টপিকঃ প্রস্টিটিউট

"-দু হাজার কেন ?তিন  হাজার টাকায় কথা হয়েছিল "
চমকে উঠলো সায়নি ট্যাক্সির ভেতর থেকে কথাটা শুনে।বাইরে তাকিয়ে দেখলো আবছা অন্ধকারে মা আর এক অচেনা পুরুষ হেঁটে আসছে সামনের আলো আঁধারি হোটেল থেকে তার ট্যাক্সির দিকে ,নাঃ সে ঠিকই চিনেছে -তার মা ই ।   তার কানে আসলো পুরুষ কন্ঠ , "হোটেল ভাড়া আমাকে বারশো  টাকা দিতে হয়েছে । আমি তো তবুও আঠারোশ না দিয়ে পুরো দু হাজার দিয়েছি । "
-"আমি আগেই বলেছিলাম আপনাকে হোটেল ভাড়া আলাদা । "
দুটো মানুষ ধীরে ধীরে ট্যাক্সি টা অতিক্রম করে রাস্তার ওদিকে এগিয়ে গেল । মাথা ঝমঝম করতে লাগলো , দলা পাকিয়ে ভিতর থেকে বমি বেরিয়ে আসতে চাইল , কোনভাবে আটকালো সায়নি । মা  একজন প্রস্টিটিউট ?আবার ভালোকরে নিজের চোখের উপর অজস্র রাগ ধরলো । তাহলে এতদিন যে মা বলে এসেছে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে গ্রুপ ডি পোস্টে জব করে ! আজ এতগুলো বছর ধরে মা তাহলে মিথ্যে বলেছে ! নির্ঘাত ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি টা না থামালে এই নির্মম সত্যি টা হয়তো কোনদিন জানতে পারতো না সায়নি । জায়গা টা গিরিশ পার্ক মেট্রো , এই দিক টা বেশ আলো আঁধারি , স্ট্রিট লাইট জ্বলেনি , তাই বেশ আবছা , বামদিকে তাকিয়ে দেখলো একটা হোটেল নাম ব্লু -মুন । এখান থেকেই মা কে বেরিয়ে আসতে দেখেছে সাথে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক । সামনের টা টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বলছে , কিছু জন ঢুকছে বেরোচ্ছে । তাহলে এতদিন ধরে অজস্র মানুষ তার বাবার জায়গায় বসে মায়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে । ড্রাইভার এসে বললো , "দিদি চলুন , গাড়ি ঠিক হয়েগেছে । "
গাড়ি স্টার্ট দিল । সায়নি হাতে ধরা প্ল্যাস্টিক প্যাকেট টা ছুঁড়ে দিল বাইরে ড্রাইভারের অজান্তে । প্যাকেটে একটা শাড়ি ছিল মায়ের জন্য । আজ ইন্টারভিউ তে সিলেক্টেড হয়েই একটা শাড়ি মায়ের জন্য আর নিজের জন্য একটা ব্ল্যাক জিন্স কিনেছিল ।
বাবা কে সায়নির মনে নেই , যখন সে খুব ছোট ছিল সে সময় একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় । সল্টলেকের নিজস্ব ফ্ল্যাটে মা মেয়ের সংসার । যদিও কোনদিন কোনকিছুর অভাব তার হয়নি , কিন্তু সে অনুভব করছিল মায়ের সংসার চালাতে যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে । সামান্য গ্রুপ ডি চাকরি করে অভিজাত এলাকায় সংসার চালানো সাথে মেয়ের পড়াশোনা অসুখ বিসুখ যথেষ্ট কঠিন । তাই ফাইন্যাল ইয়ারের এক্সাম হয়ে যাওয়ার পরই সায়নি কাজের খোঁজে নেমে পড়ে । নিয়মিত অ্যাপ্লিকেশন করতো বিভিন্ন কোম্পানিতে -গত ছয় মাসের প্রচেষ্টায় আজ সিলেক্টেড হয়েছে একটা নামি কোম্পানির রিসেপশনিস্ট হিসাবে । মা কে ফোন করে জানায়নি । ইচ্ছে ছিল একদম বাড়িতে গিয়ে খুশির খবর টা দেবে । তাই নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে তিন হাজার টাকা তুলে মায়ের জন্য শাড়ি আর নিজের জন্য জিন্স কিনে রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে আনন্দে বাড়ি ফিরছে । নির্ঘাত ক্যাব টা থেকে একটা জোরে আওয়াজ শুনতে পেয়ে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ছিল ড্রাইভার,  তাই একটা অকথিত কাহিনী আজ জানতে পারলো ।

সায়নি বাড়ি ফিরে একটা ব্যাগে অল্প কিছু গোছগাছ করে বেরিয়ে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো , কিছু পরে শর্মিলা হাজির হলো । মেয়েকে দেখে একটু হেসে বললো , "পূজার আগে অনেক অর্ডার , খুব কাজের চাপ অফিসে তাই দেরি হয়ে গেল । "
সায়নি যেন সবকিছু সাজিয়ে রেখেছিল , "কতজনের অর্ডার নিয়েছ তুমি ?কতজন কে খুশি করতে হবে পূজার আগে ?"
