টপিকঃ বিরিশিরিঃ দ্য ল্যান্ড অব ল্যান্ডস্কেপ
ছোটবেলায় আমি বেশ ভদ্র প্রজাতির ছেলে ছিলাম, বসে বসে সারাদিন গল্পের বই পড়তাম আর লেখকদের বর্ণনার সুন্দর-সুন্দর জায়গাগুলো ভেবে নিতাম চোখ বন্ধ করে। কোনদিন ভাবতেও পারিনি এধরণের জায়গা গল্পের বইএর পাতা আর ওয়াল পেপার ছাড়াও থাকতে পারে … এতো বড় ভুলটা হয়ত কখনো ভাংতো-ও না যদি না আমি বিরিশিরি ঘুরে আসতাম। বিরিশিরি এক কথায় – “মায়রে বাআপ!” (Awesome একটা পারিভাষিক শব্দ যেটার এক্স্যাক্ট বাংলা করলে দাঁড়ায় – “মায়রে বাআপ”, এটি একটি বিশুদ্ধ এক্সক্ল্যামাটরি ওয়ার্ড )। ট্যুর এ আমাদের যাওয়ার কথা ছিল কমপক্ষে চার জনের, কিন্তু এক পিস বইন পল্টি মারায় আমরা মাত্র দুই জন দোকলাই গিয়েছিলুম (পল্টি মানে About Turn – অ্যাগেইন এটা একটা ‘নো-অফেন্স’ ওয়ার্ড)
চীনা মাটির পাহার আর লেক! by Risalat1, on Flickr
কয়েকদিন আগে ঘুরে আসলাম বিরিশিরি থেকে, জায়গাটা পড়েছে নেত্রকোনা জেলায় – ভারতীয় বর্ডারের কাছাকাছি। বেশ ঝক্কি ঝামেলা পাড়ি দিয়ে আমরা যখন বিরিশিরি পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত ৮ টা বাজে, ঘড়িতে সন্ধ্যা হলেও চারদিকে মধ্যরাতের আমেজ ছিল – শুনশান – দু-একটা জোনাকির আলো ছাড়া তেমন কিছু চোখেও পড়ছিল না, আমাদের দুই জনের কাছে দুইটা অকেজো এয়ারটেল ছাড়া আর কোন সিম না থাকায় বেরসিক সেলফোন গুলোও বেশ ভদ্র হয়েছিল (বিরিশিরিতে এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক নাই)। প্রায় দেড় ঘন্টার পথ পুরোটাই আমরা রিক্সা দিয়ে আসলাম। আসার পথে রিক্সা-আলার সাথে বেশ খানিক রসালো রাজনৈতিক আলাপ চলল, সামনে তাদের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন … কে বেশি ভাল জিজ্ঞেস করায় উত্তর আসল – “আমাদের এদিক সবাই ভাল।”
আমাদের থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছিল YWCA Training and Resource Centre এ। জায়গাটা ছিল অসাধারণ! ঢাকা থেকে এতো দূরে, অজো পারাগাঁয়ের মধ্যে আমার ঘোরতর সন্দেহ ছিল আমরা জিপি ইন্টারনের পাব কিনা সেটা নিয়ে – কিন্তু YWCA তে যেয়ে আমরা পেলাম এসি রুম! যদিও কারেন্ট খুব কম সময়ই থাকে, তাও এসি বলে কথা
YWCA রেস্টহাউস by Risalat1, on Flickr
YWCA র গেট এর দুধারে ছিল বেশ বড় সড় দুইটা গাছ –, আর ঘোলা একটা আলো একটা অদ্ভুত ক্যানোপি সৃষ্টি করে রেখেছিল যার জন্যে দেখলেই মনে হয় গাছ থেকে পেত্নির দল গায়ে পেচ্ছাব করে দিবে! ছিমছাম, নিরিবিলি অসাধারণ একটা রেস্টহাউস। ও, বলে রাখা ভাল, রেস্ট হাউসে আমরাই ছিলাম দুই মাত্র অতিথি!
