টপিকঃ এবার পাথরকুচি থেকে বিদ্যুৎ।
অসাধারণ এক আবিষ্কার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. কামরুল আলম খানের। পাথরকুচি পাতা এবার শরবতের শান্তি বা ওষুধের উপকরণ নয়, আলো ছড়িয়ে দেবে সারাদেশে। দেবে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। এ জন্য পরিবেশের ক্ষতি হবে না। এক একরে পাতরকুচি চাষ করে তা দিয়ে মাত্র ১ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা যাবে বিদ্যুৎ প্লান্ট। ৫০ মেগাওয়াটের এই প্লান্ট থেকে প্রতিদিন উৎপন্ন হবে ৩১ কোটি ২০ হাজার টাকার বিদ্যুৎ। ৫০ থেকে ৬০ বছর স্খায়ী হবে এই প্লান্ট। এক বছরে প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ১১৪ কোটি টাকার। এই বিস্ময়কর উদ্ভাবনকে কাজে লাগানো গেলে বিদ্যুতের আর কোনো সঙ্কট থাকবে না। গ্যাসের জন্য কমে যাবে উদ্বেগ। আর এ পাথরকুচি পাতা চাষ করে কৃষকের ঘরেও আসবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা।
এমন বিস্ময়কর উদ্ভাবনের বিবরণ তুলে ধরলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. কামরুল আলম খান। ড. খান পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কলাকৌশল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেন।
কিভাবে সম্ভব? : যে গাছটি যেখানে-সেখানে হয়, যার জন্য নেই কোনো আদর-যত্ন, সেই গাছ আবার বিদ্যুৎ দেবে? অনেকের এমন সব প্রশ্নের উত্তর দেন ড. কামরুল আলম খান। তিনি বলেন, অলৌকিক এক গাছ পাথরকুচি। নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, এক কেজি পাথরকুচি পাতা থেকে ২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। পাশাপাশি এই পরিমাণ পাথরকুচি দিয়ে নির্বিঘেí বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব কয়েক বছর। এক একর জমিতে উৎপন্ন পাথরকুচি পাতা থেকে বছরে প্রায় ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে।
ড. কামরুল আলম খান জানান, পাথরকুচি দিয়ে তৈরিকৃত মণ্ডটি আয়রন ও ক্লোরিনসমৃদ্ধ থাকে। এ দু’টি উপাদানের বিক্রিয়ায় তৈরি হয় ডিসি বিদ্যুৎ। একে কনভার্টার দিয়ে এসিতে রূপান্তরিত করে বাতি ও পাখা চালানো সম্ভব। এক কেজি পাথরকুচিতে উৎপাদিত ২০ ভোল্ট বিদ্যুৎ দিয়ে এলইডি ল্যাম্প ও পাখা চালানো সম্ভব।
পাথরকুচি পাতা দিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ কিভাবে কাজে লাগানো যায় এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানকল্পে এ প্রযুক্তি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যা দেন ড. খান। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। অথচ পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে তা গ্যাসের বিকল্প হিসেবে চমৎকার ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র শেষ হলে প্রতিটি জেলা পর্যায়ে এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্খাপন করা যেতে পারে। জেলা পর্যায়ে এ ধরনের প্লান্ট সম্পন্ন হওয়ার পর উপজেলা এমনকি প্রতিটি গ্রামে এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বসানো যেতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ‘সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্র’ কর্র্তৃক গতকাল আয়োজিত নবআবিষ্কৃত ‘পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন’ শীর্ষক সেমিনারে ড. খান তার আবিষ্কারের বিস্তারিত তুলে ধরেন। ভিসি অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত গবেষণা কার্যক্রম যথাযথভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেমিনারে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ছাড়াও এ সময় উপস্খিত ছিলেন বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো: আবু ইউসুফ ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো: হুমায়ুন আহমেদ, গণসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক হোসেন প্রমুখ।
সেমিনারে বাংলাদেশে ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা, ১৯টি জেলা ও ১৩৭টি দ্বীপে পাথরকুচি পাতা চাষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিভাবে হবে এ বিষয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত করেন ড. কামরুল আলম। তিনি পাথরকুচি পাতাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশেষ প্রযুক্তি সেমিনারে উপস্খাপন করেন। পরীক্ষামূলকভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি পাথরকুচি পাতা থেকে ১২ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে একটি এলইডি ল্যাম্প জ্বালিয়েও দেখান। এ প্রক্রিয়ায় বড় আকারের স্টোন চিফ পাওয়ার প্লান্ট তৈরি করা যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
কোথায় পাবে পাথরকুচি
পাথরকুচি পাতা সহজেই চাষ করা যায়। পাথরকুচি পাতা উৎপাদনের জন্য খুব বেশি যত্ন নিতে হয় না। যেকোনো স্খানে একটি পাতা ফেলে রাখলেই এর ধার ঘেঁষে চারা উৎপন্ন হয়। এমনকি বালুস্তূপেও এটি হয়। আবার পাকা দালানের ছাদেও পরিচর্যা ছাড়াই এটি চাষাবাদ করা সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে কিছুটা কৌতুক করে ড. কামরুল আলম বললেন, এমন দিন হয়তো আসবে কৃষকরা ধান ও ভুট্টা ছেড়ে পাথরকুচি চাষ করবেন।
১ কোটি বিনিয়োগ করে বছরে ১১৪ কোটি টাকার বিদ্যুৎ
ড. কামরুল আলম খান জানান, ৫০ মেগাওয়াটের একটি পাথরকুচির বিদ্যুৎ প্লান্ট বানাতে প্রয়োজন হবে ১ কোটি টাকার মতো। এক একরে উৎপাদিত পাথরকুচি যথেষ্ট এ প্লান্ট চালাতে। ৫০ থেকে ৬০ বছর চলবে এই প্লান্ট। ৫০ মেগাওয়াটের একটি গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ প্লান্ট বানাতে ১৫০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। এ ধরনের প্লান্ট থেকে বছরে ১১৪ কোটি টাকার বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। প্লান্ট করা যায় গ্যাসের প্রাপ্তিসাপেক্ষে। পাথরকুচির ক্ষেত্রে এ রকম কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এ ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, উদ্ভাবনের বিস্তারিত আমি জানি না । তবে এ আবিষ্কার যদি বাস্তবে কার্যকর হয় তবে বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বিপ্লব এসে যাবে।
উল্লেখ্য, বিশ্বে গ্যাস-কয়লা জ্বালানি ও তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় বেশি। এর বাইরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। আর নবায়নযোগ্য উৎস হিসেবে পানি বায়ু ও সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। তবে পাথরকুচি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে সেটি হবে বিশ্বের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন। আর এটি হবে সবচেয়ে সহজ এবং সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন উৎস
সুত্র: নয়া দিগন্ত ৩১ শে মার্চ ২০০৯