টপিকঃ পাথর
ভাইজান, পাথরের মাঝে লেখালেখি করে কোথায় বলতে পারেন? খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। যাকে জিজ্ঞাসা করেছি সে মনে হয় তেমন আগ্রহী না বরং প্রশ্ন শুনে কিঞ্চিত বিরক্ত। পান খাচ্ছেন, পিচ করে পানের পিক ফেলে ভ্রু কুচকিয়ে বললেন- “জানি না”।
কেউ যে এতো বিশ্রী ভাবে পানের পিক ফেলতে পারে তা আমার জানা ছিলে না। লোকটার নাক মুখের বিরত্তির ভাব দেখে দ্বিতীয় বার আর কিছু জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছে হল না। মানুষ জন দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে? কেউ কারও সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে চায় না। সবাই বিরক্তির ভাব প্রকাশ করে। এটাই এখন স্বাভাবিক। কাউকে যদি রাস্তায় দাড় করিয়ে কঠিন ধমক দেওয়া হয় তাহলে মানুষ মনে করে এটাই স্বাভাবিক আর যদি হাসি হাসি মুখে ভালো কথা বলা হয়; তাহলে ভ্রু কুচকিয়ে ভাবতে থাকে- “লোকটার মতলবটা কি”? দিনকে দিন মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। আফসোস; বিরাট আফসোস।
পাথুরে লেখালেখি করবার লোক দরকার। শুধু দরকার না, ভীষণ দরকার। মামার বাড়ির প্রবেশ পথে একটা পাথুরে খোদাই করে লেখা থাকবে- “কুকুর হইতে সাবধান”।
মামার বাড়ি তিনটা কুকুর আছে। একটা দেশি, দুইটা এলসেশিয়ান। এলসেশিয়ান কুকুর দুইটা সারাদিন দেশি কুকুরটার পিছে লেগেই থাকে। দেশি কুকুরটাকে দেখলেই গড় গড় করা শুরু করে দেয়। সংখ্যায় এলসেশিয়ান বেশি তাই দেশিটা একা দুটোর সাথে পেরে উঠতে পারে না। দেশিটা একবার ঘেউ বললে এলসেশিয়ান কুকুর দুইটা দুই পাশ থেকে ছয় দু’গুনে বারো বার ঘেউ ঘেউ করে। নিরুপায় হয়ে কুকুরটা লেজ গুটিয়ে চলে যায়। সারাদিনই গেটের সামনে বসে থাকে। এই একাকীত্বের জন্যই মনে হয় মাথায় সামান্য প্রবলেম দেখা দিয়েছে। কিছুদিন আগে কামড়ে দিয়েছে গেটের দারোয়ানকে। দারোয়ানের তো জীবন যায় যায় অবস্থা। হাসপাতালে নেওয়া হল। কুকুরটা কামড় দিয়ে পায়ের মাংস তুলে নিয়েছে। বিরাট রক্তারক্তি অবস্থা।
মামা সেদিনের পরের থেকেই আমাকে বলে দিয়েছে, পাথরে বড় বড় করে লিখে নিয়ে আসতে “কুকুর হইতে সাবধান”। আমি বলেছিলাম – “মামা রং দিয়ে লিখে নিয়ে আসি, তারপর সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলাম বাড়ির সামনে”।
মামার মনে হয় আমার কথা পছন্দ হয় নাই। কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন- “ তিনদিনের মধ্যে লিখে নিয়ে আসবি। আমার বাড়ি কি গ্রামের স্কুল ঘর? দরজার সামনে বাঁশ পুতে সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখবো? পাথরের উপর লিখে নিয়ে আসবি”। আমি নীরবে মাথা নাড়লাম। মামার বাড়ি গ্রামের দো-চালা স্কুল ঘর না। বিরাট বাড়ি।
তিনদিনের মাঝে তৈরি করবার কথা থাকলেও তিনদিনে তা তৈরি করা হয় নাই। মামা বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলেন কিন্তু কুকুরটা আবারো নতুন দারোয়ানের পা কামড়ে ধরেছে। মামা কঠিন করে বলেছেন- “পাথর বাদে তোর আজকে থেকে ঘরে প্রবেশ করা নিষেধ”।
হায়রে ..... ভাগিনার চেয়ে মামার কাছে পাথরটাই বড় হল। আমি সকাল থেকে পাথর লেখক খুঁজে বেড়াচ্ছি। এখন সন্ধ্যা হয় হয়।
অবশেষে পাওয়া গেলো। একটা গলির ভিতর কুড়ে ঘর। পাথরের মাঝে খোদাই করবার শব্দ হচ্ছে খুট খুট। এখন রাত সারে দশটা। এখনো কাজ করে যাচ্ছে। ঘরের দরজা খোলা। কোন কলিং বেলও নেই। কুড়ে ঘরের এই একটা প্রবলেম। কলিং বেল থাকে না। আমি গলা খাঁকারি দিলাম। কেউ কোন সারা শব্দ করলো না। দরজা খোলা, প্রবেশ করবো কি করব না সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
একজন বৃদ্ধ খুব মনোযোগ সহকারে একটা পাথরের উপর কাজ করে যাচ্ছে। আমি তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। আমার পায়ের শব্দ শুনে তিনি একবার ঘুরে তাকালেন এবং কোন প্রকার আগ্রহ প্রকাশ না করে আবারো কাজে মন দিলেন।
“চাচা এখানে কি পাথরের মাঝে লেখা হয়?”
