টপিকঃ ফুলের নাম : দোলনচাঁপা
ফুলের নাম : দোলনচাঁপা
Common Name : Butterfly Ginger Lily, White ginger lily, Mariposa, Garland Flower
Scientific Name : Hedychium coronarium
বাংলার অতি পরিচিত একটি ফুল দোলনচাঁপা। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বাগানে দোলনচাঁপা স্থান করে নিয়েছে তার অপরূপ সৌন্দর্য আর সুগন্ধের বিনিময়ে। কিউবার জাতীয় ফুল দোলনচাঁপা মূলত আমাদের হিমালয় অঞ্চলের আদিবাসী। আমাদের বাগানের এই সুন্দরীকে ক্রিতদাস ক্রয়-বিক্রয়ের যুগে প্রথম ব্রাজিলে প্রেরণ করা হয়। ক্রিতদাসেরা দোলনচাঁপা গাছের পাতা তাদের বিছানা হিসেবে ব্যবহার করতো। বর্তমানে ব্রাজিলে দোলনচাঁপা এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে একে রাক্ষুসে আগাছা হিসেবে অভিহত করা হয়। হাওয়াই অঞ্চলেও একে আগাছা গণ্য করা হয়। আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে এর চাষ নিষিদ্ধ।
চার পাপড়ি বিশিষ্ট প্রতিটি দোলনচাঁপা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। তাই একে ইংরেজিতে বাটারফ্লাই জিঞ্জার লিলি (butterfly ginger lily) বলা হয়।
বৈজ্ঞানিক নাম Hedychium coronarium এর প্রথম অংশ Hedychium এসেছে গ্রীক দুটি শব্দ Hedys এবং Chios থেকে। Hedys অর্থ Sweet বা মিষ্টি এবং Chios অর্থ Snow বা তুষার। ফুলের সৌরভ আর বর্ণের কারণেই এই নামকরণ।
বর্ষাকালীন ফুলগুলোর মধ্যে দোলনচাঁপা অন্যতম। শুনতে পাই দোলনচাঁপার মোট প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৪০টি! সাদা ছাড়াও কোনো কোনোটির রং হলদেটে বা লালচে হয়। আবার কোনো কোনো ফুলে থাকে গাঢ় হলুদ বা কমলা রঙের ছিটে। সাদা ছাড়া অন্যগুলি আমি দেখিনি কখনো।
বর্ষাকালের বিকেলে দোলনচাঁপা ফোটে। বর্ষার সন্ধ্যায় একরাশ সুগন্ধ নিয়ে হাজির হয় দোলনচাঁপা। বর্ষায় ফুটতে শুরু করে শরৎ শেষ হতে হতে এর ফুলের মৌসুম শেষ হয়। গ্রীষ্মের মধ্যভাগ থেকে বসন্ত পর্যন্ত গাছটির অগ্রভাগে ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি ফুলের মোচা বের হয় এবং মোচার ভেতর থেকে ৭-১২টি ফুলের কলির জন্ম হয়।
ক্রমান্বয়ে সাদা পাপড়ির ফুল ফুটতে থাকে। ফুটন্ত ফুল ২-৩ দিন পর আপনা-আপনিই ঝরে যায়। একটি গাছে একসঙ্গে ১ থেকে ৩টি ফুল ফোটে এবং বাকি ফুলের কলিগুলো পর্যায়ক্রমে ফোটে। এভাবে একটি ফুলগাছে ফুল ফোটা শেষ হলে ওই গাছে আর কোনো ফুল ধরে না, গাছটি মারা যায়।
দোলনচাঁপা গাছ আদার মতো কন্দ থেকে গজায়। বহুবর্ষজীবী কন্দজ উদ্ভিদ দোলনচাঁপা জীবনীশক্তিতে ভরপুর। শীতকালে এর কান্ড মরে গিয়ে গাছ শুকিয়ে যায়। গ্রীষ্মে কান্ডের পুনর্জন্ম হয়। নতুন করে জেগে ওঠে গাছ। একবার কন্দ চারা রোপণ করলে ধীরে ধীরে গাছের চারা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং গাছ ঝোপালো আকার ধারণ করে। তীব্র আলোর সাথে অভিমান আছে এই ফুলের। দোলনচাঁপা ভীষণভাবে ছায়াময় শীতল পরিবেশ ভালোবাসে। সমতল ও পাহাড় দুই জায়গাতেই ভালো হয় দোলনচাঁপা।
ফুলদানিতে রাখবার জন্যও এই ফুলের কদর আছে। বর্ষা এলেই ঢাকার অনেক রাস্তার মোড়ে, ট্রাফিক সিগনালে ছোট ছোট বাচ্চারা গুচ্ছো গুচ্ছো চোলনচাঁপা নিয়ে ছুটে আসে বিক্রির জন্য। ফুলের দোকানেও বিক্রি হয়। ফুলদানিতে রাখলে রাতের বেলা সারা ঘর এর সুবাসে ভরে উঠে। রাতের সাথে দোলনচাঁপার সম্পর্ক, রাতের আঁধারেই সে তার সৌন্দর্য আর সুবাস ছড়িয়ে দেয়।
কবি নজরুল ১৯২৩ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় রচিত কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছিলেন দোলনচাঁপা। তিনি লিখেছেন –
"দোলনচাঁপা বনে দোলে দোলপূর্ণিমা রাতে চাঁদের সাথে,
শ্যামপল্লব কোলে, যেন দোলে রাঁধার লতার দোলনাতে।
যেন দেবকুমারীর শুভ্র হাসি, ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি
আরতির মৃদুজ্যোতি প্রদীপ কলি দোলে, যেন দেউল আঙিনাতে।"
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন তার কবিতায় এভাবে-
দোলে দোলে দোলে প্রেমের দোলন-চাঁপা হৃদয়-আকাশে,
দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে॥
কৃষ্ণরাতের অন্ধকারে বচনহারা ধ্যানের পারে
কোন স্বপনের পর্ণপুটে ছিল ঢাকা সে॥
দখিন-হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন-রেণুকা।
গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির বেণুকা।
----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -----
একগুছি চুল বায়ু-উচ্ছ্বাসে কাঁপা
ললাটের ধারে থাকে যেন অশাসনে।
ডাহিন অলকে একটি দোলনচাঁপা
দুলিয়া উঠুক গ্রীবাভঙ্গির সনে।
বৈকালে গাঁথা যূথীমুকুলের মালা
কণ্ঠের তাপে ফুটিয়া উঠিবে সাঁঝে;
----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -----
ছবি : প্রথম ছবিটি ছাড়া বাকি ছবিগুলি তুলেছিরাতের বেলা, মোবাইলে।
ছবি তোলার স্থান : উত্তর বাড্ডা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
তথ্য সূত্র : উইকি পিডিয়া, বাংলা পিডিয়া