টপিকঃ সীরাতুন্নবী (সাঃ)-৯
সামগ্রিক অবস্থা
আরবের জনগন বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে বসাবস করতো। প্রতির শ্রেণীর অবস্থা ছিলো অন্য শ্রেণীর চেয়ে আলাদা। অভিজাত শ্রেণীতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক ছিলো যথেষ্ট উন্নত। এ শ্রেণীর মহিলাদের স্বাধীনতা ছিলো অনেক। এদের কথার মূল্য দেয়া হতো। তাদের এতোটা সম্মান করা হতো এবং নিরাপত্তা দিয়া হতো যে, এরা পথে বেরোলে এদের রক্ষের জন্যে তলোয়ার বেরিয়ে পড়তো এবং রক্তপাত হতো। কেউ নিজের দানশীলতা এবং বীরত্ব প্রসঙ্গে নিজের প্রশংসা করতো, তখন সাধারণত মহিলাদেরই সম্বোধন করতো। মহিলার ইচ্ছে করলে কয়েকটি গোত্রকে সন্ধি-সমঝোতার জন্যে একত্রিত করতো, আবার তাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের আগুনও জ্বালিয়ে দিতো। এসব কিছুও সত্তেও পুরুষদের মনে হতো পরিবারের প্রধান এবং তাদের কথা গুরুত্বের সাথে মান্য করা হতো। এ শ্রেণীর মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্ক বিয়ের মাধ্যমে নির্ণিত হতো এবং মহিলাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে এ বিয়ে সম্পন্ন হতো। অভিভাবক ছাড়া নিজের বিয়ের করার মতো কেননা অধিকার নারীদের ছিলো না।
অভিজাত শ্রেণীর অবস্থা এরকম হলেও অন্যান্য শ্রেণীর অবস্থা ছিলো ভিন্নরূপ। সেসব শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের যে সম্পর্ক ছিলো সেটাকে পাপাচার, নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং ব্যভিচার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াতে বিয়ে ছিলো চার প্রকার।
প্রথমটা ছিলো বর্তমানকালের অনুরূপ। যেমন, একজন মানুষ অন্যকে তার অধীনন্থ মেয়ের বিয়ের জন্যে পয়গাম পাঠাতো। সে তা তার মঞ্জুর হওয়ার পর মোহরানা আদায়ের মাধ্যে বিবাহ হতো।
দ্বিতীয়টা ছিলো এমন, বিবাহিত মহিলা রজস্রাব থেকে পাক সাফ হওয়ার পর তার স্বামী তাকে বলতো, অমুক লোকের কাছে পয়গাম পাঠিয়ে তার কাছ থেকে তার লজ্জস্থান অধিকার করো। অর্থাৎ তার সাথে ব্যভিচার করো, এ সময় স্বামী তার নিজ স্ত্রী কাছ থেকে দূরে থাকতো, কাছে যেতো না। যে লোকটাকে দিয়ে ব্যভিচার করানো হচ্ছিলো, তার দ্বারা নিজ স্ত্রী গর্ভে সন্তান আসার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রীর কাছে যেতো না। গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর তার স্বামী ইচ্ছে করলে স্ত্রীর কাছে যেতো। এরূপ করার পর ছিলো যাতে, সন্তান অভিজাত এবং পূরিপূর্ণহতে পারে। একে বলা হয় “এসতেবজা”বিবাহ। ভারতেও এ বিয়ে প্রচলিত আছে।
তৃতীয়ত দশ মানুষের চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ কোন জায়গায় একজন মহিলার সাথে ব্যভিচার করতো। গর্ভবতী এবং সন্তান প্রসবের পর সেই মহিলা সেসব পুরুষকে কাছে ডেকে আনতো। এ সময়ে কারো অনুপস্থির থাকার উপায় ছিলো না। সকলে উপস্থিত হলে সেই মহিলা বলতো, তোমরা যা করছো সে তা তোমরা জানো, যখন আমার গর্ভ থেকে এ সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে হে অমুক, এ সন্তান তোমরা। সেই মহিলা ইচ্ছেমতো যে কারো নাম নিতে পারতো এবং যার নাম নেয়া হতো, নবজাত শিশুকে তাঁর সন্তান হিসাবে সবাই মেনে নিতো।