লোকটা কাজ করতে করতে বলল- “হু”।
“লিখতে কতো টাকা খরচ হয়?”
“লেখার সাইজ বুঝে। বড় সাইজের বড় টাকা ছোট সাইজের ছোট টাকা। আবার ছোট সাইজও বড় টাকা নিয়ে থাকি। পাথরের মানের উপর নির্ভর করে। কম দামী পাথরে কম টাকা, বেশি দামি পাথরে বেশি টাকা। কম দামী পাথরে কাজ করে আরাম, বেশি দামীতে খোদাই করা কষ্ট। বেজায় শক্ত। কমদামী পাথর আবার পটাশ করে ভেঙ্গে যায়।“
আমি বললাম- “ও, তা এতো রাতে কাজ করছেন? কাজের চাপ কি বেশি?”
লোকটি হতাশ কণ্ঠে বলল- “না, কাজের কোন চাপই নাই। হাতে কোন কাজ নাই তাই বাতিল পাথরে লেখালেখি করছি। হাতটা চালু রাখতে হবে তো। দেখেন, লেখা শেষ। বড়ই সুন্দয্য না।“
আমি লেখাটি পড়লাম। সুন্দয্যের কিছুই খুঁজে পেলাম না। পাথরের উপর বড় বড় করে লেখা:
নাম: ইলিয়াস আহমেদ।
স্মৃতির উদ্দেশ্যে
জন্ম: ১৮ জানুয়ারি ১৮৫০
মৃত্যু: ২০ আগস্ট ১৯১০
তিনি আকস্মিক ভাবে মৃত্যু বরণ করেন।
লেখাটি পরে কিছুক্ষণ থ হয়ে থাকলাম। শির শির করে দেহের মধ্য দিয়ে ঠান্ডা একটা শিহরন বয়ে গেল। আমি কোন মতে জিজ্ঞাসা করলাম- “এই নামটা কোথায় পেয়েছেন আপনি?”
“কোথাও না, লিখতে ইচ্ছে হল তাই লিখলাম। হাতে কোন কাজ নেই তো। বসে থাকলেই খুট খাট করতে মন চায়।“
“আপনি জানেন এটা আমার নাম?”
লোকটি একটু অবাক হয়ে বলল- “হইতে পারে, যেইটা মনে এসেছে সেটাই লিখে দিয়েছি। দুনিয়াতে তো কতই নাম আছে, মিলে গিয়েছে হয়তো।“
আমি আমতা আমতা করে বললাম- “কিন্তু জন্ম তারিখ, জন্ম তারিখটাও তো মিলে গিয়েছে। এই দিনেই আমি জন্মগ্রহন করেছি।“
আমার কথা শুনে লোকটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি তাকিয়ে আছি পাথরটার দিকে।
“নেন বিড়ি খান। বিড়ির মাঝে দুইটা টান দেন তারপর আমার লগে খানা দানা করেন। একলা মানুষ। গরিবি খানা।“ বলেই লোকটা মহা-উৎসাহে বিড়ি টানতে থাকলেন।
আমি উঠে দাঁড়ালাম- “না চাচা বাসায় চলে যাই। রাত এখনো বেশি হয় নাই।“
লোকটা রহস্যময় একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল- “যাইতে চাইলে যাবা কিন্তু বলছিলাম কি....আজকে ১৯ আগস্ট। বলাতো যায় না রাস্তা ঘাটে অপমৃত্যু হতে পারে। প্রকৃতি কাকতালীয় ভাবে দুইটা মিলিয়ে দিয়েছে। জন্ম আর নাম, বলাতো যায় না মৃত্যুটাও মিলিয়ে দিতে পারে। তাই বলছি কি আমার সাথে খাওয়া দাওয়া করে থেকে যাও আজকের রাতটা।“ বলেই লোকটা অদ্ভুত ভাবে হাসতে থাকলেন। তার হাসি শূন্য বাড়ির চারপাশের দেয়ালে প্রতিধ্বনি হতে থাকলো। আমি বাক-শূন্য হয়ে গেলাম। এখন রাত ১১টা আর মাত্র ১ ঘণ্টা। তারপরই নতুন একটা দিনের সূচনা হবে। নতুন দিন, নতুন তারিখ, ২০ আগস্ট। আমি কি রাস্তায় বের হয়ে যাব? সাহসে কুলচ্ছে না আবার যে এখানে থেকে যাবো তাও মন চাচ্ছে না। লোকটাকে কেমন অদ্ভুত , ভৌতিক মনে হচ্ছে। বারবার লোকটার হাসি কানের মাঝে বাজছে। আমি দুই হাতে কান চেপে ধরলাম। চিৎকার করে বললাম- “ইয়া মাবুদ রক্ষা করো”।