টপিকঃ ফুলের নাম : ধুতুরা
ফুলের নাম : ধুতুরা
সংস্কৃত নাম : ধুতুরা, ধত্তূর, কিতব, ধূর্ত্ত, দেবতা, মদন, শঠ, উন্মত্ত, মাতুল, তূরী, তরল, কনকাহবয়
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : ধুতরা, ধতুরা, ধোবা, মাদকুণিকে, উন্মেত্তচেটু, ধংতুরী।
আরবী নাম : জোজমাসীল, জোজনসী, তাতুরা।
Common Name : Horn of Plenty, Devil's Trumpet, Datura double purple, Jimson Weed, Evil's snare, Thorn apple, metel.
Scientific Name : Datura metel
বাঘ-ছাল প'রে আয় হৃদয়-বনের শিকারি
ঘাগরা প'রে প'রে পলার মালা আয় বেদের নারী
মহুয়ার মধু পিয়ে ধুতুরা ফুলের পিয়ালায়।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
ধুতুরা নাম শেনেননি এমন লোক বাংলায় খুঁজে পাওয়া ভার। ধুতরা গাছ সাধারণভাবেই বিষাক্ত গাছ হিসাবে পরিচিত। ধুতুরা গাছের সমস্ত অংশই বিষাক্ত। ধুতুরা গাছে আছে বিপজ্জনক মাত্রায় Tropane Alkaloids নামক বিষ। এই গাছের বিষক্রিয়ায় মানুষ বা পশুপাখির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে অনেক দেশেই ধুতুরার উৎপাদন, বিপনন ও বহন আইনত নিষিদ্ধ।
পারি নাই বাছা মোর, হে প্রিয় আমার,
দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে!-মোর অধিকার
আনন্দের নাহি নাহি! দারিদ্র্য অসহ
পুত্র হ’য়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশি?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি?
কোথা পাব পুষ্পাসব?-ধুতুরা-গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস!
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
ধুতুরা বিষাক্ত হলেও এর ফুলের সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোহর, আর গুণও প্রচুর। তবুও ধুতুরা কথা উঠলেই সব ছাড়িয়ে তার বিষাক্ততার কথাই আসে সবার আগে। দেমাগ দেখানোর মতো রূপ নিয়েও তাই অভিমানী ধুতুরার অব্যক্ত কথা উঠে এসেছে গুনমুগ্ধ কবির কবিতায় -
ধুতুরা ফুলের শুভ্রতায় আকৃষ্ট হয়ে গেলাম ছুটে।
ধুতুরা বলল- ‘ আমার বুকে অনেক বিষ,
ঢের ভালো রঙিন ভাঁটফুলের কাছে যাও
নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নাও সুখ পাবে বেশ’!
----- গোলাম রহমান -----
গ্রামের বা শহরের কোনো ফুলবাগানেই স্থান নেই ধুতুরার। জমির আইলে, পুকুর পাড়ে, বনে-বাদাড়ে, পথের ধারে অযত্নে অবহেলায় এই গাছ জন্ম ও বেড়ে উঠা।
বর্ষাকালে ধুতরা গাছে ফুল ফুটতে শুরু হয়। গাছের শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে ফুল ধরে। সাধারণত হেমন্তকালজুড়ে গাছে ফুল দেখা যায়।
ধুতুরা ফুলের কলি দেখতে লম্বাকৃতির, আর ফুল ফানেলাকৃতির। নানান আকার আর ধরনের ধুতরা ফুল আছে। তবে বাংলাদেশে সাধারনত সাদা আর বেগুনি রং এর ফুল বেশী দেখা যায়। ঊর্ধ্বমুখী এই ধুতুরা ফুলে মৃদু গন্ধ আছে।
সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক
নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,
অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।
আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?
সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?
নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?
অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?
তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?
