টপিকঃ তিস্তা এক প্রবাহিণী

পর্ব -১

নবীনবরনের অনুষ্ঠান তখনও শেষ হয়নি,হঠাৎ কালো মেঘ ঘনিয়ে এল আর তার একটু পরেই প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হল। যে যতটা সম্ভব মাথা বাঁচিয়ে হল ঘরের দিকে দৌড়াল। ঝড়ের দাপটে প্যান্ডেলে বাঁধা কাপড় গুলো ছিঁড়ে ফেটে যেদিকে পারল বাঁধন হারা হয়ে উড়তে লাগল। মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ড ও আরো কিসব জিনিসপত্র নিয়ে সৌগতও মাথা বাঁচাতে ছুটে যাচ্ছিল হল ঘরের দিকে। আচমকা হোঁচট খেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ল সে। পেছন থেকে আগত ছাত্রছাত্রীর দল বুনো ষাঁড়ের মত ছুটে গেল তাকে ডিঙিয়ে,কয়েকজন তো তার পা মাড়িয়েও দিয়ে গেল। হাতের ফুলদানি ও অন্যান্য মূল্যবান বস্তুকে সে মাটিতে রাখতেও পারল না আর একটা হাত খালি না থাকায় সে শরীর টাকে ভর দিয়ে তুলতেও পারল না। অগত্যা সে ওখানে বসে অপেক্ষা করতে লাগল ভিড়টা একটু কমার জন্য। হঠাৎ তিস্তা তাকে সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়িয়ে কয়েকটা জিনিস তার হাত থেকে নিল।এক হাতে ভর দিয়ে উঠেই সৌগত তিস্তার দিকে তাকিয়ে একহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম এর ছলে বলল- "রক্ষা করলে মা বিপত্তারিনী তোমার ক্ষেপা ষাঁড়ের পা থেকে"।
উপকারের বিনিময়ে এমন পরিহাস..... গা জ্বলতে লাগল তিস্তার। কোন উত্তর না দিয়েই তার হাতে থাকা জিনিস গুলো সৌগতর হাতে ধরিয়ে তিস্তা সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে যেতে লাগল। বাড়ি তাড়াতাড়ি পৌছে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে তাকে পড়াতে যেতে হবে। মাসের প্রথম দিন কামাই করলে টাকা পেতে দেরী হয়ে যায়। তাকেও যে সঠিক সময়ে স্যারের বেতন দিতে হয়। পেছন থেকে সৌগতর গলা শোনা গেল-"এত বৃষ্টিতে চললে যে! বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে নাকি?"

