টপিকঃ নীরব প্রেম - আমার এক অতিপরচিত ডাক্তার বন্ধুর কথা
এই জীবনের পথ সোজা নয় যেন বড়ো একাবাকা বান্ধুর
-“হ্যালো মা, আমি সুমি বলছি। আমরা পৌঁছে গেছি, তুমি চিন্তা কর না, রনি সবসময় আমার সাথেই আছে” মা কে কথা গুলও বলে ফোনটা রেখে আবার রনজয় কে ফোন করল সুমি
- “হ্যালো রনি একটু আমার ঘরে আসবি”
- “কি হল?? কোন সমস্যা?’ জিজ্ঞেস করল রনি
- “না না তুই আয় না” বলে ফোনটা রেখে দিল সুমি।
আজ আর বারবার উঠে নিজের কাজ করার ক্ষমতা নেই সুমির, দুটো পা-ই অসাড়, আর সেই জন্যই আসা চেন্নাইতে, কত না কষ্ট করেই রনজয় ওকে নিয়ে এসেচে চেন্নাইতে, বাবা চলে যাওয়ার পরই এই আক্সিডেন্ট সুমির, বুড়ী মায়ের পক্ষে হাই সুগার নিয়ে আর কতটাই বা করা সম্ভব, আর দিদিও যে করবে নিজে দেখে বিয়ে করা বখাটে জামাইবাবুর চটে সেটুকু ও উপায় নেই। ভাগ্যিস সেদিন রনির সাথে বন্ধুত্বটা ছিল, হসপিটাল থেকে শুরু করে চেন্নাইতে যোগাযোগ সবই তো ওই করেছে, কলেজ ছারার পরে তো সব বন্ধুরাই নিজের নিজের রাস্তায় চলে গেছে, রনিও যাবে একদিন যেদিন ওর মা ও ওর জন্য উপজুক্ত কাউকে খুঁজে পাবে, স্বাভাবিক এরকম একটা পঙ্গু মেয়ের সাথে তো রনির বিয়ে হতে পারে না। এসব কথাই ভাবছিল সুমি,হঠাত ই রনির আওয়াজে সম্বিত ফিরল সুমির
-“কি রে ডাকছিলিস?” জিজ্ঞেস করল রনি
-“ না মানে, তুই কি ব্যাস্ত ছিলিস দেন তুই তোর কাজ শেষ করে আয়” শান্তভাবে বলল সুমি
-“আরে না রে, বল কি বলছিলিস, ওষুধ গুলো দিয়ে গেলাম খেয়েছিলিস?” জিজ্ঞেস করল রনি
-“হ্যাঁ, কাল কখন যাবরে আমরা?”
-“ সকাল ৯ টায় আছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, মোটামুটি ৭ঃ৩০টা নাগাদ বেরবো, তুই চিন্তা করিস না আমি ডেকে দেব আর এখানে বলা আছে সকালে ম্যানেজার একটি মেয়ে পাঠিয়ে দেবে যে তোকে রেডি হতে হেল্প করবে”
-“ওরা আমাকে কাল-ই আডমিট করে নেবে রে?”