চতুর্থতঃ বহুলোক একত্রিত হয়ে একজন মহিলার কাছে যেতো। সেই মহিলা যে কোন ইচ্ছুক পুরুষকেই বিমুখ তরতো না বা ফিরিয়ে দিতো না। এরা ছিলো পতিতা। এরা নিজেদের ঘরের সামনে একটা পতকা টানিয়ে রাখতো। ফলে ইচ্ছে মতো যে কেউ বিনা বাধায় তাদের কাছে যেতে পারতো। এ ধরণের মহিলা গর্ভবতী হলে এবং সন্তান প্রসব করলে যারা তাদের সাথে মিলিত হয়েছিলো তারা সবাই হাযির হতো এবং একজন বিশেষজ্ঞকে ডাকা হতো। সেই বিশেষজ্ঞ তার অভিমত অনুযায়ী সন্তানটিকে কারো নামে ঘোষনা করতো। পরবর্তী সময়ে শিশু ঘোষিত ব্যক্তির সন্তান হিসাবে বড় হতো এবং কখনো সে ব্যক্তি সন্তানটিকে অস্বীকার করতে পারত না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আর্বিভাবের পর আল্লাহ তায়ালা জাহেলি সমাজের সকল প্রকার বিবাহ প্রথা বাতিল করে ইসলামী বিবাহ প্রথা প্রচলন করলেন।
আরবে নারী পুরুষের সম্পর্ক অনেক সময়ে তলোয়ারের ধারের মাধ্যমে নির্ণিতম হতো। গোত্রীয় যুদ্ধে বিজয়ীরা পরাজিত গোত্রের মহিলাদের বন্দী করে নিয়ে নিজেদের হারামে অন্তরীণ রাখতো। এ ধরণের বন্দিনীয় গর্ভজাত সন্তানেরা সমাজে কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। তারা সব সময় আত্নপরিচয় দিতে লজ্জা অনুভব করতো।
জাহেলিয়ার যুগে একাধিক স্ত্রী রাখা কোন দোষণীয় ব্যাপার ছিলো না। সহোদয় দুই বোনকেও অনেকে একই সময়ে স্ত্রী হিসাবে ঘরে রাখতো। পিতার তালাক দেয়া স্ত্রী অথবা মৃত্যুর পর সন্তান তার সৎ মায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে হতো। তালাকের অধিকারী ছিলো শুধুমাত্র পুরুষের এখতিয়ার। তালাকের কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট ছিলো না।
ব্যভিচার সমাজের সর্বস্তরে প্রচলিত ছিলো। কোন শ্রেণী নারী-পুরুষই ব্যভিচারের কদর্যতা ও পস্কলিতা থেকে মুক্ত ছিলো না। অবশ্য কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষ এমন ছিলো যারা নিজদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার কারণে এ থেকে বিরত থাকতো। এছাড়া স্বাধীন মহিলাদের অবস্থা তূলনামূলকভাবে দাসীদের চেয়ে ভালো ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিলো সবচেয়ে খারাপ। জাহেলি যুগের অধিকাংশে পুরুষ দাসীদের সাথে মেলামেশা দোষ এবং লজ্জা মনে করে করত না। সুনানে আবু দাউদে উল্লেখ্য রয়েছে যে, একজন দাঁড়িয়ে একদা বললো, হে আল্লাহর রাসূল, অমুক আমার পুত্র সন্তান। জাহেলি যুগে আমি তার মায়ের সাথে মিলিত হয়েছিলাম। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইসলামের এ ধরণের দাবীর কোন সুযোগ নেই। এখন তো সন্তান সেই ব্যক্তির মালিকানাধীন, যার স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে সেই পরিচিতা। আর ব্যভিচারের জন্যে রয়েছে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুর শাস্তি। হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) এবং আবদ ইবনে জামায়ার মধ্যে জামায়ার দাসীর পুত্র আবদুর রহমান ইবনে জামায়ার বিষয়ে যে ঝগড়া হয়েছিলো, সেটা তো সর্বজনবিদিত। জাহেলি যুগে পিতার পুত্রের সম্পর্কও ছিলো বিভিন্ন রকমের। কিছু লোক ছিলো এমন যারা বলতো, আমাদের সন্তান আমাদের কলিজার মতো যারা মাটি চলেফেরা করে।
