টপিকঃ আমি যেখানে থাকি : পর্ব ১ : অতিথি: ইলিয়াস ভাই
পূর্বকথা: "আমি যেখানে থাকি" একটি নতুন সিরিজ যেখানে আমি একেক পর্বে একেকজন অতিথি যেখানে/যে এলাকায় থাকেন, সেই জায়গাটি সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব। অতিথিকে অনেক ছোট-খাটো প্রশ্ন করে তার জায়গা সম্পর্কে তথ্য বের করে আনা হয়, কিন্তু সেসব প্রশ্ন পুরো লেখাটি সাজানোর সুবিধার্থে এখানে দেয়া হচ্ছে না, শুধু কিছু মূল প্রশ্ন এখানে দেয়া হবে। আজকেরটা পর্ব ১ : অতিথি আমাদের সবার প্রিয় ইলিয়াস ভাই ।
আজকের পর্ব কথা:
ইলিয়াস ভাই আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। নেটে আসলেই প্রতিদিন উনার সাথে কথা না বললে আমার ভাল লাগে না। আজকে অনেক সময় (প্রায় ২ ঘন্টা) নিয়ে আমরা দূজনে ইন্টারভিউটুকু চ্যাটে শেষ করলাম। প্রথম পর্ব, তাই ঠিক কিভাবে প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর চাচ্ছি, তা ঠিক করতে বেশ বেগ পেতে হলো। ব্যাপারটা যে এত কঠিন হবে তা আগে বুঝি নাই। তবে ইলিয়াস ভাই ধৈর্য্য ধরে আমার একের পর এক ছোট-খাটো অনেক প্রশ্ন ও ইন্সট্রাকশন শুনেছেন ও মেনেছেন, সেজন্য উনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনি যেখানে থাকেন, সেটি সম্পর্কে কিছু কথা........
-আমি মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানাধীন ফুরশাইল নামক ছোট্ট একটা গ্রামে বাস করি। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী তালতলা বাজারে। দিনের পুরোটা সময় আমি বাজারেই কাটাই। এখানকার মানুষ জন, বিশেষ করে নিজ গ্রামের বেশীরভাগ দরিদ্র। ফুরশাইল গ্রামটি ইছামতী নদীর একটি শাখার তীরে, যে ইছামতীকে এখন নদী না বলে খাল বলতে হয়। আর তালতলা বাজারটি ধলেশ্বরীর শাখায়। এক সময়ে পুরো বিক্রমপুরের প্রবেশদ্বার ছিল এই তালতলা বাজারের লঞ্চঘাট, যা কালের বির্বতনে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
তালতলা বাজারের আধা কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিন দিক দিয়ে চলে গেছে শ্রীনগর টু মুন্সীগঞ্জ রোড। বিভিন্ন জায়গাতে রাস্তা দোকানপাট হওয়াতে এবং তালতলা বাজারের সাথে সরাসরি কোন স্থল / সড়ক বা জেলা সদর ও রাজধানী ঢাকার সাথে কোন সড়ক যোগাযোগ নেই বলে তালতলা বাজার দিন দিন মৃত্যুপুরীতে রুপ নিচ্ছে যা বাজারের ব্যবসায়ীদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার অন্যতম কারণ, যদিও ঢাকা জিরো পয়েন্ট হতে মাত্র ৩২ কিলোমিটারের দূরত্ব।
আপনার এলাকায় যেভাবে যেতে হবে ( ঢাকা থেকে) .........
-ঢাকা গুলিস্তান হতে বাস পাওয়া যায়, রুটের নাম : ঢাকা টু টঙ্গীবাড়ি। পথে মালখানগর চৌরাস্তা নেমে রিকশাযোগে তালতলা বাজার, মালখানগর চৌরাস্তা হতে বাজারের দূরত্ব এক কিলোমিটার।
সেখানে যাদের সাথে আপনার বেশির ভাগ সময় কাটে......
-যাদের সাথে আমার দিন কাটে, এদের মধ্যে বেশীর ভাগই আশেপাশের দোকানের মানুষ, তারা খুবই সহযোগী মনোভাবাপন্ন। আর অবসর সময়ে আমরা যারা আড্ডা দেই, সবাই বেশ হাসিখুশী ভাবেই আড্ডা দেই। এমনিতেই বিক্রমপুরের মানুষ অনেক ভাল, নিজের এলাকা বলে বলছি না। হামিদ ভাই একে আমার বন্ধু- বড়ভাই সবই বলা যায়, খুব উদার মনের মানুষ, বিপদে আপদে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। আরেকজন হলেন শহীদ ভাই, তিনি যদিও আমার বয়সে ছোট, তিনিও আমাকে আপন ভাইয়ের মতই ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন।
এলাকায় আপনার সারাটা দিন যেভাবে কাটে ......
