টপিকঃ মানুষ ও অমানুষ - সত্য ঘটনা নাম ও পরিচয় পরিবর্তিত

"বস না আরেকটু"

"না রে ভালো লাগছে না।"

"কেন রে? আজ আবার কিছু করেছে অভিজিৎ?

" না রে ভালো লাগছে না। কোনোদিন তো বোঝার চেষ্টা করে নি রে ও। ও আমায় কবে বুঝল বলত সুজয়? আমার ইচ্ছের দাম কবে দিল ও?

" কি হয়েছে আমায় বলবি না সুনি ? " সুনন্দিতার হাতের ওপর হাত রেখে বলল সুজয়নীল।

সুজয়নীলের হাতের স্পর্শে সুনন্দিতার চোখ জলে ভরে গেল। সুজয়নীলের স্পর্শ পেয়ে সুনন্দিতার মনে এক আবেগের ঝড় উঠল। সুজয়নীলকে তার বড় আপন মনে হয়। কোনো কিছু চিন্তা না করেই পার্কে বসে সুজয়নীলকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কাদতে শুরু করল সুনন্দিতা । সুজয়নীল আলতো ভাবে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

"সুনি কাদিস না বাবু। এবার বল কি হয়েছে। তুই কাদলে যে আমার ভালো লাগে না। "

অনেক কষ্টে নিজের চোখের জল মুছে সুনন্দিতা সুজয়নীলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

" আজও মেরেছে রে সুজয়। বিশ্বাস কর আজকাল ওর স্পর্শ খুব ঘেন্না লাগে৷ তাই ওকে বলেছিলাম আমার শরীর ভালো না। শোনে নি রে সে কথা৷ সারারাত পশুর মত.... " বলে ডুকরে কেদে উঠল সুনন্দিতা। সুজয় আবার জড়িয়ে ধরল তাকে। সুনন্দিতার গালের পাশে চলে আসা চুল কানের পাশে আলতো হাতে গুজে দিয়ে বলল,

"তোর শ্বশুর শাশুড়িকে জানালি না কেন একথা? ওর পাশবিকতার শিকাত কতদিন হবি তুই?"

" তারা কখনো ছেলের দোষ দেখে না রে সুজয়৷ শাশুড়ি বলেছে অভিজিৎকে খুশি রাখা আমার কর্তব্য৷ ও যেভাবে আমাকে চায় সেভাবেই যে আমাকে ওর সামনে তুলে দিতে হবে। আমি যে আর পারি না রে। "

" চলে আসিস না কেন আমার কাছে চিরতরে? ভালোবাসার ঘর কি তৈরী করতে পারি না আমরা? আমার যে আর তোর ওপরে ঘোতে চলা অত্যাচার সহ্য হয় না। পুলিশে কমপ্লেন করিস না কেন তুই?"

"সুজয়, ওদের আর্থিক অবস্থা যে আমায় মিথ্যেবাদী বানিয়ে দেবে। "

"তাহলে সব ছেড়ে চলে আয় আমার কাছে। আমার বুকে। আমরা ভালো থাকব বিশ্বাস কর। হয়ত অত দামী জিনিস কিনে দিতে পারব না। তবুও তোকে কাদতে দেব না। "

সুজয়ের কথা শুনে সুজয়ের বুকে মাথা দিয়ে সুনন্দিতা বলল,

" পারব না রে। ওই যে সমাজ। আমি তোর সাথে চলে এলে আমার বাবা মাকে সমাজ কথা শুনাবে। কি করে সন্তান হয়ে মা বাবার মুখে চুন কালি মাখাব বলত? নিজে যে এতটা স্বার্থপর হতে পারব না রে। শোন না সুজয় আজ অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে৷ আজ উঠি। "

" আচ্ছা। সাবধানে যাস৷ আর কোনো প্রবলেম হলে আমায় ফোন করে জানাস কেমন? চিন্তা করিস না আমি সবসময় আছি তোর পাশে৷