কিভাবে যেন পড়াশুনাটা এত দুর হয়ে গেছে তার। কলেজের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিতে পারবে কিনা তাও জানা নেই।বাড়িতে কেউ খবরও নেয় নি তিস্তা কিভাবে পড়াশোনার খরচ বহন করছে,আদৌ পড়ছে কিনা তাও জানতে চায় না কেউ। আসলে দুই বোনের পরে এক ভাই হওয়ায় বাবা মার সবটুকু স্নেহ, সবটুকু সক্ষমতা ভায়ের প্রতিই ব্যয় হয়। বড় দিদি কোনরকম টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর স্বচ্ছল পরিবার এবং স্বজাতি দেখে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিদির ভারী মিষ্টি গানের গলা ছিল,ভাই হওয়ায় আগে দিদিকে বাবা একটা হারমোনিয়াম কিনে দেয়,সেটি এখন সুর তাল হারিয়ে স্তব্দ হয়েছে। প্রথম সন্তানের ভাগ্যে বাবা মার স্নেহ যত্ন একটু বেশী থাকে,প্রথমের দিকে বড় দিদির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তারপর যখন তিস্তাও আর এক পুত্র সন্তান পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে ভূমিষ্ঠ হয় তখন সবাই আনন্দে মেতে উঠে। না,তিস্তা সে আনন্দের উৎস নয়। এক মেয়ের পর একটি পুত্রসন্তানের কামনায় বাবা মা কত মন্দিরে মাথা ঠুকেছে,ভগবান সে আর্জি শুনেছেও,শুধু দেওয়ার সময় টুথপেস্টের সাথে টুথব্রাশের মতই ছেলের সাথে একটি মেয়ে ফ্রিতে পাঠিয়েছে। তাই তিস্তার আগমন আনন্দ বা নিরানন্দ কোন অনুভূতিই জাগায় নি। উচ্ছিষ্ট মাতৃদুগ্ধে আর ছিটে ফোঁটা স্নেহে কেটে যাচ্ছল বেশ তিস্তার। যখন তাদের বয়স তিন চার মাস হবে দুদিনের জ্বরে ভুগে তিস্তার ভাই মারা গেল। হায়রে বিধির বিধান, অবাঞ্ছিত এই ক্ষুদ্র প্রাণটুকু শত অযত্নেও রয়ে গেল,আর সেই যে মহামূল্য বহু কাঙ্ক্ষিত,বহু মানতের ফল পুত্রটি কুল রক্ষার সমস্ত দায়ভার অবজ্ঞা করে বিদায় নিল। এতদিন যেটুকু দয়া দাক্ষিণ্য জুটেছিল তাও আর রইল না। সবাই বলল ওই রাক্ষসী খেল ভাইকে। আর বলবে নাই বা কেন,ভাইয়ের মৃত্যু তে সবচেয়ে বেশী লাভ তো তারই হল। আর উচ্ছিষ্ট নয়,সম্পূর্ণ মাতৃদুগ্ধেই তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল কিন্তু মাতৃস্নেহ থেকে সে সম্পূর্ণ বিতাড়িত হল। দুধের ভারে যখন যখন তার মায়ের বুক টনটন করে উঠত,তিস্তার কাছে ছুটে এসে মা তার ব্যাথার নিরাময় খুঁজত। বাবা আত্মীয় বন্ধু সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তিস্তার থেকে। মাঝে মাঝে তার দিদি জীবন্ত পুতুল ভেবে কোলে তুলে নিত তাকে। দিদির অপটু হাতে আর ছেলেমানুষি যত্নে দিন দিন বেহায়ার মত বাড়তে লাগল সে। কবে যেন হঠাৎ সবার খেয়াল হল - এবার তাকে ভাত ও অন্যান্য খাবার দিতে হবে। দিদির ওপর সে দায়িত্ব অর্পিত হল। মাঝে মাঝে যখন খেতে চাইত না মা এসে জোর করে মুখে খাবার গুঁজে দিয়ে বলত "খা খা রাক্ষুসী,খেয়ে মর"। যখন উচ্চস্বরে কেঁদে সারা বাড়ি মাথায় তুলত তখন মা এসে তাচ্ছিল্য ভরে কোলে তুলে নিত আর বিড়বিড় করে বলত "সারা ঘর কে খাবি রাক্ষুসী তুই,তবেই তোর শান্তি"।

