সর্বশেষ সম্পাদনা করেছেন যাপিত সময় (২৯-১১-২০১২ ১৬:২৫)

টপিকঃ অচেনা অবলম্বন

"১"

- পুতুল, কে এসেছে?
- মা, একজন ভিক্ষুক দরজায় বসে আছে। চাকমা।
- ভিক্ষুক আবার চাকমা কিরে?
- হ্যাঁ, মা। খাবার চায়।

লোকটা বেশ ফর্সা। পরণের কাপড় জীর্ণ হলেও সচরাচর ভিক্ষুকদের মত অপরিষ্কার নয়। একটা কাপড়ের পুঁটলির মত ব্যাগ কোলে নিয়ে ছোট একটা চক্‌ হাতে মেঝের উপর কিসব আঁকাআঁকি করছে আর আপন মনে বিড় বিড় করছে। মাকে দেখে মুখ তুলে চাইল।

- আমাকে খাবার দেবে। আমার বাটি আছে, এটাতে দাও।

ব্যাগ থেকে পরিষ্কার একটা প্লাস্টিকের বাটি বের হল।

- নোংরা খাবার দেবেনা। আমি রোজা আছি, এটা দিয়ে ইফ্‌তার করব।

মা একটু অবাক হয়েই বাটিটা নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। পুতুল জিজ্ঞেস করল-

- আপনি কোথায় থাকেন?

লোকটা কোন উত্তর না দিয়ে আঙ্গুলে কিসব হিসাব করতে লাগল। মা বাটির মাঝে ভাত, একপাশে গরুর মাংসের তরকারি আর এক পাশে একটু চচ্চড়ি ডাল দিয়ে বাটির মুখ আটকে নিয়ে এলেন। পুতুল আবার জিজ্ঞেস করল-

- বলেন না! কোথায় থাকেন আপনি?

লোকটা একটু হেসে কোন উত্তর না দিয়ে বাটিটা ব্যাগের মাঝে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

- কটা যে বাজে! আড়াইটা মনে হয় বেজেই গেছে!

পুতুল দরজা লাগিয়ে মার দিকে তাকাল।

- দেখেছ মা, বলেছিলাম না চাকমা।
- তাইতো রে, চেহারা কেমন চাকমা চাকমা বলেই যেন মনে হল।
- আর কিরকম অদ্ভূত ভঙ্গিতে কথা বলল না?
- পাগল মনে হয়। বোধ হয় এমনি ভিক্ষে করে অভ্যেস নেই।
- কিন্তু মা, পাগল, তাও আবার চাকমা, ভিক্ষেই বা করে বেড়াচ্ছে কেন? নিজের আত্মীয়-স্বজন কেউ নাই নাকি?
- কে জানে বাবা। হয়তো ভাগ্যে কোন একটা খারাপ কিছু ঘটেছে। কত কিছু যে হচ্ছে চারপাশে, আমরা কি সব খবর রাখতে পারি? আয়, এখন খেতে বস। অনেক দেরী হয়ে গেল।


"২"

সাদেক কবির সাহেব বসে বসে ঢুলছিলেন। লতিফ সাহেব এসে ছোট একটা ধাক্কা দিলেন।

- কি হে, এত হইচই এর মাঝে ঘুম পায় কিভাবে তোমার?

সাদেক সাহেব মুখের সামনে হাত নিয়ে একটা হাই চাপা দিলেন।

- আর বোলনা, রাতে ইদানিং দুই আড়াই ঘন্টার বেশী ঘুমই হচ্ছেনা। বয়স তো আর থেমে নেই, বুঝলে?
- হুঁ, তাতো বুঝলাম, এখন কোন গল্প বলবে রেডি করেছো?
- গল্প? হ্যাঁ, এখনো ভেবে দেখিনি। দেখি কোনটা বলা যায়।

লতিফ সাহেব খানিকক্ষন চুপ থেকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন-

- আচ্ছা, সোনাদীঘির অ্যাকশনটা বলবে? ওটাই বল না হয় আজকে?
- আরে নাহ্‌, ধুর।
- কেন? কখনো তো বলোনা।
- তুমিও তো বলোনা। নিজে একসময় বললেও তো পার!