----- সৈয়দ শামসুল হক -----
পড়ন্ত বিকাল থেকে সন্ধ্যায় গাছে ফুল ফোটে। দিনে রোদের অত্যাচারে ফুল সংকুচিত হয়ে যায়, বিকেলে আবার পাপড়ি মেলে। এভাবে ২ থেকে ৩ দিন তাজা থেকে ফুল ঝরে যায়।
ধুতরা স্ব-পরাগায়িত ফুল, ফুলের ভেতর পুংদণ্ড ও গর্ভমুণ্ড অবস্থিত। ফুল শেষে গাছে ছোট ছোট কাঁটাযুক্ত সবুজ রং এর গোলাকবার ফল হয়। ফলের ভেতরের বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার হয়। প্রতিটি গাছ ৪ থেকে ৫ বছর বাঁচতে পারে।
মন্দ–স্রোতা মন্দাকিনী সুরধুনী–তরঙ্গে
সঙ্গীত জাগাও হে তব নৃত্য–বিভঙ্গে।
ধুতরা ফুল খুলিয়া ফেলি’
জটাতে পর চম্পা বেলী
শ্মশানে নব জীবন, শিব, জাগিয়ে তোলো।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
শিবপূজায় কেতকী, চাঁপা, বেশির ভাগ রঙিন ফুল অর্পণ করা নিষিদ্ধ। শ্বেত কল্কে, আকন্দ, ধুতরা শিবের খুব প্রিয়। প্রচলিত আছে যে, এক বছর নিষ্ঠাভরে একাদশীর ব্রত পালন করলে যে ফল হয়, ভক্তিভরে মাত্র একটি ধুতরা ফুল শিবলিঙ্গে অর্পণ করলে তার সমতুল্য ফল প্রাপ্তি ঘটে।
বলাহয় সব ব্রতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল মহাশিবরাত্রি। ব্রতের আগের দিন ভক্তগণ নিরামিষ আহার করে। রাতে বিছানায় না শুয়ে মাটিতে শোয়া হয়। ব্রতের দিন তারা উপবাসী থাকে। তারপর রাত্রিবেলা চার প্রহরে শিবলিঙ্গকে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর বেলপাতা, নীলকন্ঠ ফুল, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা প্রভৃতি ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। আর ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ এই মহামন্ত্র জপ করা হয় ।
শুধু শিব ঠাকুরই নয় মানুশের শরীরও তুষ্ট হবে ধুতুরা ফুলে। গাছটি বিষাক্ত হলেও এই উদ্ভিদ ভেষজ গুণে ভরপুর। ভেষজ চিকিৎসায় এর ব্যবহার আছে।
ধুতুরা মন্দকারক, কটুরস , মূর্ছাকারক , ভ্রমকারক, নিদ্রাকারক , বায়ুবর্ধক , ক্লান্তিবর্ধক বর্ণকর, অগ্নিবৰ্দ্ধক, ছদ্দিকারক, উষ্ণবীৰ্য্য, গুরু, তিক্তাকষায়মধুরীরস, বিষনাশক, উকুন নাশক, বেদনানাশক, মূত্ৰবৰ্দ্ধক। এবং জ্বর , কাশ , শ্বাসকষ্ট , চুলকানি , পাঁচড়া , ব্রণ, কুষ্ঠ, কফ, কৃমি,নাশক ।
শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য এ গাছের পাতা, ফুল, ফল উপকারী।
কৃষ্ণ ধুতুরার শুকনো পাতা এবং ফুল বাসক পাতায় জড়িয়ে সিগারেট তৈরি করে ধূমপান করলে হাঁপানির কষ্ট কমবে।
ধুতুরা গাছের পাতা, মূল, ফুল ও ফল সিদ্ধ করে সেই তাপ নিয়ে বুকে সেঁক নিনলে শ্বাসকষ্ট কমে যাবে।
বাতের ব্যথা কমাতে এর পাতার রস সরিষার তেলের সাথে ব্যবহার করলে ব্যথা কমবে।
ধুতুরা পাতা ও কাঁচা হলুদ একসঙ্গে বেঁটে স্তনের উপর প্রলেপ দিলে মহিলাদের স্তনের ব্যথা কমে যাবে। পরে স্তন ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে।
ধুতরা পাতার রসের সাথে সামান্য একটু গাওয়া ঘি মিশিয়ে ফোঁড়ার স্থানে প্রলেপ দিলে ফোঁড়া পেকে যায়।
ধুতরা পাতার রস দুই থেকে তিন ফোটা প্রতিদিন দুধের সাথে খেলে ক্রিমি কমে যায়।
ধুতুরার বীজ থেকে চেতনানাশক পদার্থ তৈরি করা হয় ।
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ,- শুধু অবসাদ!
মহুয়ার,- ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
----- জীবনানন্দ দাশ -----
সতর্কতা : এই গাছটি খুবই বিষাক্ত। বিশেষ করে এর কাঁচা ফল অত্যন্ত বিষাক্ত। এই গাছের যেকোন অংশ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা না থাকলে বিপদ হয়ে যেতে পারে। খুব অভিজ্ঞ না হলে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। ধুতুরার বহুবিধ ব্যবহার থাকলেও এটি বিষাক্ত হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খুব সাবধানে এটি ব্যবহার করা উচিত৷ অভিজ্ঞ কবিরাজের পরামর্শ ছাড়া এই গাছের কোনো অংশই খাওয়া নিষিদ্ধ।
আজি নাচে নটরাজ এ কী ছন্দে ছন্দে।
কী জানি কী সুখাভাসে
মৃদু মৃদু মধু হাসে
কে জানে মাতিল কোন আনন্দে।।
ধুতুরা খুলিয়া ফেলি’
পড়েছে চম্পা বেলি
অপরূপ রূপ হেরি সবে বন্দে।।
----- কাজী নজরুল ইসলাম -----
বিভিন্ন সময় এই ছবিগুলি তুলেছি : কার্জন হল, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইছাপুরায়।
তথ্য সূত্র-
উইকি - ১
উইকি - ২
উইকি - ৩
আনন্দবাজার