শর্মিলা চমকে উঠলো , সায়নি ব্যাপারটা আন্দাজ করে বললো , "আমি আজ তোমাকে গিরিশ পার্কে দেখেছি , আর মিথ্যে বলে লাভ নেই । এমনকি তিন হাজার টাকার কথা হয়েও দু হাজার টাকা পেয়েছ । আমার ভাবতে ঘেন্না লাগছে যে বাবার জায়গায় অজস্র পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছ । "
অকস্মাৎ আক্রমনে দিশেহারা শর্মিলা দেখলো এতদিনের রূঢ় সত্য টা হঠাৎ করে দাউদাউ করে জ্বলছে । নিজের মেয়ের সামনেই সে আজ অপরাধী । লজ্জায় মুখ টা লাল হয়ে উঠলো -নিজেকে নিয়ে মাটির সাথে মিশে যেতে লাগলো, নিজেকে শক্ত করে বললো , "এছাড়া আমার কিছু করার ছিলনা মা । তোর বাবা যখন মারা যায় তখন সদ্য এই ফ্ল্যাট টা কেনা হয়েছে অনেক কিস্তি বাকি তখনও । ইউনিয়নের দাদা দের ধরে অনেক চেষ্টা করেছিলাম তোর বাবার চাকরি টা পাওয়ার , কিন্তু মাঝখানে আমার যা কিছু সঞ্চয় ছিল ওদের পকেটে গেল , চাকরি পেলাম না দিনের পর দিন ঘুরে শুধু প্রতিশ্রুতি ছাড়া । এই সল্টলেকের মতো জায়গায় স্ট্যাটাস বজায় রাখা , তোর পড়াশোনা , সংসার চালানো সবকিছু তে অন্ধকার দেখেছিলাম , মা আমাকে তুই ক্ষমা করে দে , যা করেছি তোর জন্য করেছি  । "
সায়নি ক্রুদ্ধ সাপের মতো ফোঁস করে বলে উঠলো , "আমি তো  এতকিছু চাইনি । পড়াশোনা না করিয়ে যদি কারুর বাড়িতে বাসন কোসন মাজতে ও রেখে দিতে তাহলে ও অন্তত শান্তি পেতাম এই ভেবে যে আমার মা একজন ভদ্র মহিলা । প্রস্টিটিউট না । "
-"কিসের প্রস্টিটিউট?"
প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিয়ে শর্মিলা কয়েক মিনিট থামলো , তারপর বললো , "আমি কোন অন্যায় করিনি , চুরি -ছিনতাই -খুন -প্রতারনা করিনি । নিজের শরীর বেচে নিজে বেঁচেছি তোমাকে বড় করেছি , উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছি । কোন অভাব রাখিনি তোর  । যখন যা চেয়েছিস সব দিয়েছি । আর আজ বলছিস তোর কিছু চাইনা , কিন্তু একদিন তুই ও আমাকে প্রশ্ন করতিস যদি সঠিক ভাবে মানুষ না করতে পারবো তাহলে জন্ম দিয়েছি কেন ?"