লতিফ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

- ছেলেটা ছবি তুলতো চমৎকার, তাইনা?
- তা ঠিক আছে, কিন্তু ওই সময়ে তাকে কে বলেছিল এ দেশে আসতে? এলই যদি, ক্যাম্পেই তো ভাল ছিল, ক্যামেরা হাতে একেবারে এম্‌বুশের মাঝে চলে আসতে হবে?
- মাঝপথে খেয়াল না করলে তো সরাসরি গুলি খেত...
- গুলি তো খেল ঠিকই।
- হুম্‌। রণজিৎ বলেছিল মাথায় নাকি?...
- আচ্ছা, তবে লাশটা পাওয়া গেলনা কেন বলতে পার?
- সত্যি বলতে কি...

লতিফ সাহেব একটু অস্বস্তি বোধ করেন,

- আমার মনে হয় ছেলেটা তখন মারা যায় নি।
- ধ্যাৎ, কি যে বল! তাহলে তো ফিরেই আসত।
- না, মনে হয় মাথায় আঘাত টাঘাত লেগে... স্মৃতিভ্রংশ...
- আরে না না, এগুলা আজগুবি চিন্তা। গুলি খেয়ে পানিতে পরে ভেসে টেসে গিয়েছিল আর কি...। এখনো ভাবলে খারাপ লাগে, কোন বিদেশ বিভূঁই থেকে এসে এখানে পড়েছিল। তার বাসার ঠিকানাও জানতাম না যে একটা খবর পাঠাব।
- হুঁ।

লতিফ সাহেব আর কথা বাড়ান না।

- যাই হোক, তোমার ডাক পড়বে এখনই। রেডি হয়ে নাও।
- ঠিক আছে।

সাদেক সাহেব বসে বসে স্মৃতি হাতড়ে গল্প খুঁজতে থাকেন, কোনটা বলা যায়। আজকাল বেশ এরকম বড়সড় অনুষ্ঠান করে ছোট ছেলেপেলেদেরকে নিয়ে এসে যুদ্ধের গল্প শোনানো হচ্ছে। সাদেক সাহেব আসতে চান্‌না, কিন্তু লতিফ সাহেবের জোরাজুরিতে না-ও করতে পারেননা। বহু দিনের বন্ধু কিনা।


"৩"

ইয়োশিদের বাড়িটা বেশ বড়, কিন্তু তার কাছে ভালই লাগেনা। প্রায়ই সে দাদীকে বলে ‘চলো দাদী, শহরে গিয়ে থাকি।’ দাদী হাসেন কিন্তু কিছুতেই এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাননা। ইয়োশির বাবা মা দুজনেই মারা গেছেন যখন সে খুব ছোট। দাদী-ই তার একমাত্র আপনজন, যাকে সে সবচেয়ে ভালবাসে। দাদীকে ছেড়ে থাকা ইয়োশির পক্ষেও সম্ভব না।

- জানিস আমি তোর সমান বয়সে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসে উঠেছিলাম। তোর দাদা খুব শখ করে বাড়ি করার জন্য এ জায়গাটা বেছে নিয়েছিল। আর কোন কিছুর প্রতি তার তেমন মোহ ছিলনা, কিন্তু এ বাড়িটা তার প্রানের প্রিয় ছিল। কেমন করে এটা ছেড়ে যাই, বল?
- ধুর, এ বাড়িতে আর এমন কি আছে?