অতঃপর সুজয়নীল এবং সুনন্দিতা পার্ক থেকে উঠে এগিয়ে গেল মেট্রো স্টেশনের দিকে৷ দুজনের বাড়ি দুদিকে।

সুজয়নীল এবং সুনন্দিতা ক্লাসমেট ছিল কলেজে। কোনোদিন সেভাবে কথা হয় নি তাদের। সুজয়নীলকে সে চিনত তার এক বান্ধবী গার্গীর প্রেমিক হিসেবে। বেশ মাখো মাখো সম্পর্ক ছিল ওদের। গার্গীর খোজ নিতেই মাঝে মাঝে কথা বলত সে সুজয়নীলের সঙ্গে। সুজয়নীলও সেভাবেই চিনত তাকে। তারপর কেটে গেছে বহুবছর। কলেজ শেষ। সম্পর্ক ভেঙ্গেছে সুজয় এবং গার্গীর৷ সম্পর্ক ভাঙার দিন গার্গী তাকে বলেছিল,

"মধ্যবিত্ত ঘরের বৌ হয়ে মেপে খরচ করা আমার দ্বারা হবে না সুজয়। আমার বাবা আমায় আমাপা টাকা দেয়৷ সেভাবেই আমি মানুষ হয়েছি। আমাকে বিয়ের পর সেভাবেই থাকতে হবে। "

সুজয় গার্গীর কথা শুনে বলেছিল,

"তাহলে আমাদের সম্পর্ক? "

গার্গী কটাক্ষ করে বলেছিল,

"শুধু ভালোবাসা দিয়ে পেট ভরে না সুজয়। পেট ভরাতে টাকা চাই। যা তোমার কাছে নেই।"

গার্গী আজ অন্য কারো ঘরনী। আর সুজয়নীল আঘাত পেয়ে ডায়েরি এবং কলমকে সঙ্গী করে হয়ে উঠেছে মস্ত বড় লেখক এবং পরিচালক। যে ভালোবাসা তাকে সাহিত্যিক বানিয়েছে, সেই ভালোবাসাকে আশ্রয় করে সুজয়নীল আজ খ্যাতি এবং অর্থ দুই ই অর্জন করেছে।

দুজনেই আজ ব্যস্ত দুজনের মত। গার্গীও কখনো খোজ নেয় নি সুজয়নীলের। সুজয়নীলও আস্তে আস্তে ভুলেছে নিজের কলেজ জীবনের প্রেম। কিংবা হয়ত নেহাতই ভুলে যাওয়ার অভিনয় করেছে। গার্গীর নিজের দাদার সাথেই সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে সুনন্দিতার৷ সুজয়নীলের অধ্যায় ভুলেছে তারা পুরোপুরি। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস বেশ ভালোই কেটেছিল সুনন্দিতা এবং গার্গীর দাদা অভিজিতের জীবন। অভিজিতের সাথে বিয়ের পর নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হত তার। ধনী, শিক্ষিত, যত্নবান স্বামী একটা মেয়ে জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কি বা চায়। সুনন্দিতাও তাই খুশি ছিল। কিন্তু হঠাৎ সব যেন কেমন বদলাতে শুরু করল। অভিজিৎও আজকাল ভালো করে কথা বলে না তার সাথে। অফিসে থাকলে বেশি ফোন করলেও বিরক্ত বোধ করে সে। কারণটা বুঝতে পারে না সুনন্দিতা। ভাবে হয়ত কাজের চাপে এরকম ব্যবহার করে অভিজিৎ তার সাথে। ডাইনিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পরে সে। অভিজিৎ সারারাত বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দেয়৷ সকাল অব্দি বাড়ি ফেরে না। ফোন করলেও ফোন ধরে না। চিন্তা হয় তার। কিন্তু অভিজিৎ তার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা টুকুও করে না। কেমন যেন সবার মধ্যে থেকেই সুনন্দিতা ক্রমশ একা হয়ে পরে। আজকাল অভিজিৎকে বেশি প্রশ্ন করলে সে খেপে যায়। মাঝে মাঝে গায়ে হাতও তোলে সে। সুনন্দিতা কষ্ট পায়। নাচ করতে একটা সময় ভীষণ ভালোবাসত সুনন্দিতা। কিন্তু অভিজিতের নিষেধের কারনে সেই নাচও ছাড়তে হয়েছে তাকে। সারাটা দিন তাই একাই কাটায় সুনন্দিতা। গার্গী কিংবা তার শাশুড়ির মত ক্লাবে গিয়ে তাস খেলা কিংবা গসিপে অংশগ্রহণ করা একদম পছন্দ নয় তার। সে কারণে কম কথা শুনতে হয় না তাকে৷ সে কষ্ট পায় কাদে। কিন্তু সে যে কিছুতেই হতে পারবে না ওরকম। ফলে বাড়ি ভর্তি লোক থাকা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে তাকে।

