টপিকঃ মানুষের এপিঠ ওপিঠ
ঘুম ভাঙল মায়ের মৃদু ঠেলায়, " ওঠ বাবা! রাহুল, সাড়ে আটটা বেজে গেছে।" ঘুমের ঘোরেও শুনে থতমত খেয়ে উঠে বসলাম। কিন্তু ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি সকাল ৭:০০ টা। উহ! আমার মা ও না সত্যি! বয়স বেড়েছে কিন্তু স্বভাব পালটায়নি। যাইহোক, আজ একটু তাড়াহুড়ো, নেহাত মায়ের ওপর বেশি রাগারাগি না করে চোখ ডলতে ডলতে কলপাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। আজ জে.জে.এন্টারপ্রাইজ এ আমার ইন্টারভিউ। সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভ এ কোম্পানির হেড অফিসে ১০:০০ টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। মি.ঢালি, অফিসের ম্যানেজার, আমার বড়োই চেনা।
৩৫ বছর বয়স হল, এখনও আমি বেকার। বাবা ছোট্ট একটা মুদির দোকান চালিয়ে কোনো মতে টেনেটুনে সংসারটার ভার বহন করে চলেছে। চিন্তায় চিন্তায় প্রেশার টা High হয়ে গেছে। সুগার ৩৫০ ছাড়িয়েছে। হাঁটুতে আর্থ্রাইটিস এর ব্যথা। বাবার যত চিন্তা আমাকে নিয়ে। আমার দ্বারা নাকি কিচ্ছু হবে না। আমি ও আজ দেখিয়ে দেব।
উহ! কেন যে এতোদিন মি. ঢালির কথা মনে পড়ে নি! তাহলে কবেই আমার একটা হিল্লে হয়ে যায়। নিজের ওপরই মাঝে মাঝে রাগ হয়!
। ছেলে হয়ে এখনো বাবা-মা কে রোজগার করে খাওয়াতে পারিনা। ভাবলেই নিজেকে অপদার্থ মনে হয়। চাকরিটা বেসরকারী হলেও বেশ ভরসাযোগ্য। আমার জন্য বেস্ট। মারকেটিং সুপার ভাইজার, ঢুকেই ২০,০০০ টাকা মাইনে। তারপর টুকটাক পুজো-টুজোর বোনাস। ৫ মাস পর প্রোমোশন। তারপর ম্যানেজারের সাথে আমার পরিচিতি। শীঘ্রই সুখের দিন আসতে চলেছে। মনের মধ্য দিয়ে এক আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল।
যাইহোক, মুখটুখ ধুয়ে আলমারি থেকে একটা ভাল টি-শার্ট বের করে পড়ে নিলাম। ঠিক তখনই মা খেতে ডাকল। গেলাম। একটা চেয়ারে বসলাম। প্লেটের দিকে তাকিয়ে এক মূহুর্তে যেন অন্য দুনিয়ায় পৌঁছে গেলাম। চেয়ে দেখি ভাতের সাথে ডাল আর পোস্তবড়া, অনি খুব পছন্দ করতো। অনির কথা বলাতে মনে পড়ে গেল, ১৯ বছর আগের ঘটনা।............