-সায়নি ঠান্ডা মাথায় সব শুনে তারপর বললো ,"তোমার কোন যুক্তিই চলবেনা । আমি যাচ্ছি , তোমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চাইনা। "
ভাঙ্গা কলাগাছের মতো শর্মিলা অনুভব করলো তার চারপাশের মাটি টা ক্রমশ সরে যাচ্ছে , হঠাৎ করে এমন হবে স্বপ্নেও ভাবেনি । যার জন্য নিজেকে শেষ করে দিয়েছে দিনের পর দিন বছরের পর বছরের পর আজ সেও ভুল বুঝে চলে যাচ্ছে । শেষ বারের মতো বলে উঠলো , "মা রাগ করে কোথাও যাসনে , এত রাতে কোথাও যাসনে ক্ষমা করে দে তুই ছাড়া কেউ নেই যে আমার -"
কথাগুলো বাতাসে ধাক্কা খেতে খেতে মিলিয়ে গেল , সায়নি ছোট্ট ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে ।

"এতরাতে ?কি ব্যাপার ?মাসিমার সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছিস ?"
মনীষার প্রশ্নে হতচকিত সায়নি কি উত্তর দেবে ভাবছে , তার আগেই মনীষা বললো
"ভালোই হয়েছে , তোকে এক্ষুনি কল করতাম । দাদাভাই বাড়ি এসেছে , কাল সবাই মা বাবা দাদা আমি দীঘা যাবো দুদিনের জন্য । তুইও চল "
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সায়নি । সেই ভালো । দীঘা গিয়ে কোন ফুরসৎ পেলে মনীষার সাথে আলোচনা করবে জানাবে । সেই স্কুল লাইফ থেকে সবচেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড মনীষা । অজস্রবার এদের বাড়িতে এসেছে থেকেছে । জেঠু জেঠিমা ও খুব স্নেহ করেন সায়নি কে । একরকম নিজের ঘরের মতোই । গত পরশু দিন রাতেই ফোনে মনীষা বলছিল তার দাদা ব্যাঙ্গালুরু থেকে আসবে । আজ সারাদিন ইন্টারভিউয়ের টেনশনে আর ফোন করা হয়নি । যাইহোক কাজ টা পেয়েছে সামনের সোমবার থেকে কাজে যোগ দেবে সায়নি , তারপর একটা মেস বাড়ি তে থেকে যাবে । এখনও অ্যাকাউন্টে হাজার দশেক টাকা আছে , এতেই মোটামুটি ম্যানেজ হয়ে যাবে । এই সব ভাবতে ভাবতেই মনীষার সাথে তার রুমে ঢুকে গেল । মনীষা বকবক করেই চলেছে সায়নি হুঁ হাঁ করছে কিন্তু কি শুনছে সেই জানে ।

তার পরদিন সবাই দীঘা চলে আসলো । সারা বিকেল সন্ধ্যে হইচই এর মাঝে সায়নি নিজেকে অনেকটা রিলাক্সড অনুভব করছে । মনীষার দাদা রাজিবের সাথে বেশ ভাব হয়েগেছে । অন্তত মনীষাe সুযোগ গুলো তৈরি করে দিচ্ছে । মনীষা যে সায়নি কে নিজের বৌদি হিসেবে প্রজেক্ট নিয়েছে সেটা সায়নি বেশ বুঝতে পারে ।
রাতের খাওয়া শেষ করে আড্ডা দিয়ে নিজের রুমে এসে ঘুমোতে যাবে কিন্তু ঘুম একটুও লাগছে না দেখে সে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো । এটা কোন হোটেল নয় , একটা গেস্ট হাউসের মতো । একদম সমুদ্রের তীর বরাবর । বেশ শীতল হাওয়া বইছে । বাইরে তাকালো সায়নি , হঠাৎ দেখলো এক মহিলা বিচের উপর বসে আছে , ঢেউ গুলো প্রায় পায়ের কাছে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে । জানালা থেকে আন্দাজ করলো প্রায় দূরত্ব একশ মিটার মিটার মতো হবে । মহিলাটি একবার উঠে সামনের দিকে এগিয়ে গেল ,প্রায় অনেক টা । সায়নি ভাবলো মেয়েটি কি আত্মহত্যা করবে ?