কিছুদিন আগে সকালে মালতী মাসি পুজোর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা নতুন এবং একটা পুরোনো ডায়েরি খুজে পায় অভিজিৎ সুনিন্দিতার ঘর থেকে। ডায়েরি দুটো অভিজিতের। আর পাচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতই স্বামীর ছেলে বেলা বড়বেলা সম্পর্কে জানতে ডায়েরি দুটো নিজের কাছে রেখে দেয় সে। ভাবে অবসর সময়ে বসে পড়বে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর প্রতিদিনের মত আজও অভিজিৎ বাড়ি না ফিরলে সুনন্দিতা অভিজিতের ডায়েরির সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করে। ডায়েরির প্রথম পাতা পড়ে সে বুঝতে পারে ডায়েরিটা অভিজিতের কলেজ লাইফ নিয়ে লেখা। জানতে পারে অভিজিতের কলেজ লাইফে বন্ধুদের সাথে মজা আডডা সম্পর্কে। পড়তে পড়তে মুখের কোণায় হাসি চলে আসে তার৷ নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে সুনন্দিতা। জানতে পারে অভিজিতের প্রথম প্রেমিকা শর্বাণীর ব্যপারে। ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল শর্বানীর চলে যাওয়ার গল্প। সুনন্দিতা শর্বানীর কথা জেনেও কিছু খারাপ ভাবে নি অভিজিতের সম্পর্কে। কিন্তু গোল বাধল অভিজিতের নতুন ডায়েরি পড়তে গিয়ে। অভিজিতের ডায়েরির প্রথম পাতায় অভিজিৎ এবং শর্বানীর একত্রে একটি ছবি আটকানো ছিল। সুনন্দিতার চিনতে দেরী হয় নি শর্বানীকে। সে ডায়েরি পড়তে গিয়ে জানতে পারে শর্বানীর বিয়ের পর ডির্ভোসের কথা। তিনমাস আগে ডির্ভোস হয় শর্বানীর। ফলে আবার শর্বানী ও অভিজিতের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে পুরোদমে। শর্বানীর সাথে আজকাল অনেক হোটেলে রাত কাটাচ্ছে অভিজিৎ। বেশ কিছুদিন আগে সুনন্দিতাকে না জানিয়েই তারা ঘুরে এসেছে গ্যাংটক থেকে। নিজের সম্ভ্রমের এহেন অপমান দেখে রাগে দুঃখে কেদে ফেলে সুনন্দিতা। এতটা অপমান যে সে এর আগে কখনো হয় নি। ওপরের দিকে তাকিয়ে সে বিলাপ করে বলে,

"আমি ই কেন ঈশ্বর?"