-“হ্যাঁ সেরকমই তো বলল, পরসু ও. টি., নিউরো সার্জারি তো দেরি না করাই ভালো, চল তুই এবার ঘুমিয়ে পর, কাল সকাল সকাল ফোন করব উঠে যাস” বলে ঘরের আলো টা নিভিয়ে বেরিয়ে গেল রনি।
হাই!!! আমি সুমিই,উঁহু!! এটা মোটেই আমার ভাল নাম নয়, আমি সমাদৃতা, সমাদৃতা গাঙ্গুলী, বি.কম. ফাইনাল ইয়ার ফিনান্স অনার্স শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ মানে সাউথ সিটি মর্নিং, ইচ্ছে এম.বি.এ. করার কোন ভাল কলেজ থেকে।বাবার উপর মা লক্ষ্মী একটু বেশীই দয়াশীল, আর মা সেই লক্ষ্মীর সেবিকা মানে গ্রামের মেয়ে তো পুরদস্তুর হাউস-ওয়াইফ। প্রেম এ হাল্কা অ্যালার্জি আছে তাই প্রেম করিনা, তবে আমার একটা দিদি আছে হেব্বি প্রেম-কুটে, যেমন ঝগড়াকুটে হয় না যারা শুধু ঝগড়া করে, আর আমার দিদি শুধু প্রেম করে, কোনটাই টেকে না। তোমার সাথে প্রেমটা বোধ হয় আর হল না গো, বন্ধু হতে পারো, তবে নিজের রিস্কে” রণজয়ের উদ্দেশ্যে এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ক্লাসে ঢুকে গেছিল সুমি। অনেক দিন ধরে এতো চেস্টা করেও কিছু সুমিকে রাজী করাতে পারিনি রনজয়।কিন্তু তাই বলে ওই দিন টাকেও নিজের মন থেকে ডিলিট করতে পারেনি সে। তবে আর কোনদিন খুজেও পাইনি সে সেই সুমিকে। সেদিনের রনজয় আজ ডাঃ রনজয় হয়ে গেলেও সেদিনের মতো আজও ঠিক ততটাই ভালবাসে সে সুমিকে, তাই এতো ঝড় ঝাপ্টার পরেও বন্ধুত্বের নামে নিজের ভালবাসাকে আগলে রেখেছে ও।
নিজের ঘরে ঢুকেই নিজের ডাইরি নিয়ে বসে গেল রনি, সেই ৭ বছর আগের ডেট, সুমিকে প্রথম দেখার অনুভুতি, সেই নীল সালোয়ার, সাদা ওড়না, সেই হাসি, বিয়ে বাড়ীটায় ও ই যেন ছিল দেখার মতো কিছু, কিম্বা ও ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না রনি। আলাপ করার জন্য কি না করছিল সেদিন, কিন্তু ফলপ্রদ কিছুই হয়নি, প্রথমে বাসস্টপ আর শেষ অবধি কলেজেও চলে গেছিল রনি, তবে সেদিনের সেই লম্বা বক্তৃতার পরে আর কোনদিন নিজের অনুভুতির কথা জানাই নি ও । ডায়রির পুরনো লেখা গুলো পরতে পরতে ঘুম পাচ্ছিল ওর, সারাদিনের ধকলের পর কান্তি নেমে এসেছিল খুব শীঘ্রই তাই, বিছানায় উঠে আলো নিভিয়ে ঘুমতে গেল রনি।
রনির সংগ টা সত্যিই আজকাল খুব প্রিয় সুমির কাছে, অথচ এই রনিকেই কতো কথা না শুনিয়েছে সে। সেদিন বিয়ে বাড়ীতে রনিকে ভালভাবে নটিশ ই করেনি সুমি, মে বি নোটিস করার মতো কিছু ছিল না সেদিন ওর মধ্যে। কিন্তু ওই ছেলেটাই যে এত কাছের একটা বন্ধু হয়ে যাবে সেটা তো সত্যিই অসম্ভবের থেকে কিছু কম না। বাসস্টপ থেকে কলেজ অবধি এসে গেছিল ছেলেটা, হয়ত আজ রনি শুধু বন্ধুই নয় একটু বেশী ে হয়ে গেছে বন্ধুর থেকে। জীবনের প্রতিটা খারাপ সময়ে পেয়েছে ও রনিকে, অথচ যেদিন ও ফার্স্টক্লাস পেয়ে পাশ করল সেদিনই আসল না রনি,সেদিন ই ওর যত কাজ, কত ঝগড়াই না করেছিল সেদিন, উত্তরে সেই হাসিটা ছাড়া একটা শব্দ ও এক্সট্রা পাইনি সুমি।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে এসব কথাই ভাবছিল সুমি, কিম্বা হয়ত মিস করছিল এমনি ভাবেই। তবে একটা কথা কদিন ধরেই মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল ওর , বিশেষত অ্যাক্সিডেন্টটার পর থেকে ও যেন একটু বেশী ই নিরভরশীল হয়ে পরেছে রনির উপর, এভাবে চলাটা ঠিক নয় সে আর রনির দয়ায় বাঁচতে পারে না, রনির ও একটা জীবন আছে, যতই ওদের পরিবারের সাথে বাবার চেনা থাকুক না কেন, এটা ঠিক হচ্ছে না, তাই মনে মনে সে ঠিক করল যে ও রনি কে কাল-ই বলে দেবে যে কলকাতায় ফিরে সে যেন আর যোগাযোগ না রাখে, এই বন্ধুত্ব টাও শেষ হওয়া উচিত, আর দয়ার পাত্রী সে কোনমতেই হবে না।