এসব কি আর ছাই তিস্তার মনে আছে? ওর আবছা স্মৃতিতে ধরা পড়ে তার ভাই যখন হামা দিয়ে সারা বাড়ি চষে বেড়াতো সে সবার অলক্ষে ছুটে এসে ভাইকে কোলে তুলে নিত।মায়ের চোখে পড়লে মা খুব রেগে যেত,ভাইকে তার কোল থেকে কাড়িয়ে নিত। তাকে বারবার করে বাড়ির সকলে নির্দেশ দিত ভায়ের কাছ থেকে দুরে থাকতে। তিস্তার বয়স যখন তিন বছর তখন তিস্তার আরও একটি ভাই হল। এতদিন তিস্তা সকলের ঘৃণায় বড় হচ্ছিল,এবার অবজ্ঞায় বাড়তে লাগল। বাড়িতে সে ছিল একটা সদস্য মাত্র,যার জন্য হাঁড়িতে চাল নিতে হয়,বছরে দুবার জামাকাপড় আনতে হয়,খুব অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতে হয়। পাড়ার সব ছেলেমেয়ের মত সেও স্কুলে যেত। সকলের ভালোবাসায় বড় হওয়া শিশু অভিমানী হয়,ভালোবাসতে শেখে। আবার যে শিশু ঘৃণা,লাঞ্ছনার মধ্যে বাড়ে সে ভালোবাসার কাঙাল হয়। তিস্তা সকলের উপেক্ষায় বাড়ছিল- ভালোবাসা, ঘৃণা,চাওয়া পাওয়ার সূক্ষ অনুভূতি গুলো যেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। সুন্দরী নয় তাই সাজগোজে ছিল তীব্র অনীহা,পরিবারে থেকেও পরিবারের অংশ হয়নি কখনও,গৃহস্থালীর টুকিটাকি কাজে মা তাকে কখনও ডাকে নি তাই সে দিকেও তার কোন আগ্রহ তৈরী হয়নি। মধ্যম মেধার মেয়ে সে,আর কোন সহজাত প্রতিভার বিকাশ হয়নি। কাজের মধ্যে সারাদিন পড়া মুখস্ত করত,অংক কষত,আর নিয়মিত স্কুল যেত। বন্ধু বান্ধবী নেই,জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই।বাঁচার জন্য কিছু কাজ করা চাই,তাই সে পড়াশোনা করত। ফলস্বরূপ ভালো রেজাল্টও হত,কিন্তু এ নিয়ে বাড়িতে কোন উৎসাহ নেই। স্কুলে বেঞ্চের এক কোনে বসে থাকা মেধাবী ছাত্রী হিসাবেই সে পরিচিত ছিল। বড় হতে হতে পাড়ায় দুচারটা টিউশুনি জুটে গেল।যা জুটতো তাই দিয়ে সাদা মাটা পড়াশোনার খরচ চলে যাচ্ছিল। বাবার সামান্য ভূষিমাল দোকান থেকে এত বড় পরিবার চলে,দাদু ঠাকুমার ঔষধ,বড় মেয়ের বিয়ের খরচ,ছেলের লেখাপড়া,আত্মীয়তা সামলে তিস্তার বিয়ে নিয়ে ভাবার সামর্থ এখন আর হবে বলেও মনে হয় না। ফলে তিস্তাও বছরের পর বছর এক একটা ক্লাস উত্তীর্ণ হয় আর ওর পড়াশোনা এগিয়ে চলে।

পর্ব ২

পরের দিন যথারীতি তিস্তা কলেজে এসে পৌছাল,ঢোকার মুখেই সৌগতর সঙ্গে দেখা। তিস্তাকে দেখে হাসতে হাসতে বলল "কালকের প্রশ্নের কিন্তু উত্তর পেলাম না।"তিস্তা সৌগতকে না চেনার ভান করেই চলতে লাগল। সেদিনও কোন কথা বলেনি,আজও কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে সৌগত একটু বিরক্ত হয়ে বলল বোবা নাকি! তুমি কথা বলতে পারো না? এবারও ওই দিক থেকে কোন উত্তর এল না। এভাবে বেশ কয়েকবার সৌগত তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিবারই তার প্রাপ্তি ছিল তিস্তার বোবা চাউনি আর দ্রুত পদে পালিয়ে যাওয়া।