তখন আমি ক্লাস ইলেভেনে পড়ি।
প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে দেখেছিলাম সেকেন্ড বেঞ্চের কোণা ঘেঁষে একটি ছেলে, এক মনে অঙ্ক কষছিল। আগে কখনো তাকে দেখিনি, হয়ত নতুন ভরতি হয়েছে। ক্লাসে অঙ্কের স্যার ঢুকলেন। এসেই অঙ্কের প্রথম অধ্যায়টি খুলে একটা একটা করে অঙ্ক আমাদের বোঝাতে শুরু করলেন। তিনি একে একে সকলকেই অঙ্ক করতে বোর্ডে ডাকলেন। পালা এল সেই ছেলেটির। সে বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। স্যার ছেলেটিকে প্রশ্ন করলেন," নাম কি তোর?" সে উত্তর দিল," অনিরুদ্ধ......।" তিনি ছেলেটিকে একবার আপাদমস্তক চেয়ে দেখলেন, আগে কোন দিন দেখেননি বলেই হয়ত তার এমন আচরন লক্ষ্য করা গেল। ছেলেটির পায়ের ছেঁড়া চটিটির দিকে তাকাতে তার কপালের ভাঁজ গুলো আরো স্পষ্টতর হয়ে উঠতে দেখা গেল।
এরপর তিনি নাকশিঁটকে বিদ্রুপের সুরে বললেন, " এমন কুত্তায় খাওয়া চটি কোথায় পেলি রে ছোঁড়া?" ক্লাস শুদ্ধ ছেলে তো হেসেই গড়াগড়ি। খানিকক্ষণ পর স্যার বলে উঠলেন, " সাইলেন্স এভ্রিবডি......, নাও অঙ্কটা করে আমায় উদ্ধার কর।" সে চক টা হাতে তুলে নিয়ে বোর্ডে ঠেকাতেই অঙ্ক কমপ্লিট। স্যারের তো চক্ষুছানাবড়া। তিনি ছেলেটির পিঠ চাবড়ে বললেন, " বাহ! "
সেদিন থেকে ওর সাথে পরিচয় করার একটা তীব্র ইচ্ছে আমার মনে জেগেছিল। কিন্তু সাহস করে আর গিয়ে ওঠা হয়নি।
মাস দেড়েক পর একদিন শীতের সকালে স্টেশনের পাশে মর্নিংওয়ার্ক করতে গেছিলাম। চারিদিকে কুয়াশা। কিছুই ঠিকমতো দেখা যায়না। এদিক ওদিক দেখার উদ্দেশ্যে চেয়ে রয়েছি। হঠাৎ চোখে পড়ল.......... সেই ছেলেটি, অনিরুদ্ধ....... একা স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছে। আমি ছুটে তার দিকে গেলাম, আমার গায়ের জ্যাকেটটা ওর গায়ে পড়িয়ে দিলাম। ও তখন আমার দিকে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল। আমি প্রশ্ন করলাম, " কি রে এত ঠান্ডায় তুই এখানে?" সে বলল, "বাংলাদেশ থেকে এই দেশে একা এলাম পড়াশোনার জন্য। প্রথমে মামার বাড়িতে থাকছিলাম। কাল রাতে মামি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আর এদেশে চেনাশোনা বলতে কেউ নেই, কোথায় আর যাব! তাই এখানেই........
সে কথা শেষ করার আগেই আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। দেখলাম ওর চোখের কোণেও জলের ফোঁটা। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, " আজ থেকে তুই আমার ফ্রেন্ড, আর রইল পড়ে, থাকার জায়গার কথা? তুই আমাদের বাড়িতে থাকবি, আমার সাথে।" সেদিন ওকে আমাদের বাড়ি আনায়
আমার বাবা-মা দুজনের কেউই আপত্তি করেনি। দুজনেই চিরটা কাল চেয়ে আসছেন, আমি যেন মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াই।
তাই ওকে নিয়ে বাড়িতে একদমই অসুবিধা হয়নি। আমরা প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যেতাম, প্রাইভেটে যেতাম, একে অপরকে ছাড়া খেতাম না। আমার বাবা-মা ও ভাবতেন যেন আমরা দুজনেই তাঁদের নিজের ছেলে। দিন ডায়রির পাতার মতো বদলাতে থাকল। এসে গেল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। আমি বরাবর শেষ দিক কার ছাত্র। নেহাত পরীক্ষাও দিলাম মোটামুটি। দেখতে দেখতে চলে এল রেজাল্টের দিন। স্কুলে আমরা যখন এক সাথে রেজাল্ট আনতে যাওয়ার জন্য রওনা হব, আমার মা আমাদের দুজনের কপালেই দই এর ফোঁটা দিয়েদিলেন। ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে আমরা রওনা হলাম। আমি তো জানি যে, আমার মতো স্টুডেন্টের রেজাল্ট খুব জোড় ৬০% মতো হবে। হ্যাঁ আমার হিসাবে ভুল হয়নি। আমি ৬২% নাম্বার পেয়েছি। কিন্তু অনির রেজাল্ট কি হল? ওকে প্রশ্ন করলাম। ওর উত্তর শুনে আমার চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। ও ৯৪% নাম্বার পেয়েছে। গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠল। এর পর একে একে ও আরো কতগুলি পরীক্ষায় পাশ করে একটা ভাল চাকরী পেয়ে কলকাতা চলে গেল। তার পর ১২ টা বছর ওকে দেখিনি। জানিনা কেমন আছে?......