কিন্তু সত্যি-ই কি কিছু নেই? দাদার যে স্মৃতিটুকু দাদীকে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে তা তো এ বাড়িকে ঘিরেই। বারান্দার পিছে যে ছোট বেদীটাতে বসে তারা চা খেতেন, শোবার ঘরের যে জানালাটা দিয়ে তারা নীল পাহাড়টার দিকে চেয়ে থাকতেন, দক্ষিণের যে ছোট বনটার ধারে তারা বিকেল বেলা হাত ধরে হাঁটতেন এসব কি আসলেই কিছু নয়? ইয়োশি বোঝে দাদার স্মৃতি শুধু এই বাড়ি, আর দাদীর আলমিরায় তুলে রাখা দাদার শখের ফোটোগ্রাফের খাতাটা। দাদী যতবার এ বাড়ির একটা সিঁড়ি বেয়ে নামেন, কিংবা একটা জানালা খুলে দেন, কিংবা খাতাটা খুলে একটা ছবির উপর হাত বুলান, ততবার তিনি তাঁর হারানো স্বামীকেই খুঁজে ফেরেন, যিনি একাত্তর সালে একটি যুদ্ধক্লান্ত দেশে ছুটে গিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে মানবতার কিছু অসামান্য ছবি তুলে ধরার নেশায়। এ ছেড়ে তো দাদী কোথাও যাবেননা। নাহ্‌, ইয়োশি আর দাদীকে শহরে নিয়ে যেতে জোর করবে না। কিন্তু...

- দাদী বাংলাদেশ যাবে?

দাদী একটু যেন চমকে উঠেন। পরক্ষণেই সামলে নেন।

- না রে, কি হবে গিয়ে?
- কেন দাদী, তুমি তো এখনো মনে কর দাদা বেঁচে আছেন। যদিও ওখানে যুদ্ধের অনেকদিন পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু দাদার মৃত্যু সংবাদ তো কেউ তোমাকে দেয়নি।
- না রে, এমনি মনকে সান্তনা দেই আর কি। বেঁচে থাকলে কি আর সে ফেরত আসতোনা?
- কে জানে দাদী, দাদা হয়ত সত্যি বেঁচে আছেন। চলো একবার গিয়ে নিজে খোঁজ নিয়ে আসি। হয়তো যাওয়া বৃথাই হবে, কিন্তু একটা চেষ্টাতে দোষ কি?

দাদী একটু হাসার চেষ্টা করেন, কিছু বলেননা। কিন্তু ঠোঁটের কোনাটা যেন একটু কেপে উঠলো? ইয়োশি খেয়াল করে দাদীর চোখের কোনে এক টুকরা জল হীরার মত চিক্‌চিক্‌ করছে। এ অশ্রু এতদিন ধরে লালন করে রাখা কোন প্রিয়জন হারানোর বেদনা নয়, বরং একটা মরচে ধরে যাওয়া আশার পূনর্জন্ম, বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন, যা আরো একটি নতুন ভোরে আরো একটিবার শ্বাস নেবার প্রেরণা দেয়।

Re: অচেনা অবলম্বন

শুরুটা ভাল হইছে। পরের অংশ মাথার উপর দিয়া গেছে।

Re: অচেনা অবলম্বন

চমৎকার গল্প! বলার ভঙ্গীটা বেশ পরিণত smile প্রজন্মের সাহিত্য বিভাগে আপনাকে স্বাগতম hug ভালো থাকুন।

উদাসীন'এর ওয়েবসাইট

লেখাটি CC by-nc 3.0 এর অধীনে প্রকাশিত

Re: অচেনা অবলম্বন

ভাল হইছে মামা smile

সালেহ আহমদ'এর ওয়েবসাইট

লেখাটি GPL v3 এর অধীনে প্রকাশিত

Re: অচেনা অবলম্বন

Re: অচেনা অবলম্বন

এতো সুন্দর লিখা, এতো কম কমেন্ট কেন?

বেদনাদায়ি, তবুও দিনান্তে যে তোমায় ভালবাসি!

Re: অচেনা অবলম্বন

Re: অচেনা অবলম্বন

রাবনে বানাদি ভুড়ি :-(

Re: অচেনা অবলম্বন

১০

Re: অচেনা অবলম্বন

সুন্দর গল্প। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ

১১

Re: অচেনা অবলম্বন

১২

Re: অচেনা অবলম্বন

চমৎকার গল্পটা পড়ে খুবই ভালো লেগেছে।  thumbs_up আরো লিখুন।

hit like thunder and disappear like smoke

১৩

Re: অচেনা অবলম্বন

১৪

Re: অচেনা অবলম্বন

সুন্দর লিখছেন আপনার লেখাগুলা ভালই লাগছে । কিন্তু এখন আর লেখা পাচ্ছি না তো ।