আসলে এই প্রথম কেউ তিস্তার মৌনতা ভাঙতে চাইছিল। বাড়িতে বা স্কুলে সকলে তিস্তার এই স্বভাবের সাথেই অভ্যস্ত। তার সম্বন্ধে কেউ কখনও কৌতুহল দেখায়নি। তিস্তা নিজেও জানত সে নিতান্তই একটা বোরিং মেয়ে, যার কখনও কোন বন্ধু বা প্রেমিক হওয়া সম্ভব নয়। নি:সঙ্গতার মাঝেই সে বাঁচতে অভ্যস্ত ছিল। কোন ছেলের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মত আত্মবিশ্বাস তার কখনই ছিল না। কিন্তু সে অনুভব করছিল সৌগত বারবার তার দিকে এগিয়ে আসছে, যে কোন বাহানায় কথা বলতে চাইছে।
কলেজে ইউনিয়নের দাদা সৌগত,বেশ পপুলার ছেলে। নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব রয়েছে তার,সুদর্শনও বটে। পড়াশুনায়ও বেশ ভালো। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র,এই কলেজে আর কয়েক মাস তার। কলেজে তাকে পাত্তা না দেওয়ার মত মেয়ে হয়ত খুব কমই রয়েছে। একটা অতি সাধারণ মেয়ে তাকে এড়িয়ে চলছে,মেনে নেওয়া তার পক্ষেও খুব কঠিন হল । তিস্তা যে শুধু তার আত্মাভিমানে আঘাত করল তা নয়,ওর কলেজে সব মেয়ের থেকে সতন্ত্র থাকা তার মধ্যে কৌতুহলেরও সৃষ্টি করল। এই অদম্য কৌতুহল নিবারনের জন্য সে বারবার তিস্তার সামনে এসে দাঁড়াল।বারবার সে নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল তবে কি সে শেষ পর্যন্ত এই মেয়েরই প্রেমে পড়ল?
আর তিস্তার মনের অবস্থা বলা কঠিন -এই আঠেরো বছরে প্রথম কোন পুরুষের চোখে সে নিজেকে খুঁজছে,এড়িয়ে চলার প্রবল চেষ্টা করছে-কেন করছে জানে না অথচ এক অজানা আকর্ষণে সে বারবার সৌগতর কাছাকাছি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। কখনো কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গোছানোর চেষ্টা করে,কিন্তু কি ভাবে যে পরিপাটি করে নিজেকে সাজাবে বুঝতে পারে না। ক্লাসের অন্য মেয়েদের সাথে মিশতে পারেনা,যদি দু-চারটা কথা বলে তাও পড়াশোনা সংক্রান্ত। সাজপোশাকের কথা বলতে লজ্জা করে। ওরা যখন কসমেটিক্সের কথা আলোচনা করে আড়াল থেকে শোনার চেষ্টা করে,কিন্তু কেনার সাধ্য থাকে না। যদিবা বিজ্ঞাপন দেখে দু-একটা কেনার চেষ্টা করে তারও সঠিক ব্যবহার জানে না। ফলে নিজেকে সাজানো তো হয় না ঘুরে আরও বেশী এলোমেলো হয়ে যায় সে। শেষে সে অনুভব করে সে আসলে খুবই কুৎসিত,এই ভেবে নিজেকে আরও বেশী গুটিয়ে ফেলে।কুমারী মনে প্রথম বাসা করছে যে ভালো লাগার অনুভূতি তাকে এড়িয়ে যায় কিভাবে! মাথা নীচু করে সে বেশ টের পায় সৌগত চাহনি। জন্ম থেকেই গুরুত্বহীন যে তরুণী,সে হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কলেজের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সুদর্শন যুবকের কাছে। মনের গভীরে বয়ে যায় কালবৈশাখী,লন্ডভন্ড করে তার অষ্টাদশী হৃদয়, এই ভগ্নদশা সে কার কাছে ব্যক্ত করবে তা জানে না,শুধু প্রানপন চেষ্টা করে ক্ষতচিহ্ন টুকু ঢেকে রাখার।

ভ্যাপসা গরমে তরতর করে ঘামছিল তিস্তা। সূর্য দিগন্তরেখার দিকে ঢলে পড়েছে কিন্তু গরম কমেনি। প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল তাই বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেল,তার ওপর সাইকেলে পাংচার। সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে হেঁটে যাচ্ছিল তিস্তা। কলেজের চৌরাস্তার মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিল সৌগত। তিস্তাকে হেঁটে যেতে দেখে এগিয়ে এল।নীরবে হেঁটে যেতে লাগল তিস্তার সাথে। তিস্তা প্রানপন চেষ্টা করল জোরে হেঁটে সৌগতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। কিন্তু সম্ভব হল না।
-"তিস্তা তোমার কি আমাকে খুব খারাপ ছেলে মনে হয়? যতবার কথা বলতে এসেছি তুমি পালিয়ে গেছ। এমন ব্যবহার আজ পর্যন্ত কেউ করেনি আমার সাথে।"

সৌগতর গলায় অসহায়তার প্রকাশ তিস্তাকে আঘাত করল। তিস্তাও অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু কি বলবে? ভাষাহীন চোখে সৌগতর দিকে একবার তাকালো সে।

-তুমি কি সবার সাথেই এমন ব্যবহার করো; নাকি এই ব্যবহার শুধু আমার জন্য?