এ বাবা! আটটা বাজতে চলল কখন ইন্টারভিউ দিতে যাব!
তাড়াহুড়ো করে বেড়োতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম রকির সাথে। ও আমার বাড়িরই সদস্য। ও লেজ নাড়াতে নাড়াতে আমার কাছে এল। আমিও নীচু হয়ে ওর সামনে বসলাম। ওকেও দেখে বেশ খুশী খুশী মনে হচ্ছিল। আমি ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, " রকি, ৬ বছর আগে তোকে যেদিন আমাদের বাড়ি নিয়ে এলাম,সেদিন থেকে তুই আমাদের বাড়িরই সদসয, না তোকে কোনদিন কোনদিন ভালো জিনিস খাওয়াতে পেরেছি, আর না তোর কোনো শখ-আহ্লাদ পূরন করতে পেরেছি....., কিন্তু চিন্তা করিস না রে, আমাদের আর অভাব থাকবে না। আমি এবার সিওর চাকরী টা পেয়ে যাব। আজই আমি সেই সুখবর টা নিয়ে আসতে চলেছি। তোর এই করুন মুখটা যে আমি দেখতে পারিনা।" যেদিন ওকে প্রথম বাড়িতে এনেছিলাম........মানে ৬ বছর আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে.............
......সেদিন আমি ঈশানের বাড়ি থেকে ফিরছি। ঝমঝম বৃষ্টিতে চারিদিক থইথই। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য একটা পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ একটা মৃদু ঘেউ ঘেউ শব্দে পাশে তাকিয়ে দেখি একটা পিচবোর্ডের বাক্সের মধ্যে একটা ছোট্ট কুকুরের বাচ্ছা, আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। আমার বড় মায়া হলো। আমি তাকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে সোজা বাড়ি চলে এলাম। তারপর থেকে ও আমাদের বাড়িরই একজন।
যাইহোক, আমার লেট হয়ে যাচ্ছে। এবার রওনা হওয়া যাক। স্টেশন পর্যন্ত হেঁটেই গেলাম। ট্রেনে উঠে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। মি. ঢালি আমায় কিভাবে স্বাগত জানাবে, জড়িয়ে ধরে, নাকি হ্যান্ডসেক করে? আমাকে সত্যি কি ইন্টার্ভিউ দিতে হবে, নাকি ম্যানেজার কে আমার পরিচয় দিলেই আমাকে চাকরীটা দিয়ে দেবে? আমাকে প্রথমে চিনতে পারবে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি......
