টপিকঃ একজন গফুর অথবা একটি কাকের গল্প
সকালে ঘুম থেকে জেগেই গফুর একটা কাক মেরেছিলো। সে যদিও, গল্প করবার মতো বিষয় নয়... তবুও কথায় কথা আসে। আনতে না চাইলেও, বেহায়ার মতো এখানেও এসে যায়, এসে গেলো।
গফুরের ঘরটা শহরের মাঝেই, একটা নোনা পরা, পলেস্তারা খসা আদ্দিকালের পুরোনো একতলা বাড়িতে। ঘুপচি গলিরও উপগলির মাথায় এই ঘরে বাইরের কোলাহল খুব একটা পৌঁছায় না বলে শীতকালে বেলা করে ঘুম থেকে জাগার বিলাসিতাটুকু করার সুযোগ আছে তার। পেশায় সিএনজি চালক গফুরের জীবিকার তাড়া আজকের শীতের মতো তীব্র নয়।
তাই, সাত সকালে যখন হতচ্ছাড়া কাকটা অন্য কোথাও নয়, এ ঘরেরই জানালার পাশে শ্যাওলা ধরা ভাঙ্গা দেয়ালে বসে কা কা করে ডেকেই যাচ্ছিলো, ডেকেই যাচ্ছিলো... অকস্মাৎ ঘুম থেকে জেগে রগচটা গফুর তার মেজাজ হারিয়ে চৌকির নিচে থেকে দা খানা নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিলো কাকটিকে লক্ষ্য করে। অদ্ভুত, জীবনে বহু লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ গফুরের ছুঁড়ে দেয়া দা-এর আঘাতে কাকটি মরে দেয়ালের ওপাশে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেলো অর্থহীন কা কা শব্দ।
বিক্ষিপ্ত মেজাজে ঘর থেকে বেড়িয়ে, দা-টা কুড়িয়ে এনে পানি দিয়ে পরিস্কার করতে করতে গফুর মৃত কাকটির কথা ভাবে কিচ্ছুক্ষণ। তারপর বাড়ির উঠোনের এজমালি গোসলখানার ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধোয়ার সময় মন থেকে ওই ভাবনাটাও ধুয়ে ফেলে সে।
খেজুরের গুড় আর মুড়ি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে, আকবরের গ্যারেজ থেকে ‘গাড়ি’ নিয়ে সারাদিন শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরতে থাকে গফুর যাত্রী পারাপার করতে করতে। কত মানুষ তার যাত্রী হয়ে আসে, নানান বয়সের, নানান ধর্ম বা জাতের। তার ঠিক পেছনেই সেই যাত্রীদের জীবন নাটকের অতি ক্ষুদ্রাংশ মঞ্চস্থ হয়, কম কথা বলা গফুর চুপচাপ শোনে সেই সব গল্প। নতুন যাত্রী আসে, একটু আগে নেমে যাওয়া পুরোনো যাত্রীর গল্পও ভুলে যায় গফুর।
পেছনে যখন যাত্রী থাকে না, তখন সে একটু বেশি স্পীড তোলে, বেপরোয়া চালায়। মেজাজ হারিয়ে রিকশা বা অটোওয়ালাদের গালি দেয় বাপ-মা তুলে, ছোট্ট পোর্টেবল স্পীকারে পুরোনো দিনের হিন্দি গান শোনে। দুপুরে সস্তার রেস্তোরায় খাবার খেয়ে, সিএনজির পেছনের সিটে বসে সিগারেট টানতে টানতে আধঘন্টা ঝিমিয়েও নেয়।
এখানে সেখানে আরও কয়েকটি ‘টিপ মেরে’ সন্ধ্যায় গ্যারেজে ফেরার জন্য মহাসড়ক দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথটি ধরে সে। কিছুদূর যাবার পর, উল্টোদিক থেকে অন্য আরেকটি বাসকে ওভারটেক করতে থাকা বেপরোয়া একটি বাসের ধাক্কায় সিএনজি থেকে ছিটকে পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় গফুর। বাসটি থামে না আর, একই গতিতে ছুটতে থাকে যেন কিছুই হয়নি।
এইমাত্র মরে গেছে গফুর, ঘটনাস্থলে এখনও সাধারন মানুষ কিংবা পুলিশ এসে পৌঁছয়নি যদিও; কিন্তু কথা এসে যায়। বেহায়া কথা, লজ্জাহীন কথা।
সকালে ঘুম থেকে জেগেই গফুর একটা কাক মেরেছিলো। এখন, মহাসড়কের ঢালে মৃত মাছির মতো উল্টো হয়ে পড়ে থাকে তার ‘গাড়ি’... খানিকটা দূরেই আরেকটি মৃত মাছি বা কাকের মতো মৃত গফুর। উপরে যে আকাশ- একটা নির্জন কাক তাকে দ্বিখন্ডিত করে উড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার কালচে লাল আকাশের দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে কা কা শব্দ।
যদি না আসো... সুস্বাগতম!!