টপিকঃ অত:পর? পর্ব-১
পর্ব-১
‘আচ্ছা রিন্তি, কী কান্ডটা করেছিস? হ্যাঁ?’
টেবলে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে যায় নেয়াজ। গরম ধোঁয়া ওঠা দুধ সাদা ভাত, শিম ভাজি, পাট শাকের ভাজি সাথে শুকনো মরিচ আর শোল মাছের ঝাঁল। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না এগুলি খাবার ইচ্ছেটা কয়েকদিন ধরেই কেমন একটা পেটুকে আর্জি নিয়ে তাকে জ্বালিয়ে মারছিল। অথচ তার যেরকম ভবঘুরে জীবন যাপন-আজ এখানে তো কাল ওখানে গিয়ে ডুব মারা...রক্তের বলতে কেউই নেই যে যার কাছে গিয়ে আবদার জুড়বে ভালো-মন্দ কিছু খাবে বলে। ভালো-মন্দ? সত্যিই তো, কতদিন তেমন কিছু খাওয়া হয় না! শুধু সেই ক’বে রানু খালা তাকে যত্ন নিয়ে পছন্দের খাবারগুলি খাওয়াতেন...মনেও নেই ভালো করে। আনমনা হয়ে যায়...
-কী? হাঁ করে দেখছ কী? নাও, চটপট মুখ হাত ধুয়ে নিয়ে আগে খেতে আস তো। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকদিন কিছু খাও না!
-উম...হু...সম্বিত ফিরে পায় নেয়াজ। ‘তা টয়লেট রুমটা দেখিয়ে দিবি তো?’
-কী আদিখ্যেতা! যেন কিছুই জান না? কিছুই বদলায় নি। টয়লেট রুম, টয়লেট রুমের জায়গায়ই আছে। আর প্রায় সব কিছুও তেমনি...কেবল তুমিই...
কথাটা শেষ করতে দেয় না নেয়াজ। তড়িঘড়ি বলে, ‘ অ, তাই নাকি? আচ্ছা, আচ্ছা যাচ্ছি’
টয়লেট রুমের বড় আয়নাটাতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আঁতকে ওঠে নেয়াজ নাঈম! কতদিন আয়না দেখে নি তাই মনে করতে পারল না! আর আয়নার পারদে এ কার চেহারা? চুল-দাড়ির অবাধ স্বাধীনতায় ঢাকা পড়েছে একদা লাজুক একখানা সরল মুখ। শুধু চোখ দু’টোই কী আশ্চর্য উজ্জ্বল, ভাবালু-অপরিবর্তিত ঠিক বহুকাল আগের মত! এই বাড়িতেই আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে কেটেছে তার শৈশব, দ্বিধান্বিত কৈশোর আর আর যৌবনের সূচনা-বৃষ্টি! তারপর কী থেকে যে কী হয়ে গেলো... তাকে হারিয়ে যেতে হলো...তলিয়ে গেলো সমস্ত বন্ধন।
তোয়ালেতে মুখ হাত মুছতে মুছতে খাবার টেবলে চলে আসে। রিন্তি কেমন একমনে যত্নের সাথে টেবল সাজাচ্ছে...গিন্নী গিন্নী ভাব। ‘বড় হয়ে গেছে মেয়েটা’ ভাবল সে।
-তুই তো দেখি বেশ বড় হয়ে গেছিস! বাব্বাহ!
-বা রে, চিরদিন সেই ছোটটিই থাকবো নাকি? তাই বুঝি ভাবছিলে?
-ইয়ে...মানে আমি তাই-ই ভাবতে ভাবতে আসছিলাম। ফিঁচ-কাঁদুনে কথায় কথায় গাল ফুলানো একটা মেয়ের গাল দুটো টিপে দেব...( ...হাসতে থাকে নেয়াজ)
-ইস! অনেক জ্বালিয়েছিলে। এখন করে দেখতো, মজা টের পাবে।
-কী করবি?
-এক্কেবারে কাঁচায় খেয়ে ফেলব।
-এই সেরেছে! তা খাওয়ার আগে আমায় একটু খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে নে...হা হা হা।
জীভ কেটে রিন্তি বলে, ‘ এ মা, শুরু করো, শুরু করো’ খাবারগুলো দেখে হঠাত নেয়াজের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এতো ভালোবাসা, আদর-যত্ন...সে কী আদৌ এ সবের যোগ্য?
-আচ্ছা, এ তো সব আমার পছন্দের খাবার! মনে রেখেছিস?
-আমার বয়েই গেছে মনে রাখতে! মা ই মনে রেখেছে। গলার অভিমানটুকু অধরা থাকে না নেয়াজের কাছে। সেই পুরনো আগুনের আঁচ পায় কি এতদিন পরেও? কীভাবে সম্ভব? প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেয়।
-হ্যাঁ রে, খালামণি কে দেখছি না যে?
-জনাব, এখন মোটে দু’টো বেজে পঁচিশ মিনিট। মা বুঝি অফিস ফেলে তোমার জন্য বসে থাকবে?
-ও, তাই তো! আমার যে কী হয়েছে না? কিছুই মনে থাকতে চায় না! সেদিন সুহৃদের সাথে আচমকা দেখা হয়ে গেলে বড় দুঃখ করলো। খালামণি নাকি প্রায়ই আমার কথা বলে কাঁদেন! হঠাত কী হয়ে গেলো, বুঝলি? বুকটা উথাল পাথাল করে উঠলো। কতদিন হয়ে গেলো খালামণি কে দেখি না! ওনার জন্যই তো আসতে হলো?
-ও, আর কারো জন্য নয় বুঝি? রিন্তির চোখে অদ্ভূত চাউনি।
এইক্ষণে নেয়াজ বিষম খেলো? সামলে নিয়ে কোনোরকমে বলল,
-আর কার জন্য আবার?
-নাহ, কারো জন্য নয়? গভীর বিষাদের একটা চোরা সুর কি বাজে রিন্তির কন্ঠে? অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘নিজুদা, তুমি এত নিষ্ঠুর কেন?’
চলবে..
অত:পর? পর্ব-২
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।