ভাবতে ভাবতে বিধাননগর স্টেশন এসে গেল। তারপর বাসে করে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে পোঁছালাম। অফিসের দিকেএকদৃষ্টিতে চেয়েরয়েছি। একজন গার্ড আমায় এক জায়গায় বসতে বলল। মি.ঢালি তখনো আসেননি। প্রায় তিন ঘন্টা পরে শুনলাম তিনি এসেছেন। আমার পালা এল। ম্যানেজারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলেই দেখি ঝাঁ-চকচকে এসি রুমে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে মি.ঢালি কতগুলো ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। আমি ঢুকতেই উনি আমর দিকে একবার আড় চোখে তাকালেন, তারপর বসতে বললেন। আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম, " চিনতে পারছেন?" উনি প্রথমে খানিক ভেবে পুনরায় কাজে মন দিয়ে বললেন, " হ্যাঁ, চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেন, কোথায় যেন দেখেছি?" আমি প্রথমে অবাক হলাম। পরে ভাবলাম, সত্যিই তো এতোদিন পর চেনার কথাও নয়। আমি উত্তর দিলাম, "আমি রাহুল চ্যাটার্জি।" উনি হাতের কাজ ফেলে একবার ভেবে বললেন," হ্যাঁ,চিনতে পেরেছি। বসুন।" বলে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। আমি বসে প্রশ্ন করলাম, " ভাল আছেন?" উনি একবার অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললেন," হুঁ।" আমি উনার কাছেও এই একই প্রশ্ন আশা করছিলাম। কয়েক মিনিট অপেক্ষাও করলাম। কিন্তু প্রশ্ন এল না। যাইহোক, উনি এত ব্যস্ত মানুষ, তাই আমি আবার কথা বলতে শুরু করলাম। বললাম, " কয়েক বছরর হল, সংসারে খুব টানাটানি চলছে, তাই একটা চাকরির উদ্দেশ্যে এখানে আসা...........
উনি একবার আমার দিকে মৃদুভাবে তাকালেন, তার পর বললেন, " থাক ও সব কথা পরে হবে। বায়োডাটা আর ডকুমেন্ট সব রেখে যান, আর পনেরো দিন পরে আবার আসুন। দেখছি ব্যপারটা।" তারপর বেল টিপে মুখে বললেন, "নেক্সট, অঞ্জন ঘটক।" আমি তো বুঝতেই পারিনি যে উনি আমায় যেতে বললেন, তাই আমি উনার সাথে আবার কথা বলতে শুরু করলাম," আপনি এখন কোথায় থাকেন?" উনি শান্ত ভাবে বললেন, "থাক, ওসব ব্যপারে পরে কথা হবে। আপনি দিন পনেরো পরে আসুন। নেক্সট।" আমি তাড়াতাড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। অফিস থেকে তখন বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছি, মনে খালি একটাই কথা, এবার চাকরিটা হয়েই গেল। আর অভাব থাকবেনা। বাড়ির সামনে এসে দেখি রকি বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে, যেটা ও রোজই করে। আমি দরজা খুলে ঢুকতেই ও আমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম," রকি, পনেরো দিনের মধ্যেই সুখবরর আসতে চলেছে। "
দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল। সেদিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠে রওনা হলাম। কিন্তু হায়! অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, যে, আমার বদলে, মি.ঢালি, অঞ্জন ঘটক কে ওই পোস্টে নিজে রেকমেন্ড করেছেন। কানাঘুষো শুনলাম মোটা টাকার খেলা-টেলাও নাকি চলেছে। আমার মাথায় তখন যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার মনে হল।
সেদিন স্টেশন থেকে হতাশ মনে বাড়ি ফিরছিলাম। বাড়ি পৌঁছে সামনে চেয়ে দেখি রকি আমার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়াচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে ও আজও আমাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে। ওর ওপর খুব করুনা হল, চোখে জল চলে এল। চোখ ডলতে ডলতে ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। জামাকাপড় ছেড়ে খাটে শুয়ে পড়লাম, মনে মনে ভাবলাম, উনি টাকার লোভে আমায় চাকরিটা দিলেন না। দুঃখে, অভিমানে চোখে জল চলে এল। ......।
তারপর ভাবলাম, আমি খুব বোকা। মি.ঢালি নামী-দামী মানুষ। ওনার জীবনে আমার থেকে টাকার দাম তো বেশী হবেই। আমার আশা করাটা হয়ত উচিৎ হয়নি।
পাঠকবর্গের নিশ্চয় মনে হচ্ছে যে আমি কেন এতটা আশা করেছিলাম। করতাম না, যদি মি.ঢালি, অনিরুদ্ধ না হত!