-সকাল সাতটায় বাসা হতে বের হই। বেরিয়ে আসি মসজিদে। গত কয়েকবছর যাবত আমার গ্রামের মসজিদের নির্মাণ কাজ চলছে, যা এখনও চলতেছে। মসজিদের নির্মাণ কাজ তদারকি করি সকাল ৮টা পর্যন্ত। এখানে বলা প্রয়োজন: এই মসজিদের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক আমি বিগত ২০০৬ সাল হতে। মসজিদে আমরা একটি মক্তব পরিচালনা করি যা এলাকার বাচ্চারা ফজরের পর হতে সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত লেখা পড়া করে। আর আমাদের এ মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক শিক্ষাকেন্দ্র আছে যেসব বাচ্চারা স্কুলে পড়তে পারে না তাদের জন্য। সেটার ক্লাশ হয় বেলা ২টা হতে বেলা ৪টা।
যে রাস্তা দিয়ে মসজিদে যাই সে রাস্তার অবস্থা করুণ। মসজিদ থেকে তারপর বাজারে এসে নাস্তা করি। আমাদের এ বাজার ফজর নামাজের আগ হতে শুরু হয়, তার কারণ বাজারটির সাথে ইছামতি ও ধলেশ্বরীর শাখা নদী থাকার কারণে জেলেরা ভোরবেলায় মাছ নিয়ে আসে পাইকারদের বিক্রির জন্য। আমি আসি সকাল ৮টার পরে, সকাল ৮টা হতে রাত ৮টা একটানা দোকান খোলা থাকে। দোকান খুলে পিসি অন করে প্রথমেই মহা গ্রন্থ আল-কোরআন হতে যে কোন একটি সূরার তেলওয়াত শুনি। নেট কানেক্টেড হওয়ার পরে নিজের ব্লগসাইটা ভিজিট করি। কোন টপিক করার থাকলে তো পোস্ট করি। আমার ফোরামিং এবং ব্যবসা একই সাথে চলতে থাকে।এভাবে চলতে থাকে রাত ৮টা পর্যন্ত। আবার যাবার পথে মসজিদ হয়ে সারাদিনের কাজের হিসেব নিয়ে তারপর বাসায় যাই।
এলাকায় প্রথম যখন এসেছিলেন তখনকার সময়ের সাথে এখনকার পার্থক্য .......
- আসলে আমি দীর্ঘদিন ঢাকায় ছিলাম। ঢাকায় যাওয়ার আগের এলাকার সাথে ঢাকা হতে ফিরে আসার এলাকার অনেক তফাৎ। তখনকার মানুষজন ছিল অনেক সহজ সরল, যদিও তারা তেমন শিক্ষিত ছিল না। কিন্ত এখন শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, সাথে বেড়েছে হীনমন্যতা, বেড়েছে প্রতারণা -এই সব বিষয়গুলা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার : আমি ঢাকা হতে ফিরে আসার পরে একদিন বাজারে চায়ের দোকানে বসে আছি। আমার এক চাচাতো ভাইয়ের ছেলে এসে বলতেছে: ভাই এখন সময় কত বলতে পারেন? এরকম অপরিচিত হয়ে গেছিলাম নিজ এলাকায়।
এলাকায় ঘটা বিশেষ কোন মজার ঘটনা...........
-গত কয়েকদিন আগে আমার এলাকার এক মুরুব্বী আসল আমার দোকানে। এসেই উনি রাগান্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন : "ইলিয়াস, তুমি নাকি ইন্টারনেটা চালাও?" আমি বললাম: "জ্বী, চালাইতো।" তা শুনে তিনি যেমন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন: "মিয়া তুমি মসজিদের সেক্রেটারী হয়ে ইন্টারনেট ইউজ কর, তোমারতো এটা মানায় না।" আমি উনাকে আমার পাশের চেয়ারে এক রকম জোর করেই বসালাম আর বললাম: "আচ্ছা দাদা, আমি ইন্টারনেট চালাই, এর সাথে মসজিদের সেক্রেটারীর কি সম্পর্ক- আমিতো বুঝলাম না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?" উনি বললেন: "মিয়া, আল্লাহর ঘর মসজিদের রক্ষক হয়ে তুমি যদি এসব খারাপ জিনিস দেখ, তাহলে সমাজের ভাল করবে কি করে?"
