টপিকঃ বাংলাদেশের মানুষের রক্তে অসহনীয় মাত্রায় বিষ
মানুষের শরীরে প্রতি গ্রাম রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত জৈব যৌগ সহনীয়। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের রক্তে তা বহুগুণ বেশি রয়েছে। মূলত দূষিত খাবার ও পানীয় গ্রহণের কারণেই এ বিষ শরীরে জমা হচ্ছে। এর ফলে দেখা দিচ্ছে নানা রকম জটিল ব্যাধি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সের শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ রওশন জামিরের গবেষণায় বিষয়টি ধরা পড়ে।
রওশন জামির দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণী-পেশার ১৪৪ জনের রক্তের নমুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ও সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করান। রওশন জামির জানান, তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনটি শিগগিরই একটি আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে ছাপা হবে।
রওশন জামিরের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মানুষের শরীরের প্রতি গ্রাম রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম বিষ সহনীয় হলেও পরীক্ষায় মিলেছে ৯.৭ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত, যা মানবদেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমে মারাত্মকভাবে বাধা সৃষ্টি করছে। আর এ বিষক্রিয়ার ফলে দেশে ক্রমেই বাড়ছে জটিল রোগীর সংখ্যা, কমছে রোগ প্রতিরোধ ও কর্মক্ষমতা।' প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, "মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল, ক্ষতিকারক রাসায়নিক বস্তুর মিশ্রণে তৈরি গুঁড়া মসলা, জুস ও পশুখাদ্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে গ্রহণ করছে মানুষ। প্রতিনিয়ত নিম্নমানের এসব খাবার মানুষের দেহে ঢুকে 'বিষক্রিয়া' আকারে জমাট বাঁধছে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নিলুফার নাহারের তত্ত্বাবধানে রওশন জামির এ বিষয়ে পিএইচডি করছেন।
ড. নিলুফার গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গবেষণার ফল আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের।'
রওশন জামির কালের কণ্ঠকে জানান, গবেষণার অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ১৪৪ ব্যক্তির রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ নমুনা ১২টি গ্রুপে ভাগ করা হয় এবং পরে তা বাংলাদেশ ও সুইডেনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত 'মেথড' অনুযায়ী পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা যায়, নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত দূষিত জৈব যৌগ, হেক্সক্লোরোবেনজিন, হেক্সক্লোরোবেনজিন ্পাইক্লোহেকজিন, ডিডিটি, ডিডিই, পলি ক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলসহ নানা দ্রব্যের মিশ্রণ রয়েছে। এসব উপাদানের প্রতিটিই মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
মানবদেহে মাত্রাতিরিক্ত বিষ : রওশন জামির রক্তের নমুনা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টকহোমে পরীক্ষা করান। দুই পরীক্ষায়ই রক্তে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর জৈব যৌগের উপস্থিতি পাওয়া যায়। স্টকহোমের পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শরীরে গড়ে ২.১, ছাত্রীদের শরীরে ১.৯, তুরাগ নদের জেলেদের শরীরে ৩.৯ এবং তাঁদের স্ত্রীদের শরীরে ৩.৭, ঢাকার পুরুষ গার্মেন্ট শ্রমিকদের শরীরে ৯.৭, নারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের শরীরে ২.৪, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শরীরে ২.৪, রাজধানীর পথশিশুদের শরীরে ৫.৯, তরুণীদের শরীরে ৪.২ ও প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে ৪.৭ মাইক্রোগ্রাম জৈব যৌগ পাওয়া যায়। তবে তুলনামূলক কম বিষ দেখা গেছে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর জেলেদের শরীরে_০.৪ এবং তাঁদের স্ত্রীদের শরীরে ১.৬ মাইক্রোগ্রাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ যৌগের ৯০ শতাংশই শরীরের চর্বিতে মিশে আছে।
রওশন জামির কালের কণ্ঠকে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক বস্তু মেশানো খাদ্যের মাধ্যমে এসব বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশ করে জমা হয়েছে। এর ফলে দেহের স্নায়ু, রক্ত ও পরিপাক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে জটিল রোগ। তিনি বলেন, মানুষের রক্তে মিশে যাওয়া এসব বিষক্রিয়া ২০ বছরেও নষ্ট হওয়ার নয়। আর গ্রামাঞ্চলের তুলনায় রাজধানী ঢাকার মানুষের শরীরের রক্তে বিষের পরিমাণ বেশি।
ড. নিলুফার বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের রক্তে ক্ষতিকর জৈব যৌগ বেশি এবং মূলত খাদ্যদ্রব্যে অত্যধিক কীটনাশকের উপস্থিতির ফলেই এটি হয়েছে। তিনি জনস্বার্থে ফসল ও শাকসবজিতে বালাইনাশক কম ব্যবহার এবং গোখাদ্যে রাসায়নিক বস্তু কম মেশানোর পরামর্শ দেন।