তিস্তা মৃদু গলায় আমতা আমতা করে বলল -না মানে আমি একটু কম কথা বলি।

সৌগত হাসতে হাসতে বলল তাই বুঝি! যাক এটুকু তো জানা গেল যে তুমি কথা কম বল।আমি ভেবেছিলাম তুমি কথাই বল না।সৌগত আড় চোখে তিস্তাকে দেখল একবার।ল্যাম্পপোষ্টের আলো গুলো এখনও জ্বলে ওঠেনি।হালকা আলো আঁধারিতে তিস্তাকে বড় রহস্যময়ী মনে হল তার।

-সাইকেলটা সারাবে নাকি এইভাবেই বয়ে নিয়ে বাড়ি যাবে?

তিস্তা বলল না মানে সাইকেল সারানোর দোকান খুঁজে পেলে সারাবো।আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে হাঁটছেন কেন?

সৌগত হো হো করে হেসে উঠল।কলেজের সিনিয়ারকে আপনি বলে এই প্রথম শুনলাম।এত সম্মান সত্যি বলছি পুরো স্টুডেন্ট লাইফে পাইনি।বন্ধুত্ব করতে এসেছিলাম,তুমি তো প্রথমেই আপনি বলে মধ্যবয়সী বানিয়ে দিলে।

তিস্তার সংকোচে মাটিতে মিশে যাওয়ার মত অবস্থা।সত্যিই তো কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও সে জানে না।

-তিস্তার অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে সৌগত বলল আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে তাই বলো,শুধু কথাটুকু বলো।

কিছু পথ নিরবে চলার পর সৌগত একটা গলির দিকে ইশারা করে বলল -ওই গলিতে একটা সাইকেল সারানোর দোকান আছে। ওখানে সাইকেলটা সারিয়ে নাও।
বাধ্য মেয়ের মত তিস্তা সৌগতর দেখানো পথে চলতে লাগল।
সাইকেল সারানোর ফাঁকে দু-একটা কথার পর সৌগত বলল তিস্তা আমি জানি তুমি টিউশুনি পড়াও। আমার ভাইপোর জন্য একজন ভালো দিদিমণির খোঁজ করছি। তুমি পড়াবে ওকে?
তিস্তা সম্মতিসূচক ভাবে একবার ঘাড় নাড়ল।

পর্ব ৩

ধীরে ধীরে তিস্তার মনের এক একটা গিঁট খুলছিল সৌগতর কাছে। জীবনে প্রথম বন্ধুত্বের অযাচিত হাত বাড়িয়েছিল সৌগত তার দিকে,সে এক অমোঘ আকর্ষণ -যার কাছে হার মানছিল তিস্তা।
তিস্তা নিজের কাজের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল,ফলে সৌগতর বাড়িতে তার পড়ানোর প্রশংসা হতে লাগল।
সেদিন ভিজতে ভিজতে তিস্তা সৌগতর বাড়িতে পড়াতে এল। দরজা খুলে সৌগত তিস্তাকে ওভাবে ভিজে আসতে দেখে অবাক হল।
"ছি: এভাবে কেউ ভিজে আসে! পাগলী একটা।"-সৌগতর কাছে মৃদু ভৎসনা শুনে তিস্তা একটু লজ্জিত হল,পাছে সে ধরা পড়ে যায়,তাই বলল আসলে তাতানের সামনে পরীক্ষা তো,তাই চলে এলাম। সৌগত হাসতে হাসতে বলল কিন্তু তোমার তাতান তো পরীক্ষার কথা ভুলেই গেছে। আজ যা আড়ি করল সে ডিয়ার পার্কে যাবে। বাধ্য হয়ে মা আর বৌদি দুপুর দুপুর বেরিয়েছে ওকে নিয়ে। এখন বৃষ্টির জন্য ফিরতে পারছে না।ওরা তোমাকে কিভাবে জানাবে তুমি তো একটা মোবাইলও রাখনা কাছে।
ঠিক আছে সৌগতদা,বৌদিকে বলো আমি পরের দিন আসব।-বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল তিস্তা।

