টপিকঃ দেশের ব্যাংকিং খাতে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে একটি উপসম্পাদকীয়
তথ্য প্রযুক্তি
মুনির হাসান
দেশে ইলেকট্রনিক লেনদেন: ইন্টারনেটের দোষ কী?বাংলাদেশে এখন নানাভাবে বেচাকেনা করা যায়, রাজশাহীতে বসে চট্টগ্রামের কোন ব্যবসায়ীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া যায়। ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়েছে সে অনেক দিন আগে থেকে। ফ্লেক্সিলোডের মাধ্যমে মোবাইল ফোনের বিল, বিদ্যুৎ বিল তো দেওয়া যায়ই, এমনকি অনেকে মোবাইল নম্বরকে শনাক্তকরণের জন্য ব্যবহার করে নিশ্চিন্তে সন্তানের কাছে টাকা পাঠাতে পারেন। ব্যাংকিং সেক্টরেও আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। এক ব্যাংকের এটিএম থেকে অন্য ব্যাংকের হিসাবে লেনদেন করা যায়! এই সবকিছু মাত্র কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এসবকে সম্ভব করে তুলছে। তবে মুশকিল হচ্ছে, যে কম্পিউটারকে কেন্দ্র করে এত সব বিকাশ, সেই কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের প্রতি প্রবল বিরাগ দেখিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংশ্লিষ্ট কতর্ৃপক্ষ। সে কারণে বাংলাদেশে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক লেনদেন সম্ভব হলেও ইন্টারনেটে কোনো লেনদেন হয় না। অথচ প্রযুক্তির দিক থেকে এর প্রায় সবগুলোই সমগোত্রীয়।
এটিএম থেকে টাকা তোলার ব্যাপারটা আমরা কমবেশি জানি। এটিএমগুলো ব্যাংকের নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকে। যখন কোনো গ্রাহক তার কার্ডটি এটিএম মেশিনে ঢোকায় তখন সেটি কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে গ্রাহক যখন তার পিন নম্বরটি দেয়, তখন ব্যাংকের সার্ভর্ার সেটির যথার্থতা নিশ্চিত করে। তারপর ইলেকট্রনিক লেনদেনটি সম্পন্ন হয়। যখন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এটিএম থেকে টাকা তোলা হয়, তখনো কমবেশি একই রকম ব্যাপার ঘটে। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হলো, তখন ওই এটিএমকে, ব্যাংকের নেটওয়ার্ক ছাড়াও কার্ড নেটওয়ার্ককে যুক্ত থাকতে হয়। ধরা যাক আপনার কাছে একটি মাস্টার কার্ড আছে। সেটি আপনি যদি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কোনো এটিএমে ঢোকান, তখন প্রথমে আপনি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নেটওয়ার্কে যুক্ত হবেন। ব্যাংকের সার্ভার আপনার কার্ডটিকে মাস্টার কার্ড হিসেবে শনাক্ত করবে। তারপর কার্ড নম্বর ও পিন পাঠিয়ে দেবে কার্ডের সার্ভারে। প্রতিটি কার্ডের জন্য কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের একটি হিসাব থাকে। লেনদেন ওই হিসাবে হয়। দিনশেষে লেনদেনে অংশগ্রহণকারী ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে হিসাবের স্থিতি ঠিক করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যখন কোনো দোকানে পণ্যের বিল পরিশোধ করা হয়, তখনই একটা ঘটনা ঘটে। তবে সে ক্ষেত্রে কার্ডধারীর জমার টাকা তার হিসাব থেকে বিয়োগ হয়ে দোকানদারের হিসাবে জমা হয়। এটিএম বা কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতাকে একই নেটওয়ার্কের সদস্য হতে হয়। মানে আপনি কোনো দোকান থেকে ভিসা কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করতে পারবেন, যদি ভিসা কার্ডে ওই দোকানের অ্যাকাউন্ট থাকে। যদি তাদের হিসাবগুলো পৃথক পৃথক ব্যাংকে থাকে, তাহলে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জড়িত হতে হয়। কারণ আন্তব্যাংক লেনদেন কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে হতে পারে। এই কাজটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে, যদি একটি ইলেকট্রনিক পেমেন্ট গেটওয়ে থাকে, যা আমাদের দেশে এখন নেই।
তবে সরকার পিছিয়ে থাকলেও মানুষ তো আর পিছিয়ে থাকে না। ফলে আমাদের দেশে আন্তব্যাংক লেনদেনেরও একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি গড়ে উঠেছে, সম্ভবত একটি অনন্য পদ্ধতি। যেমন আপনি এখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএমে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। যখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের একজন কার্ডধারী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএমে তার কার্ডটি ঢোকায়, তখন সেটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংযুক্ত হয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে বোঝা হয়ে যায় যে কার্ডটি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের। তখন ডাচ্-বাংলার ডেটা সেন্টার সরাসরি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ডেটা সেন্টারে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে ‘তোমার একজন গ্রাহক ২০ হাজার টাকা তুলতে চায়, তার এ কার্ড নম্বর..., পিন নম্বর...। আমি কী করব?’ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সফটওয়্যার সবকিছু ঠিক ‘দেখেশুনে’ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সফটওয়্যারকে জানায়, ‘হ্যাঁ। টাকা দাও।’ অথবা ‘টাকা দিয়ো না।’ সে অনুযায়ী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম টাকা ‘দেয়’ বা ‘দেয় না’।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এ রকম সব কার্ডহোল্ডারদের টাকা দেওয়ার জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে একটা হিসাব পরিচালনা করে। ফলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের জন্য এই লেনদেনটি যেমন হয় একটি ‘লোকাল লেনদেন’ এবং তেমনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের জন্যও সেটি হয় ‘লোকাল লেনদেন’। ফলে আন্তব্যাংক লেনদেনের ব্যাপারটি থাকে না। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক যখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে তার হিসাবে টাকা জমা দেয়, তখন সেটি কেবল প্রচলিত নিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে হয়।
অর্থাৎ আমাদের দেশেই আমরা এখনই আন্তব্যাংক ই-লেনদেন করতে পারছি, সামান্য জটিলতা করে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ই-পেমেন্ট গেটওয়ে থাকে, তাহলে পুরো ব্যাপারটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে হবে। তখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে যোগাযোগ করবে এবং সব লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গেটওয়ের মাধ্যমে হবে।এভাবে আমাদের দেশে ডেবিট-ক্রেডিট-এটিএম কার্ড দেদারসে ব্যবহার করা যায়। এটি হয় এটিএম মেশিনে বা দোকানের পিওএসে (পয়েন্ট অব সেল্স)। কিন্তু বাংলাদেশে আপনি একই কাজ ইন্টারনেটে করতে পারবেন না! মানে হলো, আপনি দোকানে আপনার কার্ড ব্যবহার করতে পারলেও দোকানের ওয়েবসাইটে সেটি ব্যবহার করতে পারবেন কেন? কারণ তা দেশের ব্যাংকিং নিয়মে ঢোকানো হয়নি। অথচ একটি পিওএস বা এটিএম মেশিনের সঙ্গে মার্চেন্ট ওয়েবসাইটের কোনো পার্থক্য নেই!
আপনি যে রকম এটিএম মেশিনে কার্ড দেন, সে রকম আপনি দোকানের ওয়েবসাইটের নির্ধারিত স্থানে আপনার ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ও পিন দেবেন। তারপর কোনো একটা ব্যাংকের মাধ্যমে আপনার ও দোকানদারের হিসাবে লেনদেন হবে। ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে এই লেনদেনের কোনো পার্থক্যই নেই।কেন ওয়েবসাইটে লেনদেন করতে দেওয়া হয় না, সেটি আমাদের কাছে খুবই দুর্বোধ্য। তবে কি আমরা পিওএস/এটিএমকে ‘বিশ্বাস’ করি কিন্তু ইন্টারনেটকে করি না?
একইভাবে ইন্টারনেট ব্যাংকিং হলো নির্দিষ্ট পিন নম্বর, পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে লগ-ইন করে লেনদেন করা। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যাংকিং চালু হয়েছে, সেও অনেক দিন আগে। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে যা যা করা যায়, তা হলো হিসাবের বিবরণী দেখা ও প্রিন্ট নেওয়া, নিজের জমা টাকা দিয়ে এফডিআর বা অনুরূপ হিসাব খোলা, ইউটিলিটি বিল (যদি ইউটিলিটি প্রতিষ্ঠানের ও আপনার ব্যাংক একই হয়), সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিল দেওয়া ইত্যাদি।
ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বেলায় আমাকে আমার হিসাব থেকে কোনো অর্থ অন্য কারও (তৃতীয় পক্ষ) হিসাবে স্থানান্তর করতে দেওয়া হয় না! অর্থাৎ আমি চাইলে আমার বাবার ব্যাংক হিসাবে নগদ অর্থ জমা দিতে পারব, কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাঁর হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করতে পারব না! ব্যাপারটা অদ্ভুত। কারণ আমি যখন আমার বাবার ব্যাংক হিসাবে নগদ টাকা জমা দিই, তখন কিন্তু সেখানে আমার কোনো অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু যদি আমি আমার হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তর করি, তাহলে কিন্তু রেকর্ড থাকেই। আবার আমি কিন্তু আমার ব্যাংককে এমন নির্দেশনা দিতে পারি যে, মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে আমার বাবার হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা স্থানান্তর হয়ে যাবে, তাহলে তাও কিন্তু সম্ভব। একইভাবে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি ইন্টারনেটে লেনেদেন করে, তাহলে তাদের সব লেনদেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়ে যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বলেন কিংবা সুশাসনের কথা বলেন, শুরু করার জন্য এর চেয়ে বেশি কী আর দরকার?
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত। ফায়ারফক্সের পরশমনি অ্যাড অন দিয়ে ইউনিকোডে রূপান্তরিত।
একই রকম আলোচনা আছে এখানে।