সকাল সকাল রেডী হয়ে বেরিয়ে পরল ওরা হস্পিটালের উদ্দেশ্যে। আজ ওকে বলতেই হবে , কাল ওপারেশান হবে, আর সময় নষ্ট করা যাবে না বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে এই সবই ভাবছিল সুমি,
-“কি রে কিছু বলবি?” রনির ডাকে চমকে ঊঠল সুমি, “কিছু না” বলেই আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল ও। সত্যি কিভাবে যে বুঝতে পারে রনি এই না বলা কথা গুলো আজও অজানা সুমির। হসপিটালে এসে রিসেপ্সানের কাছে সুমিকে বসিয়ে ফরম্যালিটিস গুলো করতে গেল রনি।
রনি ফিরে এলেই কথা গুলো বল্বেই, মনে মনে ঠিক করে রাখল সুমি, আর বেশী দেরি করা ঠিক হবে না।
“চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে জাবেরে” আবারও রনির ডাকে চমকে উঠল সুমি,
- “চল এবার কেবিনে নিয়ে যাবে তোকে, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি”- কথাগুলো রোবটের মতো শুনে নিল সুমি, কিন্তু মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হল না। কেবিনে গিয়েও কেমন যেন অস্থিরতা কাটছিল না কিছুতেই, বারবার রনিকে ফোন করেও কেটে দিচ্ছিল বারবার, সুমির টেন্সন হচ্ছিল তবে অপারেশন নিয়ে নয়, অজানা একটা ভয়, হারিয়ে যাওয়ার বা হারিয়ে ফেলার।
এর মধ্যে কখন যে রনি এসে ডাক্তারের সাথে কথা বলছে খেয়াল ই করেনি সুমি।
-“is everything alright Ms. Ganguly?” ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন সুমিকে
- “yes doctor, i’m ok” বলল সুমি
-“রনি তোর সাথে একটু কথা ছিল, সময় করে একটু বসিস” মনে সাহস নিয়ে বলেই ফেলল সুমি।
-“ দাঁরা স্যারের সাথে কথা বলে আসছি” বলে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল রনি।
সেই যে গেল সন্ধ্যে হয়ে গেল তবুও নাম নেই রনির, সারাদিন যে কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারলনা সুমি, লাঞ্চ টাও নইব নইব চ। ঠিক আটটার সময় এল রনি, “সব কথা গেছে ডাক্তারের সাথে, কাল ৮ টায় ঢোকাবে ও. টি. তে”
-“তুই লাঞ্চ করেছিস” রনির কথাটার গুরুত্ব না দিয়েই জিজ্ঞেস করল সুমি
-“ ও হ্যাঁ.. করেছি। তুই কি যেন একটা বলবি বললি” জিজ্ঞেস করল রনি
-“কিছু না” বলেই শেষ করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার পরেই বলল “ তুই কাল থাকবি তো বাইরে”
-“ ইচ্ছে তো আছে তারপর দেখি, একটা জায়গায় যাওয়ার ও ছিল এতক্ষন একা একা বাইরে কি আর করব” বলল রনি
-“ও!!” বলে চুপ করে রইল সুমি, আর একটা শব্দ ও বেরল না তারপর, না সে বলতে পারল সেই সব কথা গুলো। এ রনি কে সে আগে যেন দেখেনি কোনদিন, তাহলে কি যা এতদিন ভাবছিল সেটাই সত্যি, রনির কাছে কি সে সত্যি ই দয়ার পাত্রী, এসব কথা গুলো মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল সুমির রাগে, দুঃখে দুচোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল ওর।
-“আরে টেনশন করিস না, কাঁদিস না সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি তো বলছি, এদের সাক্সেস রেট খুব ভালো আমি তো বলছি, চল তুই শুয়ে পর আমি যাই কিছু কাজ আছে” বলল রনি