কীটনাশকের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার : জানা গেছে, উৎপাদন বাড়াতে প্রায় সব ধরনের ফসলেই মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করছেন কৃষকরা। ফলে প্রতিবছরই আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে কীটনাশকের আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) হিসাবে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে তিন কোটি ৮৫ লাখ টাকার কীটনাশক আমদানি হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকায়। এ ছাড়া ভারত ও চীন থেকে আরো প্রায় সমপরিমাণ টাকার কীটনাশক অবৈধপথে দেশে ঢোকে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পৃথক পরিসংখ্যানমতে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে শতকরা ৩২৮.৪ ভাগ। তাদের তথ্যমতে, ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বিষ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং সূত্রমতে, ষাটের দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২৩ প্রকারের কীটনাশক এক হাজার ৩৯০টি বাণিজ্যিক নামে দেশে বাজারজাতের জন্য নিবন্ধন পায়। এর মধ্যে ১১১টির নিবন্ধন নানা কারণে বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার (বিএডিসি) এক গবেষণা প্রতিবেদনমতে, দেশের ৭৭ শতাংশ কৃষক কৃষি উপকরণের (সার, বীজ, সেচ, কীটনাশক প্রভৃতি) সঠিক ব্যবহার জানেন না, ৪৭ শতাংশ কৃষকই প্রয়োজনের তুলনায় অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করেন এবং মাত্র ৪ শতাংশ কৃষক কীটনাশক ব্যবহার বা বালাই দমন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাঈদ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে ২৭টি প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কৃষককে নতুন প্রযুক্তি ও কীটনাশক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে বেশির ভাগ কৃষক কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার জানেন না।
গুঁড়া মসলায় রাসায়নিক : কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স টেকনোলজির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার গুঁড়া মসলা বিক্রি হয়। একটি চক্র অতিমুনাফার আশায় গুঁড়া (মরিচ, হলুদ ও মিঙ্ড) মসলায় মেশাচ্ছে নিম্নমানের কাঁচামালের সঙ্গে ইট, কাঠ, ভুট্টা ও চালের গুঁড়াসহ ক্রোমাটেড, মেটালিন ইয়োলো, টেঙ্টাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। মানবদেহের জন্য সাইপারমেথরিন ও ডায়াজিননের সহনীয় মাত্রা ০.০১ পিপিএম করে। তবে পরীক্ষায় এ দেশের মসলায় পাওয়া গেছে গড়ে যথাক্রমে ০.৭৩ ও ০.১৯ পিপিএম। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এঙ্চেঞ্জ পলিসি বিভাগের হিসাবে দেশের প্রায় অর্ধশত কম্পানি বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার 'পেপরিকা' ও 'মেটালিন ইয়োলো' (মরিচ ও হলুদের রং বাড়াতে) আমদানি করছে এবং পরে তা মসলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দূষিত মসলার ক্ষতিকারক উপাদান রান্নায়ও ধ্বংস হয় না।
ফলের জুসে ফল থাকে না : গত বছরের ডিসেম্বরে মহাখালীর ইনস্টিটিউট অব ফুড সায়েন্স টেকনোলজি পৃথকভাবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কম্পানির জুসের নমুনা পরীক্ষা করে। পরে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, দু-একটি কম্পানির জুসে অল্প পরিমাণ ফল মেশালেও তা খুবই নিম্নমানের। জুস তৈরির সময় ক্ষতিকর সুগন্ধি, কৃত্রিম রং এবং রাসায়নিকও মেশানো হচ্ছে।
এ ছাড়া দেশে কাঁচা আম পাকাতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়াম কার্বাইড, টমেটো পাকাতে ইরাথ্রোসিন কারমোসিন ও পংকুফোরআন, কমলা হলুদ করতে সানক্রেস্ট ইয়েলো ও মেটালিন ইয়েলো মেশানো হচ্ছে। একইভাবে জুসের পানিতে চিনি ও নিষিদ্ধ সোডিয়াম সাইক্লামেট, কাপড়ের রং, সাইট্রিক এসিড ও প্রিজারভেটিভ (সোডিয়াম বেনজোয়িক ও পটাশিয়াম) ব্যবহার করা হচ্ছে। অম্লতা বাড়াতে ফসফরিক এসিড এবং ঠাণ্ডা রাখতে ইথিলিন গ্লাইকল মেশানো হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সূত্র জানায়, গত বছর সেপ্টেম্বরে তারা আট কম্পানির ১২টি ব্র্যান্ডের জুস বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় ফলের রসের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। অথচ ওই ১২টি জুসের মধ্যে ১১টিতেই দেওয়া ছিল বিএসটিআইয়ের মান সার্টিফিকেট।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) মান নিয়ন্ত্রণ শাখা ও মাঠ পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা দুজন কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে ভালোমানের নমুনা দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট নেওয়া হয়। অতিমুনাফা করতে গিয়ে পরে ব্যবসায়ীরা নিম্নমানের জুস তৈরি করেন। তাঁরা আরো বলেন, ছয় মাস অন্তর পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে। লোকবলের অভাবে বিএসটিআই তা করতে পারে না। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সংশ্লিষ্ট কম্পানি থেকে 'বিশেষ সুবিধা' নিয়ে থাকেন বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।
মৎস্য ও পশুখাদ্যে ভেজাল : পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মৎস্য ও পশুখাদ্যে মেশানো হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক, হাড়ের গুঁড়া এবং শক্তিবর্ধক নিষিদ্ধ হরমোন ও কীটনাশক। ফলে জবাইয়ের পর মাংসেও এসব ক্ষতিকর উপাদান থেকে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা জানান, রান্না করলেও এসব উপাদান নষ্ট হয় না। এ ধরনের মাংস দীর্ঘদিন খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়, শিশুরা হয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী।
দেশের বিশিষ্ট শিশু কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০ বছর আগেও দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ। এখন এ সংখ্যা দুই কোটির অনেক বেশি এবং তাদের অর্ধেকই শিশু। এ ছাড়া দেশে বছরে ৮৪ হাজার মানুষ নতুনভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এ জন্য তাঁরা ভেজাল ও কীটনাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করাকে দায়ী করেন।
http://www.dailykalerkantho.com/?view=d … mp;index=0
আসেন সবাই মিলে প্রজন্ম ফার্ম বানাই, যেখানে বিষ মুক্ত খাদ্য পাওয়া যাবে।