Gate of YWCA by Risalat1, on Flickr
রাতে আমরা খেয়েছিলাম সঞ্জয়ের হোটেলে, যার হোটেল তার নাম মিখায়েল দেবনাথ। ব্যাটা হিন্দু না খ্রিস্টান – সেটা নিয়ে আজিরা তর্ক চলছিল; কিন্তু ১০০ গজের মধ্যে মসজিদ, মন্দির আর গির্জার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে আমরা অসাম্প্রদায়িকতা আর আন্তরিকতার এক অপূর্ব উপস্থিতি অনুভব করছিলাম। খেয়ে দেয়ে আমরা আবার YWCA তে ফিরে আসলাম, বিদ্যুৎ ছিল না জন্যে ভূতের গল্প আর ভৌতিক সাব্জেক্ট নিয়ে আলাপ করার আইডিয়া আসল আমার উর্বর মস্তিষ্কে, কিছুক্ষণ পর দুই জন ভয় পেয়ে চুপ মেরে গেলাম। ভয় পেয়ে আইক্কা গেল মোমবাতি জ্বালাতে, মোম ৩-৪ টা অ্যাটেম্পট মারার পরেও জ্বলল না! ম্যাচের কাঠিও গেল শেষ হয়ে! পুরাই হরর অবস্থা! কিছুক্ষণ পর অবশ্য বিদ্যুৎ এসে পড়েছিল …
পরের দিন সকাল আটটা বাজে ঘুম থেকে উঠলাম, উঠতেই ব্রেকিং নিউজ আসল - আমাদের জন্যে রিক্সা ঠিক করা হয়েছে – সব কিছু ঘুড়িয়ে দেখানোর জন্যে। রিক্সা আলার নাম ছিল মোহাম্মাদ কবির – ছেলেটি মার্কেটিং এ বেশ পারদর্শী; বুদ্ধি করে সে তার সব ঢাকার মামাদের ফোন নম্বর দিয়ে দেয় আর পরেরবার তাদের কোন ভাই-বেরাদার আসলে তাদের কাছে যেন মোহাম্মাদ কবির কে রিকমেন্ড করা হয় সে আবদার সে আগে ভাগেই করে রাখে। তড়িঘড়ি করে একটা হোটেল থেকে খেয়ে শুরু হল আমাদের অ্যাডভেঞ্চার!
রাস্তা ঘাটের নাকি ব্যাপক উন্নতি হয়েছে এদিককার, কয়েকদিন আগেই মমতাজ আপা এখানে একটি ভিজিট মেরে গেছেন। নমুনা দেখলাম রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় ৬ ফুট ব্যাস আর ৪ ফুট গভীর বেশ সুন্দর একটা গর্ত দেখে, আর ছোট ছোট খানাখন্দের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। আধা ঘন্টার মধ্যে আমার পেছনটার অবস্থা “তথৈবচঃ”!
পুরা জার্নিটাই ছিল অসাধারণ টাইপের ভাল, দু’পাশের সৌন্দর্য আমার মত বেরসিক টাইপের আনরোমান্টিক ছোকড়াকেও রোমান্টিক-রোমান্টিক ভাব এনে দিচ্ছিলো। রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় গুলোয় নাম না জানা হরেক রঙের ফুল, বৈচী আর কিছু অজানা প্রজাতির ছোট ফল দেখা যাচ্ছিল। একটু পরপর দেখা যাচ্ছিল বাতাবি লেবু, লেবু, ঢেঁড়স, আম আরও অনেক কিছুর গাছ। রাস্তার দুপাশের বড় বড় গাছগুলো হেলে পড়ে জায়গায় জায়গায় বেশ অদ্ভুত ছায়া তৈরি করে রেখেছিল। আমি দেখছিলাম আর রোমান্টিক ফল গুলোর নাম আওড়াচ্ছিলাম, পাশ থেকে আইক্কা দুনিয়ার যত সব চরম চরম আনম্যাচিং শব্দ বলে বলে আমাকে এক মহা ফাঁপড়ে ফালায় দিচ্ছিলো। এতো কিছু থাকতে ওর চোখে পড়ে খালি “কাঁঠাল” – যেটা কিনা আমার মতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আনরোমান্টিক টাইপ ফল, এরপর এ ব্যাটা বাতাবি লেবুকে বলে কিনা “জাম্বুরা”! এরপর ওকে বোঝালাম – “এরকম সময় কখোনো “জাম্বুরা” কে “জাম্বুরা” বলবি না; বলবি “বাতাবি নেবু” ”