দাঁড়াও, বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে শুরু করেছে। তিস্তা আমি তোমাকে বরং গাড়িতে করে ছেড়ে দিয়ে আসি। সাইকেল টা পরের দিন পড়াতে এসে নিয়ে যেয়ো,- বলেই তিস্তার অনুমতির অপেক্ষা না করে তার সাইকেলটা নিয়ে গ্যারেজে রাখল এবং গাড়িটা বার করল সৌগত।

বৃষ্টি যেন আজ কোন এক অঘটনের সাক্ষী হতে চলেছে,মুষল ধারে নেমে আসছে আকাশ থেকে। প্রচন্ড আওয়াজ করে একটা বাজ পড়ল ঐ। বিকট আওয়াজে তিস্তা কেঁপে উঠল।
তিস্তাকে চমকে উঠতে দেখে সৌগত বলল তোমার জায়গায় এখন অন্য কেউ হলে তার বয়ফ্রেন্ডকে জড়িয়ে ধরত।
-কিন্তু তুমি তো আমার বয়ফ্রেন্ড নয়।
-তবে.....? আমি তোমার কে তিস্তা?
উত্তর তো জানা ছিল না তিস্তার। শুধু মাথা নীচু করে রইল সে।

তিস্তা তোমার নামটা ভারি সুন্দর। আমি সারাদিন নিজের মনে শত শত বার তোমার নামই উচ্চারণ করি। ভালোবাসি এই নামটাকে বড়।
শুধু নামটাকেই?তিস্তার গলার স্বর একটু অভিমানী হল।
-যদি বলি নামটা তোমার তাই এত ভালো লাগে।

একটু থেমে সৌগত বলল-তোমায় একটা ছোট্ট গিফট দিতে চাই। নেবে তো?
তিস্তা জানতে চাইল কি?
-এই মোবাইলটা রাখ। যখন তোমার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা করবে ফোন করবো।
-কিন্তু এত মূল্যবান গিফট আমি নিতে পারব না সৌগত দা।
-আমার থেকেও মূল্যবান এটা?
-দুর, তা কি বলেছি।
-তবে নিয়ে নাও। আমার জন্যই দিচ্ছি।

-তিস্তা........,এত বছর বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আজ প্রথম আমি ভিজছি। আমি জানি তুমিও আজ প্রথম ভিজছ তাইনা।
-কোথায় ভিজছি? আমরা তো গাড়ির ভেতরে রয়েছি!
-তিস্তা তুমি কি সত্যি কিছুই বোঝ না?
-তিস্তা একটু বিজ্ঞের মত বলল আমি সব বুঝি।
সৌগত এবার হেসে ফেলল।
-জান তিস্তা,তোমাকে আর পাঁচটা মেয়ের সাথে মেলাতে পারি না। তুমি স্মার্ট নয় আবার বোকাও নয়। সুন্দরী নয় কিন্তু তবুও তোমার দিকে না তাকিয়ে থাকা যায় না। তোমার গভীরতা মাপতে গিয়ে কখন কখন মনে হয় আমি ডুবে মরব এতে।

অদ্ভুত এক ভালো লাগা তিস্তাকে গ্রাস করছিল। এতদিন তো কেউ তাকে এভাবে আবিস্কার করেনি!
-তিস্তা.... চুপ কেন? কিছু তো বল।
-কি বলব?
-এই যেমন..... তুমি আমার সম্বন্ধে কি ভাব? আমাকে তোমার কেমন লাগে?
সৌগত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলতে শুরু করল,জানি তুমি কিছু বলবে না। তোমার আমাকে ভালো লাগে না;তাও আমি জানি।
-তা নয়,ভালোই লাগে সৌগতদা।
-তাই? সত্যি তোমার ভালো লাগে আমাকে?
তিস্তা আর সৌগতর দিকে তাকাতে পারছিল না।অন্যমনস্ক হওয়ার বাহানায় জানলা দিয়ে এক মনে বৃষ্টির ফোঁটা গুনে চলছিল যেন।এক দুবার জানলার কাঁচ সরিয়ে বাইরে হাত মেলে দিয়ে বৃষ্টিকে মুঠোয় বন্দী করতে চাইছিল।হৃদয় যে তার আজ সিক্ত হচ্ছে অনুরাগে তা লুকানোর মরিয়া প্রচেষ্টা,নাকি সৌগত কাছে হৃদয় মেলে ধরার অদম্য ইচ্ছা,-এই মুহূর্তে কোনটা তাকে অস্থির করছিল তা বলা কঠিন।