আমি কি উত্তর দিব "থ' মেরে কতক্ষন বসে রইলাম। তারপর উনাকে বললাম: "দাদা, ইন্টারনেট খারাপ সেটা আপনাকে কে বলল?" উনি উত্তর দিলেন: "আমাকে আর তুমি ভুল বুঝাইও না। এই ইন্টারনেট অবশ্যি খারাপ, পুলাপান ইন্টারনেট থেইকা আজে বাজে ছবি ডাউনলোড কইরা মোবাইলে ভরে - সেটা আমি জানি।" আমি বললাম: "ইন্টারনেটে যেমন খারাপ জিনিষ আছে তেমনি ভাল জিনিসও আছে।এই যে দেখেন আমার কম্পিউটারে এখন ইন্টারনেট চালু, আপনি খারাপ কিছু দেখছেন?" বললো: "না তো, দেখছিনা।"
তারপর উনাকে গুগল সার্চবার দেখালাম এবং তাকে দেখিয়ে লিখলাম "নামাজ" আর সার্চ দিলাম। রেজাল্টতো বুঝতেই পারছ। অবশেষে উনাকে বুঝাতে পারলাম যে: "ইন্টারনেট এমন একটা জিনিস, আপনি যদি বেহেশতের রাস্তা খুজতে চান, তা পাবেন, তেমনি দোজখের রাস্তা খুজতে চাইলে সেটাও পাবেন। আপনাকে দেখাব দোজখের রাস্তা ??"
এলাকার যে দিকগুলো সবচে বেশি ভাল লাগে.........
- ২০০১ সাল পর্যন্ত আমার গ্রামে কোন মসজিদ ছিল না, ছিলনা তেমন নামাজী। মাশাআল্লাহ গ্রামের সবার সহযোগিতায় আমার গ্রামে আজ বড় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে যেভাবে এলাকার গরীব লোকজন এগিয়ে আসছে -এটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। আরও একটা বিষয়: মানুষ এখন লেখাপড়ার কদর বুঝতে শিখেছে।
যে দিকগুলো একদমই ভাল লাগে না..........
-ভিলেজ পলিটিক্স - আমার দুচোখের বিষ। কিছু লোকজন আছে কোন সুযোগ পেলেই হলো একজনকে পরামর্শ দিয়ে আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখবে। যেটা এলাকার দু'চারজন মুরুব্বী মিটমাট করতে পারবে, সেটা নিয়ে আদালতে যাওয়া। এমন বিষয়গুলা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে।
বর্তমান এলাকার উন্নতিতে কোন মতামত বা পরামর্শ.......
-তালতলা বাজারে পুর্বপাশে বিশাল একটা চর এলাকা আছে। এ চর এলাকাকে যদি একটা ব্রীজ করে তালতলা বাজারের সাথে সংযোগ করা যায়, তবে চর এলাকার মানুষদের জন্য তালতলা বাজারে যেমন যাতায়াত সহজ হয়, তেমনি তালতলা বাজারের পাশেই মালখানগর হাইস্কুল এন্ড কলেজে আছে, সেখানে আসতে ছাত্র/ছাত্রীদের অনেক কষ্ট কমবে। তাছাড়া মৃতপ্রায় তালতলা বাজার আবার হয়তো পুর্ববস্থায় ফিরে যাবে। আমার এখানে স্কুল কলেজ সবই আছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকার কারণে আমরা মার খেয়ে যাচ্ছি।
ইলিয়াস ভাইয়ের তোলা তার এলাকার ছবিগুলো........
বাজারের একাংশ
দোকানের সামনের রাস্তা
মসজিদ
মসজিরে একাংশ
মসজিদের সম্মুখভাগ
মক্তব
যে নদীতে এক সময় দোতলা লঞ্চ চলতো সেখানে এখন ইঞ্জিন নোকাই সম্বল।
মৃত প্রায় ধলেশ্বরী নদী
বিক্রমপুরের প্রবেশদ্বার ঐতিহ্যবাহী তালতলা লঞ্চঘাট
কেমন লাগল আজকের পর্বটি তা এখানে অবশ্যই জানাবেন।আপনাদের মতামতটুকু এই সিরিজের এগিয়ে চলায় অনেক অবদান রাখবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।