আইক্কা আমাকে কিছুক্ষণ ‘বাতাবি নেবু’ দেখালো, এরপর শুরু হল আরেক ঝামেলা! যেটাই দেখে সেটার বৈজ্ঞানিক নাম কয়! এহহে!!! আমি কই যাই??? ঢেঁড়স দেখে বলে - Abelmoscus esculentus , জবা ফুল দেখলে কয় - Hibicus rosasinensis , কাঁঠাল দেখলে কয় - Artocarpus heterophylus , বেগুন দেখে - Solanam melongina। তখন আমার মইরা যাইতে মুঞ্চায়! আইক্কা ছেলেটি বড্ড ভাল, যদিও সে মাঝে মাঝে বৈজ্ঞানিক নাম বলে আমাকে বিব্রত করে … তার মনের দুঃখ একটাই – ওর নামটা বড্ড কমন “আকিব”। সব যায়গায় সে গড়ে ৩ জন আকিব পেয়ে থাকে, এ জন্যে এখন নামের বানান লিখে থাকে “Aquib” কিন্তু ব্র্যাকেটে ঠিকই “আকিব” লিখে দেয়। আমি ওরে বুদ্ধি দিয়েছিলাম আনকমন কোন নাম নিক নিতে – লাইক “বাঙ্গী” বা “গাব”। বেশ আনকমন আবার ন্যাচারাল একইসাথে খানিকটা রসালো একটা ভাব আছে … যাই হোক … আমরা কথা বলছিলাম বিরিশিরি নিয়ে …
Romantic Buffalo Couple by Risalat1, on Flickr
খুব সুন্দর সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ পাশে রেখে আর মাঝখানে একটা নদী পার হয়ে (রিকশা টাও নৌকার উপ্রে তোলা হয়েছিল) আমরা প্রধান আকর্ষণ – ‘নীল পানি’ র কাছাকাছি গেলাম। যাওয়ার পথে নাবালক গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগীর সাথে রোমান্টিক পিক তুল্লাম। এরপর ৬০-৮০ ফুট একটা ছোট পাহাড় (আইক্কার হিসাবে ৫০০-৬০০ ফুট) চার হাত-পায়ে পার হয়ে, ৩০০ গজ সামনে যা পেলাম – সেটা আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর স্পট! জায়গাটা আসলে চীনা মাটির পাহাড় – চারদিকে চীনা মাটির পাহাড় আর মাঝখানে ঝকঝকে নীল পানি (কিছুটা যেন সবুজাভ ছিল)। ও, বলতে ত ভুলেই গেসিলাম – মাঝখানের ৩০০ গজের মধ্যে এক জোড়া মহিষ দম্পতি ছিল।
এবার থ্রিলার – পানি দেখতেই আমার শখ হল নামব। সুন্দর পকেটে মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়েই দেখতে গেলাম ঠিক কতখানি গভীর পানি। প্রথম পা দিলাম – হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল, দ্বিতীয় পা দিলাম … শুধু একটা আওয়াজ শোনা গেল – “ভুসসসসসসসসস …”
- দোস দোস আমারে টাইন্যা তোল …
- কেন কি হইসে?
- আরে ঠাঁই পাই না নিচে, কিচ্ছু নাই! (পাহাড়ি দেয়াল এর পাথর ধরে কেমনে যেন ঝুলে ছিলাম)
এরপর আইক্কা আমারে টেনেটুনে ওইখান থেকে তুলে ফেলল। পরে শুনলাম, ওইখানকার গভীরতা নাকি ১৫০ ফুট! আর আমি যখন ডুবে গেসিলাম – এক কিলোমিটার এর মধ্যে কোন মানুষ ছিল কিনা সন্দেহ। এদিকে আইক্কার আর আমি কেউ সাঁতার জানি না; আরেট্টু হলেই একটা মার্ডার কেস হয়ে গেসিলো আর কি …
পানি থেকে ওঠার পরঃ
- তোর মোবাইল, মানিব্যাগ কিছু ভেজেনি?