সৌগত তিস্তাকে এক হাত বাড়িয়ে নিজের দিকে একটু টেনে এনে স্যাত্‌ স্যাতে হাতটা নিজের মুঠোয় বন্দী করল। গাড়ি চলছে ভিজে পিচের ওপর দিয়ে।

-তিস্তা আমি তোমাকে ভালোবাসি;
একটু থেমে সৌগত আবার বলল জানি তুমি কোন উত্তর দেবে না। কিন্তু তুমিও আমাকে ভালোবাস।

অস্বীকার করার ক্ষমতা তিস্তার নেই।সত্যিই তো সে ভালোবাসে সৌগতকে।তার টানেই তো এই বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়ে ছুটে আসা।একদিকে নিজের আজন্ম লালিত সংকোচ আর অপর দিকে সৌগতর ভালোবাসার হাতছানি ;দুয়ের মাঝে পড়ে দমবন্ধ হচ্ছিল তার।ইচ্ছে করল এক ছুটে সৌগত কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচে সে।কিন্তু তা সম্ভব নয়।সৌগত একনাগাড়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে।নিজেকে লুকানোর মত স্থান আর না পেয়ে আত্মসমর্পণ করল সে।মুখ লুকানোর জন্য ঝুঁকে পড়ে সৌগতর কোলে মাথা রাখল।তিস্তার চুলের গভীরে সৌগত আঙুল গুলো ডুবতে লাগল।এলোমেলো হাতের স্পর্শ চুল থেকে ঘাড়,ঘাড় থেকে পিঠ বেয়ে কোমরে নেমে এল।শিউরে উঠল তিস্তা।শিথিল হচ্ছিল তার শরীর।চার চাকা গতি হারাচ্ছে যত,ততই দিশাহীন হচ্ছে সৌগতর সাহসী হাতের গতির অভিমুখ।সৌগতর একহাত স্টিয়ারিং এ পড়ে পড়ে শীতল হচ্ছে আর অপর হাত খুঁজে চলেছে নরম জমি। অবশেষে গাড়ির গতি রুদ্ধ হল এক নির্জন প্রান্ত এসে।তিস্তাকে আরও কাছে টেনে এনে গভীর আবেশে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবাল সৌগত।বিগলিত হতে লাগল তিস্তা।যেন সে কোন উন্মত্ত পাহাড়ী নদী।বাঁধ ভাঙা উচ্ছাসে দুকূল ভেঙে চুরে ধ্বংস করতে চায় সভ্যতা। ধীরে ধীরে সৌগতর দুই বাহু অজগরের মত বেষ্টন করচ্ছে তিস্তাকে।তিস্তাও নিজেকে সমর্পণ করচ্ছে সৌগতর বুকে। দমবন্ধ হচ্ছে তার অজগরের দংশনে,পেষনে। স্খলিত হচ্ছে বিধি নিষেধের সকল বেড়ি।উজাড় করে দিচ্ছে সে নিজেকে তার কাছে।ভালোবাসলে মেয়েরা নি:স্ব হতে চায়,ভিখারিনী হওয়ার জন্য বিলিয়ে দিতে চায় নিজেকে। নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসতে পারার মত গৌরব আর কি বা হতে পারে। আর পুরুষেরা সেই আদিম বর্বরতায় ভালোবাসা ব্যক্ত করে। এই বৈপরীত্যেই দুজনের পরিপূর্ণতা। আজ তারা তৃপ্ত হচ্ছে,পূর্ণ হচ্ছে। সময় বয়ে চলেছে,বৃষ্টি কখন থেমে গেছে। কিন্তু তারা ভিজে চলেছে,কতক্ষণ এভাবে ভিজেছে কেউ তার হিসাব রাখেনি।

Re: তিস্তা এক প্রবাহিণী