টপিকঃ কেন এলে? পর্ব-১
পর্ব-১
ধাই করে নেমে গেছে খাড়া পাহাড়ের পাথুরে শরীর। নীচে অনেক নীচে বইছে একটা শীর্ণ নদী। কুল...কুল...কুল...। কিক কিক ক্রিচি ক্রিচি...নাম না জানা একটা পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পড়ন্ত বেলার নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙ্গে দিয়ে উড়ে গেলো। চমকে উঠে অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে রইল রেয়ান। কী পাখি ওটা? ঈষত ভ্রু কুঁচকে চেনার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। যে ভারী চশমা সেঁটে রয়েছে নাকে, মুশকিলই বটে! ক্লিফের একেবারে কিনারায় বিপজ্জনকভাবে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তন্ময় হয়ে গিয়েছিলো কোলাহলবিহীন জগতে। হঠাত পাখিটার এই বেরসিকতায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো। প্রকৃতি শূন্যতার মত কে জানে হয়তো প্রায়-শব্দহীণতাও কাউকে উজাড় করে দিতে ভালবাসে না! আর ভালোও হয়তো বাসে না প্রকৃতির বিরুদ্ধবাদ! হঠাত সুরেলা একটা কন্ঠঃ
-এই যে শুনছেন?
রেয়ান শুনলো বটে তবে চমকের ঠেলায় আরেকটু হলে পড়ে গেছিলো আর কি! আহ ঈশ্বর! এখানেও মানুষ! রেয়ানের গভীর ধারণা ছিলো এই বিপজ্জনক সৌন্দর্যে কেউ আসবে না; আসার কথাও না! কিন্তু এ কী? এ যে জলজ্যান্ত একটা মেয়ে! রাগে গরগর করে উঠলোঃ
-কী চাই? না ফিরেই থমথমে মুখে খেঁকিয়ে উঠলো সে।
মধ্য বিশের ছিপছিপে একটা মেয়ে। শ্যামলা মুখে একটা ছুঁই ছুঁই উদ্বেগের মধ্যেও রেয়ানের রূঢ়তা জায়গা করে নিতে ভুললো না।
-না, মানে শুনছেন? আমি বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি...ফিকে হয়ে আসে সুর-তরঙ্গ।
-তো আমি কী করব? আমাকে কি আপনার গাইড মনে হয়? মুখে পষ্ট বিরক্তি।
-আচ্ছা লোক তো আপনি? একটা মেয়ে পথ হারিয়ে সাহায্য চাইতে এসেছে...আর আপনি কিনা সাধারণ সৌজন্যবোধটুকুও দেখাচ্ছেন না; মুখ ঘুরিয়ে অভদ্রের মত উত্তর করছেন...মেয়েটার গলায় ঈষৎ ঝাঁঝ।
একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে একহাত দেখে নেবার জন্য মুখ ঘোরাতেই রেয়ান থতমত খেয়ে গেলো। এ কী দেখছে সে! এ যেন খাজুরাহ’র অপ্সরা নেমে এসেছে। কানায় কানায় উপচে পড়ছে সৌষ্ঠব; যত্নে গড়া নিখুঁত চড়াই উতরাই। তবে পার্থক্য একটাই; প্রতিমার গায়ে হাফ স্লীভ ব্লাউজ আর একটা থ্রী কোয়ার্টার ট্রাওজারস। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আগের বিরক্ত ভাবটা বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করলঃ
-পথ হারিয়ে ফেলেছেন মানে কী? এই বিপজ্জনক দুর্গম জায়গায় আপনার আসতে হলো কেন শুনি? উঠে দাঁড়িয়েছে রেয়ান।
নীলিমা দেখল দীর্ঘদেহী এক যুবক। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল কাঁধ ছুঁইছুঁই করছে। চতুষ্কোণ চিবুকে তিরিক্ষে একটা রাগ খেলে গেলেও মুখখানাতে একটা অদ্ভূত সারল্য আছে। আর আর কোথায় যেন একটা ভরসা করবার মত কিছু একটা...অজান্তে বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে নীলুর।
-কী হলো বোবা হয়ে গেলেন কেন? বলুন কীভাবে এলেন এখানে?
