে দিয়ে এলেন। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের স্নেহছায়ায় কাটালেন।
এদিকে হযরত আমেনার ইচ্ছা ছিলো যে, তিনি পরলোকগত স্বামীর কবর যেয়ারত করবেন। পুত্র মোহাম্মদ, দাসী উম্মে আয়মন এবং শ্বশুর আবদুল মোত্তালেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদীনায় পৌছুলেন। একমাস সেখানে অবস্থানের পর মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি আবওয়া নামক জায়গায় এসে বিবি আসেনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্রমে এই অসুখ বেড়ে চললো। অবশেষে তিনি আবওয়ায় ইন্তিকাল করেন।
বৃদ্ধ আবদুল মোত্তালেব পৌত্রকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় পৌছুলেন। পিতৃমাতৃহীন পৌত্রের জন্যে তাঁর মনে ছিলো ভালোবাসার উত্তাপ। অতীতের স্মৃতিতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। পিতৃমাতৃহীন পৌত্রকে তিনি যতোটা ভালোবাসতেন, এতো ভালোবাসা তাঁর নিজ পুত্র কন্যা কারো জন্যেই ছিলো না। ভাগ্যের লিখন, বালক মোহাম্মদ সে অবস্থায় ছিলেন একান্ত নিঃসঙ্গ; কিন্তু আবদুল মোত্তালেব তাঁকে নিঃসঙ্গ থাকতে দিতেন না, তিনি পৌত্রকে অন্য সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। ইবনে হিশাব লিখেছেন আবদুল মোত্তালেবের জন্যে কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তাঁর সব সন্তান সেই বিছানার চারিদিকে বসতো। কিন্তু মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। তিনি ছিলেন অল্প বয়ষ্ক শিশু। তাঁর চাচারা তাঁকে বিছানা থেকে সরিয়ে দিতেন। কিন্তু আবদুল মোত্তালেব বলতেন, ওকে সরিয়ে দিয়ো না। ওর মর্যাদা অসাধারণ। বরং তাঁকে নিজের পাশে বসাতেন। শুধু বসানোই নয়, তিনি প্রিয় দৌহিত্রকে সব সময় নিজের পাশে রাখতেন। বালক মোহাম্মদের কাজকর্ম তাঁকে আনন্দ দিতো।
বয়স আট বছর দুই মাস দশদিন হওয়ার পর তাঁর দাদার স্নেহের ছায়াও উঠে গেলো। তিনি ইন্তিকাল করলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার পুত্র আবু তালেবকে ওসিয়ত করে গেলেন, তিনি যেন ভ্রাতুষ্পুত্রের বিশেষভাবে যত্ন নেন। উল্লেখ্য আবু তালেব এবং আবদুল্লাহ ছিলেন একই মায়ের সন্তান।
চাচার স্নেহবাৎসল্যে
আবু তালেব ভ্রাতুষ্পুত্রকে গভীর স্নেহ-মমতার সাথে প্রতিপালন করেন। তাঁকে নিজ সন্তানদেন অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বরং নিজ সন্তানদের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন, চল্লিশ বছরের বেশি সময় পর্যন্ত প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে সহায়তা দেন। আবু তালেব ভ্রাতুষ্পুত্রের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই মানুষের সাথে শক্রতা মিত্রতার বন্ধনও স্থাপন করতেন।
আল্লাহর রহমতের সন্ধানে
ইবনে আসাকের জলাহামা ইবনে আরাফাতার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, আমি মক্কায় এলাম। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টির ফলেই এর সৃষ্টি হয়েছে। কোরায়শ বংশের লোকেরা বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে আবু তালেবের কাছে আবেদন জানালো। আবু তালেব একটি বালককে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বালকটিকে দেখে মেঘে ঢাকা সূর্য মনে হচ্ছিলো। আশে পাশে অন্যান্য বালকও ছিলো। আবু তালেব সেই বালককে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘরের সামনে গেলেন। বালকের পিঠ কাবার দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন। বালক তাঁর হাতে আঙ্গুল রাখলো। আকাশে এক টুকরা মেঘও ছিলো না। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সমগ্র আকাশ মেঘে ছেয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। শহর প্রান্তর সজীব উর্বর হয়ে গেলো। পরবর্তীকালে আবু তালেব এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তিনি সুদর্শন, তাঁর চেহরা থেকে বৃষ্টির করুণা প্রত্যাশা করা হয়। তিনি এতিমদের আশ্রয় এবং বিধবাদের রক্ষাকারী।
পাদ্রী বুহাইরা
নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স যখন বারো বছর, মতান্তরে বারো বছর দুই মাস দশদিন হলো তখন আবু তালেব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্য সিরিয়ায় রওয়ানা হলেন। বসরায় পৌছার পর এক জায়গায় তাঁবু স্থাপন করলেন। সেই সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী সেরা ছিলো। সেই শহরে জারজিস নামে একজন পাদ্রী ছিলেন। তিনি বুহাইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। কাফেলা তাঁবু স্থাপনের পর বুহাইরা র্গীজা থেকে বের হয়ে কাফেলার লোকদের কাছে এলেন এবং তাদের মেহমানদারী করলেন। অথচ পাদ্রী বুহাইরা কখনো র্গীজা থেকে বের হতেন না। তিনি রসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনে ফেললেন এবং তাঁর হাত ধরে বললেন, তিনি সাইয়েদুল আলামিন। আল্লাহ তায়ালা একে রহমাতুললিল আলামিন হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আবু তালেব বুহাইরাকে জিজ্ঞসা করলেন, আপনি এটা কিভাবে বুঝলেন? তিনি বললেন? আপনারা এই এলাকায় আসার পর এই বালকের সম্মানে এখানকার সব গাছপালা এবং পাথর সেজদায় নত হয়েছে। এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে না। তাছাড়া মোহরে নবুয়তের দ্বারা আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে নরম হাড়ের পাশে একটি “সেব” ফুলের মতো মজুদ রয়েছে। আমরা তাঁর উল্লেখ আমরা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে দেখছি।
এরপর পাদ্রী বুহাইরা আবু তালেবকে বললেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিন। সিরিয়ায় নিবেন না। ইহুদীরা ওর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী আবু তালেব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন।
[....................................................চলবে..................................................]