অন্য কিছু লোক এমন ছিলো, যার অপমান এবং দারিদ্র্যের ভয় কন্যা সন্তানকে জীবিত মাটির প্রাথিত করতো। শিশু সন্তানকে শৈশবেই মেরে ফেলতো।
পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ্য রয়েছে। এ অবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো কিনা তা বলা মুশিকল। কেননা আরবের লোকেরা শক্রদের মোকাবেলা এবং আত্নরক্ষার জন্যে অন্যান্য জাতির চেয়ে বেশিসংখ্যক জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো। এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিলো বলা যায়।
সহোদয় ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক, চাচাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক এবং গোত্রের অন্যান্য লোকদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক যথেষ্ট মুযবুত। কেননা আরবের লোকেরা গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং অহমিকার জোরেই বাঁচতো এবং মরতো। গোত্রীয় মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সর্হমর্মতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। গোত্রীয় সম্পর্কের ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত ছিলো।
তারা এ দৃষ্টভঙ্গি লালন পালন করতো যে, ভাইয়ের সাহায্য করো, সে অত্যাচারী বা অত্যাচারিত যা কিছুই হোক। পরবর্তীকালে ইসলাম অত্যাচারীকে তার অত্যাচার থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলো। প্রভুত্ব ও সর্দারীর চেষ্টায় কোনো গোত্রের একজন লোকের সমর্থনে গোত্রের অন্য সব লোক যুদ্ধ জন্য বেরিয়ে পড়তো। উদাহরণস্বরূপ আওস-খাজরায আবস-জুবয়ান, বকর-তাগলাব প্রভৃতি গোত্রের ঘটনা উল্লেখ্য করা যায়।
বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্কের এতো অবনতি হয়েছিলো যে, গোত্রসমূহের সমন্ত শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয়িত হতো। দ্বীনী শিক্ষার কিছুটা প্রভাব এবং সামাজিক-রূসব-রেওয়াজের কারণে অনেক সময় যুদ্ধের বিভীষিকা ও ভয়াবহতা কম হতো। অনেক সময় সমাজে প্রচলিত কিছু নিয়ম কানুনের অধীণে বিভিন্ন গোত্র মৈত্রী বন্ধনেও আবদ্ধ হতো। এছাড়া নিষিদ্ধ মাসসমূহ পৌত্তলিকদের জীবনে শান্তি স্থাপন এবং তাদের জীবিকা অর্জনে বিশেষ সহায়ক প্রমাণিত হতো।
মোটকথা সামগ্রিক অবস্থা ছিলো চরম অবনতিশীল। মূর্খতা ছিলো সর্বব্যাপী। নোংরামী ও পাপাচার ছিলো চরমে। মানুষ পশুর মতো জীব ন যাপন করতো। মহিলাদের বেচাকিনার নিয়ম প্রচলিত ছিলো। মহিলাদের সাথে অনেক সময় এমন আচরণ করা হতো যে তারা মাটি বা পাথর। পারস্পরিক সম্পর্ক ছিলো দুর্বল এবং ভঙ্গুর। সরকার বা প্রশাসন নামে যা কিছু ছিলো তা প্রজাদের কাজ থেকে অর্থ সম্পদ সংগ্রহ করে কোষাগার পূর্ণ করা এবং প্রতিরক্ষের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের কাজে নিয়োজিত থাকতো।
[................চলবে........................]