-“ না আমি ঠিক আছি, তুই যা কাল পারলে দেখা করিস” কথা টা বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল সুমি, জাতে ওর চোখের জল টা আবার ধরা না পরে যায়।
-“চল গুড নাইট” বলে বেরিয়ে গেল রনি
মনের মধ্যে একরাশ রাগ আর দুঃখ দুচোখ দিয়ে গড়াতে লাগল সুমির, আজ তার কাছে দুটো জিনিস জলের মতো পরিস্কার এক, রনির ভালবাসা হয়ত আজ দয়ার রুপ নিয়েছে আর দুই, সবচেয়ে কঠিন একটা সত্যি কথা যে সে আজ রনিকে হয়ত রনির চেয়েও বেশী ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু এটাও ঠিক কাল অপারেসনের আগে সে কথা টা বলবেই রনিকে।
আজ খুব ভোর ভোর ই ঘুম টা ভেঙ্গে গেছিল সুমির, আজই শেষ হবে তার ভালবাসার আর আজ এ শুরু হবে তার আবার নতুন যাত্রা যদি ও. টি. টা সাক্সেসফুল হয়।সব কিছু রেডি হওয়ার পরেও দেখা নেই আজ রনির, এরকম টা ও কিভাবে করতে পারে, না না আর নয়, কলকাতায় ফিরে নিজেই রাখবেনা কোন সম্পর্ক রনির সাথে । রনিকে না দেখতে পেয়ে বাধ্য হয়েই নার্সের সাথে ও.টি. তে গেল সুমি।
ও. টি. টেবিলে উঠেও ওর তত ভয় করছে না যতটা কষ্ট ওর রনিকে না দেখে হচ্ছে, হঠাতি খেয়াল হল ৮ঃ৩০ বাজতে চলল শুরু তো হল না , আনাস্থেসিয়া ই দেয়নি। নার্সকে জিজ্ঞেস করলে বলল ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। এমন সময় ই ডাক্তারেরা ঢুকলেন ও. টি. তে, কোন কিছু না ভেবেই চোখ বুজল সুমি, কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হবে অপারেশন।
-“কি রে ভয় করছে?” চেনা গলায় চোখ খুলল সুমি
-“তুই এখানে কি করছিস” রনিকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সুমি
-“একটু থাম, এটা ও.টি.” চারদিকে তাকিয়ে সুমির উদ্দেশ্যে বলল রনি
-“আমার স্পেশালাইজেশন কিসে” হেসে জিজ্ঞেস করল সুমিকে
-“ এন. এস.”
-“মানে নিউরো সার্জারি, আর ইনি আমার স্যার ডাঃ সায়ন্তন ভট্টাচার্য যে তোর ও. টি. করবে, আর আমি একটু হেল্প” হাঁসতে হাঁসতে বলল রনি
-“তোমার বন্ধু শুধু কাল থেকে পড়াশুনাই করছে তোমার জন্য দেখ, ক্লাসে এত পড়ত না” হেন্সে বললেন ডাক্তার
আবারও আঝরে চোখ থেকে জল ঝরতে লাগল সুমির, কিছু বলার আগেই রনি বলে উঠল
-“কান্নাটা প্লিজ থামা নাহলে ও. টি. করা যাবে না”
-“তুই আমার কাছে সব সময় এভাবে থাকবি তো রনি” কাঁদতে কাঁদতে বলল সুমি
-“থাকব, প্রমিস!!, এবার থাম প্লিজ”
-“ঠিক আছে, শোন না একটা কথা ছিল” একটু থেমে বলল সুমি
-“বল” হাতে গ্লভস গুলো ঠিক করতে করতে বলল রনি
-“ বিয়ে করবি??”
-“কাকে?”
নিজের কাজ করতে করতে বলছিল রনি,
-“যার জন্য ওয়েট করেছিলিস ৭ টা বছর”
রনি নিরুত্তর ভাবে টেবিলের সব জিনিস রেডি করতে লাগল, কেউ বুঝতেও পারছিল না কি হচ্ছিল স্বাভাবিক ওখানে কেউ তো বাংলা বঝেও না শুধু মাত্র সিনিয়র ডাঃ সায়ন্তন ভট্টাচার্য ছাড়া, উনি বুঝেও যেন কিছুই বুঝছিলেন না।
-“ কি রে বল???” জোরে বলে উঠল সুমি
-“দাঁড়া দাঁড়া কাজ করতে দে , ও. টি. টা শেষ করেই ম্যারেজ রেজিস্রটার খুঁজতে হবে, সাত বছরের অপেক্ষা দেরি করা যাবে না” বলেই হেসে উঠল রনি।
-“ নে নে ঠিক ঠাক ও. টি. টা কর না হলে সারাজীবন বউকে হুইল চেয়ারে নিয়ে ঘুরতে হবে” হান্সতে হাঁসতে বলল সুমি।
- “তা আমি মরে গেলেও হতে দিচ্ছিনা মিসেস রনজয় চ্যাটারজী”