বিচে টহল দেওয়া পুলিশের চোখে পড়েনি ?ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছেনা মেয়েটার বয়স , তবে মেয়ে মানুষ এটা একদম নিশ্চিত । যাইহোক মেয়েমানুষটি  উদভ্রান্ত -সেটা তার হাঁটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে । প্রায় হাঁটু সমান জলে দাঁড়িয়ে আছে । সে চিৎকার করে জানালা দিয়ে ডাকলো কিন্তু ঢেউয়ের গর্জনে সে ডাক পৌঁছালো না । মেয়েটি দাঁড়িয়েই আছে । তাকে যেকরে হোক বাঁচাতে হবে , কি করে ! জেঠু জেঠিমা রাজীব কে কি ডাকবে ?না , ওরা হয়তো পাগলামি ভাববে। হয়তো গিয়ে দেখবে এমনি রাতে কোন পর্যটক বসে সমুদ্রের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছে । তাহলে লজ্জায় পড়ে যাবে । সে দেখলো পিছন ফিরে মনীষা অঘোরে ঘুমোচ্ছে । মনীষা কে ডাকলে কেমন হয় ?ঘড়ি দেখলো প্রায় রাত দুটো বাজে । না এখন এতরাতে একা যাওয়া ঠিক হবেনা । সে কাছে মনিষাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকলো , "মনীষা , মনীষা ! "
মনীষা ঘুমের ঘোরে উহুঁ করে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো । সে জানালার পাশে এসে দেখলো ভদ্রমহিলা বা মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে । না ! এইভাবে কোন ট্যুরিস্ট মাঝরাতে বিচে থাকেনা , হয় পাগল নাহলে আত্মহত্যা করতে এসেছে । সে তাড়াতাড়ি টর্চ টা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ।

নিচে নেমে দেখলো গেটকিপার কাম কেয়ারটেকার চেয়ারে বসে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে । আস্তে করে গেট টা খুলে দক্ষিন দিকে ঘুরতেই মহিলা কে দেখতে পেল । চারদিকে বেশ আলো । বীচ বরাবর লাইট দেওয়া । সে এগিয়ে গেল । কাছাকাছি যেতেই সে বুঝতে পারলো মহিলাটি  আগের থেকে অনেকটা পিছিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে । পিছন ফিরে দেখলো বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার দোতলার রুম টা। সায়নির পায়ের শব্দে ভদ্র মহিলা মুখ ফিরে তাকালো ।
সায়নি সরাসরি জিজ্ঞেস করলো , "আপনি কেন এমন করছেন ?কতবার ডেকেছি আপনি শুনতে পাননি ।? "
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন , সায়নি দেখে আন্দাজ করলো  ভদ্রমহিলার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ -বাহান্ন  হবে , তার মায়ের চেয়ে বেশ  কিছু টা বড় হবেন সম্ভবত ।
সায়নি বললো , "আমি অনেক ক্ষন ধরে লক্ষ করছি আপনি একবার সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন একবার ফিরে আসছেন । আপনি কি সুইসাইড করতে চান ?জানেন পুলিশ এতরাতে আপনাকে এভাবে দেখলে ডাইরেক্ট লকআপে ঢোকাবে । "
ভদ্র মহিলা ম্লান হেসে বললেন ," পুলিশ ধরলেই বা কি আর না ধরলেই বা কি ?মরতে তো এসেছিলাম কিন্তু পারছি কই । নাতি তার মুখ খুব মনে পড়ছে । "
সায়নি আন্দাজ করলো ছেলে বৌয়ের অত্যাচারে ভদ্রমহিলা আত্নহত্যা করতে চান ।