- মনে হয় না, হিউমিডিটি একটু বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রোপারলি ভিজতে পারেনি।
মোবাইলটা তখনো চলছিল, একটু পর পুউউউত করে অফ হয়ে গেল। এরপর রাতে রেস্টহাউসে মোবাইলে ঝাকি দিলে বিভিন্ন ফুটো দিয়ে পানি বের হচ্ছিল ।
♪ Country Road Take me Home ♫ by Risalat1, on Flickr
এরপর ঐখান থেকে আমরা গেলাম গির্জা আর শেষে গেলাম বিডিআর ক্যাম্প দেখতে, মোহাম্মাদ কবির বেশ ভাল গাইড, তার কাছ থেকে আমরা বিএসএফ-এর বজ্জাতির কাহিনী শুনলাম, কীভাবে বাঙ্গালিদের নিয়ে যেয়ে মারধর করে আর মাটি কাটায় – এরপর কেউ পালায় আসতে পারলে বাঁচে নাহলে হয়ত মারা যায়। হাবিজাবি অনেক প্যাচাল পারতে পারতে আবার আমরা রওনা দিলাম, বেলা চারটার দিকে আবার সঞ্জয়ের হোটেলে ভাত খেয়ে YWCA তে রওনা দিবো এইসময় ব্যাডেস্ট নিউজ টা পেলাম – কোত্থেকে কোন ডিসি আসবে, তার জন্যে আমাদের এসি রুমটা তাকে ছেড়ে দিতে হবে। মনের দুঃখে রুম ছেড়ে আমরা ২০১ নাম্বার রুমে ট্রান্সফার হলাম L - আইক্কার প্রিয় ফল কাঁঠাল! এই দুঃখে আমরা ক্যাশ ১১০ টাকা দিয়ে দুইটা হিউজ সাইজ কাঁঠাল-ও কিনলাম। যেটা কিনা আমরা মোহাম্মাদ কবিরের বাসায় পাঠায় দিলাম পরের দিন বাসে তুলে দেবার জন্যে।
ডিসি আসলো রাতে, পুরা গুষ্টি বেঁধে – পেত্নীর মত ডিসির বউ, ছেলেটি আসলে ছেলে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের গবেষণা অসমাপ্ত আছে, আর কন্যা সন্তানটিকে যথেষ্ট ঘষামাজা করার পরও সে সহজে দৃষ্টিপাচ্য ছিল না! আশাহত হয়ে, ভগ্ন হৃদয়ে আমরা ঘুমাতে গেলাম, কিন্তু ঘুম আসে না, গপ্পো করলাম, ছাদে হাঁটলাম – অনেক্ষণ পর ঘুমায় গেলাম। ডিসি আশায় সেদিন সারারাত জেনারেটর চলেছিল – এটাই ডিসির কীর্তি। সারারাত মোবাইল আর মানিব্যাগ শুকানো হল।
পরের দিন সকালে নাস্তা করে আবার মোহাম্মাদ কবিরের রিক্সায় করে বাসে উঠলাম, মোহাম্মাদ কবির আমাদের সাথে নদী পার হয়ে খুব যত্ন সহকারে কাঁঠালসহ আমাদের বিদায় জানালো।
বিরিশিরি তে ভাল কোন বাস সার্ভিস নাই, আমরা যেটায় যাওয়া-আসা করেছিলাম সেটার নাম ‘এক্সক্লুসিভ সার্ভিস’ (লিটারেলি এক্সক্লুসিভ ছিল )। পনের মিনিট পর পর থেমে থেমে যাত্রী তুলে বাসটা পৌনে একটার দিকে ময়মনসিংহ পৌঁছাল, এরপর ড্রাইভার বলল ২০ মিনিট বাস থামবে, বলে সে নেমে গেল। খাবার জন্যে ব্রেক ভেবে আমরা নেমে খুব সুন্দর খেয়ে দেয়ে এসে দেখি বাস গায়েব! আমাদের কাঁঠাল আর ব্যাগ নিয়ে আমাদের রেখেই বাস চলে গেছে!