-কিছু মনে করবেন না, আপনাকে হয়তো বিরক্ত করে ফেললাম। আসলে আমরা মানে আমি আর আমার এক বন্ধু অনেকটা খেয়ালের বশে এই গভীর বন-পাহাড়ে এসেছিলাম। আমাদের সি আর-ভি টা হাইওয়ের পাশে বনের কিছু ভেতরে ফাঁকা জায়গাটায় পার্ক করা ছিলো। আমার বন্ধুটি জরুরী একটা ফোন-কলে ব্যস্ত হয়ে গেলে বোরড হয়ে আমি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটু একটু করে হাঁটতে থাকি। এত সুন্দর সবুজ, নিস্তব্ধতা...জানেন কীভাবে যে মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে আসি...বলতে পারি না...
-আর তারপর যা হবার তাই হলো। পথ হারিয়ে এখন আমাকে সাধছেন...কী রকম ছেলেমানুষি একটা করলেন বলেন দেখি! আপনার বন্ধুটি কী ভাবনায় পড়েছেন বলেন দেখি? গলায় গুড়গুড়ে রাগটা এখনো জানান দিচ্ছে!
-আচ্ছা, আপনি কি সবসময় এভাবে রেগে রেগে কথা বলেন? নীলুর গলায় দলার মত একটা কান্না উথলে ওঠে বুঝি!
রেয়ান একটু নিভে যায়; একটু নরম হয়ে যায় বুঝি। অপ্সরার কান্না কান্না ভাবের চোখদুটো কীভাবে যেন গহীনে চেপে থাকা আগুনে ক’ফোঁটা সহজভাবের জল ছিটিয়ে দেয়।
-কোথায় রেগে কথা বল্লাম...একটা কিছু বললেই তো আপনাদের মহা অস্ত্রটি নিপুণ ভাবে প্রয়োগ করে ফেলেন। আচ্ছা, যাক কাজের কথায় আসি। পথ হারিয়েছেন ভালো কথা, এই ঝামেলার জায়গায় সেটা হতেই পারে। সাথের মোবাইলটি তো আর হারান নি; কল করুন জলদি।
-উম...আমি না ওটা ফেলে এসেছি...
-খুব ভালো করেছেন! এখন যে কী করি? নিভন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে থাকল। ‘আমারটাও যে আনা হয় নি! ভালো সমস্যায় ফেললেন...’
-আপনারটা আনেন নি কেন? নীলু একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
-সেটা এখন না জানলেও চলবে। চলুন, দেরি না করে হাইওয়ে বরাবর হাঁটতে থাকি।
আর তক্ষুনি রেয়ানের দিকে তাকিয়ে নীলুর বড্ড হাসি পেয়ে গেলো; ভুলোমনা নাকি? খালি পা, পায়ে যে জুতো নেই এই খেয়ালই নেই! আজব তো! হাসি হাসি মুখে বলল,
-আপনার পায়ে জুতো স্যান্ডাল কিছু দেখছি না...কিছু একটা আদৌ পরেছিলেন নাকি খালি পায়ে হাঁটা-বাবা হয়ে এসেছিলেন? ফিক করে হেসে ফেলে নীলু।
অপ্রস্তুত হয়ে পাশে রাখা স্যান্ডেলে পা গলাতে গলাতে বলে ওঠে, ‘ বলিহারি আপনার নার্ভ! এ সময়ে কেউ এভাবে হাসতে পারে?’ মনে মনে কিন্তু অন্য কথা চলছে। এই অদ্ভুত আলো-আধাঁরি পরিবেশ, তার থেকেও অদ্ভুত এই মেয়েটিকে এখন আর তত অসহ্য লাগছে না। আশ্চর্যজনকভাবে এই যে মেয়েটিকে সঙ্গ দিয়ে পথ দেখিয়ে নেবার কথাটা, সেটা ভাবতে গিয়ে তার ভালোই লাগছে। এ তার কী হচ্ছে? এমনতো আজ সন্ধ্যায় হওয়ার কথা ছিল না?
চলবে
কেন এলে? পর্ব-২
কেন এলে? শেষ পর্ব
তৃষ্ণা হয়ে থাক কান্না-গভীর ঘুমে মাখা।