সায়নি বললো , "যত কষ্টই হোক কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ । আমিও আপনার মেয়ের মতোই । প্লিজ এমন করবেন না। "
ভদ্রমহিলার চোখ ছলছল করে উঠলো , সাগরের অতল জল রাশির দিকে চেয়ে বললেন , "জানো মা ! একজন মেয়ে কে কত কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয় , নিজে না খেয়ে সন্তান কে বড় করতে হয় , সেই সন্তান যখন বড় হয়ে নিজের মা কে দু মুঠো খেতে না দিয়ে আগুনের ছেঁকা দিয়ে মারে , ছোট নাতিটার সাথে একটু কথা বলতে ও দেয়না তখন সে যন্ত্রনা মৃত্যুর চেয়েও কঠিন । তার চেয়ে সহজ মরে যাওয়া । "
সায়নি বুঝতে পারলো মহিলার অসহায় অবস্থা । ভদ্র মহিলা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন , "আমার স্বামী টা খুব ভালোবাসতো আমাকে । সামান্য জমি আর কায়িক পরিশ্রমে দিন ভালোই চলতো । তারপর একদিন প্যারালাইসিস এ পড়লো স্বামী , ছেলেটা দুধের বাচ্চা । সেইসব দিনের কথা কেউ জানেনা । তারপর স্বামীও বেশ কয়েক বছর শয্যাশায়ী থেকে আমাকে একা রেখে চলে গেল । ছেলেটা কে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করলাম , ছেলে চাকরি পেয়ে বিয়ে করলো । আজ সেই ছেলেই দুটো খেতে দেয়না , শেষ সম্বল গয়না গুলো ও ছাড়িয়ে দিয়েছে । কিছু বললে স্বামী স্ত্রী দুজনে মারে চেলা কাঠ দিয়ে । আজকেও মেরেছে দেখো জ্বলন্ত কাঠের ছেঁকা দিয়ে । "
এই বলে ভদ্রমহিলা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন , পিঠের কাপড় সরিয়ে । সেই কান্নার রেশ আর সমুদ্রের গর্জন এক হয়ে গেল ।
সায়নি চুপচাপ শুনছে ।
মহিলা হঠাৎ বললেন , "এই যে হোটেল গুলো , রাতের পর রাত দিনের পর দিন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি শহুরে বাবুদের কাছে । নিজের স্বামীর চিকিৎসা করাতে সন্তান কে ভালোভাবে মানুষ করতে অজস্র মানুষের কাছে আমার শরীর বিক্রি করেছি । সেই যন্ত্রনা তো সন্তান কোনদিন জানতে পারবে না "-
চমকে উঠেছিল সায়নি -তৎক্ষনাৎ মায়ের মুখ টা ভেসে উঠেছিল । মায়ের মনের অজস্র যন্ত্রনার কথা ভেসে উঠছিল তার মনে। নিজের বিবেকের কাছে সেই মুহূর্তে ছোট হয়ে গেছিল , মনে পড়ছিল মায়ের শেষ কথা গুলো , "চুরি -ছিনতাই -প্রতারনা -খুন করিনি , নিজের শরীরের বিনিময়ে বেঁচেছি তোকে বড় করেছি মানুষ করেছি । "
অনেক রাত হয়ে গেছিল । সায়নি বললো , "চলুন হোটেলে ।আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমার সাথে কলকাতা চলুন । "

রাতে হোটেলে ফিরেই তার শুধু ইচ্ছে করছিল কাঁদতে , মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে । পুরো দুদিন কথা হয়নি । রাগে ঘেন্নায় যে মায়ের উপর অজস্র অভিযোগ জানিয়ে বাড়ি ফিরেছিল , রাতের ঘটনার পর সেই রাগ অভিমান ঘৃনা সরে গিয়ে মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিল । দুদিন ফোন সুইচ অফ রেখেছিল , হোটেলে ফিরে প্রথমেই ফোন অন করতেই মায়ের অজস্র মিসডকল অ্যালার্ট দেখেছিল মেসেজ বক্সে । সত্যি একটা মেয়েকে বাঁচার জন্য কত যুদ্ধ করতে হয় । নিজের উপর রাগ হচ্ছিল মায়ের সাথে এইভাবে বাজে ভাষায় কথা বলার জন্য । সঙ্গে সঙ্গে  ফোন করলো মায়ের নম্বরে , ফোন সুইচড অফ । মা তো কখনও ফোন অফ রাখেনা ! তাহলে কি শরীর খারাপ । হঠাৎ নজর পড়লো মেসেজ বক্সে অজানা একটা নম্বর থেকে মিসড কল অ্যালার্ট এর মেসেজ পেয়ে । অচেনা নম্বরে ফোন করতে অনেক ক্ষন রিং হবার পর ফোন টা রিসিভ হতেই বুঝতে পারলো উপর তলার সান্যাল কাকুর ফোন । সান্যাল কাকু শুধু বলেছিলেন শর্মিলা বৌদি খুব অসুস্থ , তাড়াতাড়ি আসতে । কিভাবে যে রাত টা কেটেছে কে জানে ভোর হতেই রাজীব কে ধরে হাওড়া গামী এক্সপ্রেসে উঠেছে । অবশ্য আসার আগে সেই ভদ্রমহিলা কে মনীষার সাথে আলাপ করিয়ে কিছু টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে তার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়ে এসেছিল । ট্যাক্সি টা করুনাময়ী মোড় ক্রশ করলো । সায়নি ভাবছে সান্যাল কাকু তাকে হাসপাতালে না যেতে বলে বাড়ি তে আসতে বললেন কেন ?আসার সময় বারবার সান্যাল কাকুকে ফোন করেছে , সান্যাল কাকু বলেছেন তাকে যত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে । কিন্তু বাড়ি তে কেন ?সায়নি এইসব ভাবতে ! ভাবতেই দেখলো ট্যাক্সি টা তাদের তাদের আবাসনে ঢুকলো । সে নেমে তাড়াতাড়ি টাকা দিয়ে দৌড়ে গেল । আবাসনের বেশ কয়েকজন কে দেখলো তাদের বাড়ির সামনে । হালদার কাকু সায়নি কে দেখেই বললেন , "নিজেকে শক্ত করো মা "-
শক্ত ! কিসের শক্ত ?
সায়নি ঢুকে গেল , একতলা পেরিয়ে দোতলাতে এসেই বুঝলো যথেষ্ট ভিড় । বুল্টি বৌদি এসে সায়নির হাত ধরলো । সায়নি অবাক হয়ে ধীরে ধীরে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকলো । ঢোকার দরজা টা ভাঙ্গা -সায়নি বুঝতে পারলো সিরিয়াস কিছু ঘটেছে , অন্তত সবার মুখের অভিব্যক্তি তাই । সামনে বসার ঘরে একটা শয্যা পাতানো  , একটা সাদা কাপড় ঢাকা দেওয়া , সে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে , বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সাদা কাপড় টা তুললো । শান্ত সমাহিত এক মূর্তি শুয়ে অনন্ত কালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে , কানের কাছে সান্যাল কাকুর কথা গুলো আবছা ভাবে শুনতে পেল , "দুপুর পর্যন্ত কাল দরজা বন্ধ দেখে আমাদের সন্দেহ হয় , বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পরেও দরজা না খুলতে দরজা ভেঙ্গে সবাইকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখি সিলিং ফ্যান থেকে শাড়িতে প্যাঁচানো শরীর টা ঝুলছে --পুলিশে খবর দেওয়া হলো ----"
নাঃ । আর কিছু শুনতে পাচ্ছেনা সায়নি । অন্ধকার দেখছে দুচোখে , চারপাশের মাটি সরে গেছে , সে কাঁদার চেষ্টা করলো , কাঁদতে পারলো না -অব্যক্ত এক যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে অস্ফুটে মা বলে চিৎকার করে লুটিয়ে পড়লো লাশের উপর ।