ডায়েরি গুলো আবার যথাস্থানে রেখে দেয় সুনন্দিতা। সে সিদ্ধান্ত নেয় এই বাড়িতে আর না। মা বাবার কাছেই আশ্রয় নেবে সে। এ বাড়িতে তার কেউ আপন নেই। যার হাত ধরে সে এ বাড়িতে এসেছিল আজ সেই মানুষটি তার থেকে লক্ষ যোজন দূরে। সে মানুষটি আজ অন্য কারো। হ্যা হয়ত কেস করলে, আইনের দ্বারস্থ হলে মানুষটি বাধ্য হবে তার সাথে থাকতে। কিন্তু ভালোবাসবে কি তাকে? সুনন্দিতার মনই তাকে উত্তর দেয় "না"। তাহলে কেন আইনি ব্যবস্থা নেবে সে? তাই ঠিক করে অভিজিৎকে ডির্ভোস দিয়ে নিজের মত বাচতে সাহায্য করবে তাকে। কারণ জোর করে শরীরকে বেধে রাখা যায় মনকে না। পরের দিন সকালে মা বাবার কাছে এসে হাজির হয় সুনন্দিতা। মা বাবাকে সব কথা খুলে বলে সে। কিন্তু তার বাবা মা তাকে নিরাশ করে তাকে বুঝিয়ে বলে,

" মা রে ছেলেরা একটু ওমনি হয়,মেয়েদেরই মানিয়ে নিতে হয়। এভাবে তুই এখানে থাকলে তোর বোনের বিয়ে কিভাবে দেব মা। ওটাই যে তোর বাড়ি। ওখানে তোকে মানাতেই হবে। "

মা বাবার কথা শুনে হতাশ হয়ে পরে সুনন্দিতা। সেদিনই বিকেলে অভিজিতের বাবা মা তাকে নিতে আসে৷ অভিজিতের মা সুনন্দিতার বাবাকে বলেন,

" কি মেয়ে জন্ম দিয়েছেন মশাই। কিছুই তো শিক্ষা দীক্ষা নেই। না বলে বাপের বাড়ি চলে এল। আমরা কস্মিনকালেও এহেন কাজ করতাম না। "

প্রচন্ড রেগে সুনন্দিতা বলতে যাচ্ছিল, "নিজের ছেলেকে কি...... "

সুনন্দিতার মা তাকে থামিয়ে অভিজিতের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

"ক্ষমা করে দিন বেয়ান। কমবয়েসে ভুল করে ফেলেছে। "

অভিজিতের মা অহংকারের সুরে বললেন,

" সে ভুল ঠিক আছে। আর যেন এমন না হয়। "

সুনন্দিতার বাবা হেসে কাকুতিমিনতি করে বললেন,

" বিশ্বাস করুন আর হবে না। "

সুনন্দিতাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে আসতে হল তার শ্বশুর বাড়িতে, যেখানে সে ন্যূনতম সম্মান টুকুও পায় না। সুনন্দিতাকে দেখে ভীষণ খেপে গেল অভিজিৎ। তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বেল্ট দিয়ে চলল বেধড়ক মার। কিন্তু এত মার খেয়েও কাদল না সুনন্দিতা। সে যে অনূভূতিহীন লাশে পরিণত হয়েছে। ক্রমশ ডিপ্রেশনে যেতে শুরু করল সে। কিন্তু তার দিকে নজর দিয়ে তাকে সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে এত সময় কার আছে। সে তাই বাধ্য হয়ে সোশাল মিডিয়া অ্যাডিক্টেড হতে শুরু করল। প্রায়ই অপরিচিতদের সাথে ভাগ করে নিতে শুরু করল নিজের মনের কথা। নিজের রিয়াল ওয়ার্ল্ডের সাথে গুলিয়ে ফেলল ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডকে। এমনই একদিন এক অচেনা প্রোফাইল থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল তার জন্যে৷ প্রোফাইলটির নাম বর্ষাকালীন সন্ধ্যে। নামটা ইন্টারস্টিং শুনে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাসেপ্ট করল সে। কথা বলা শুরু হল। কথা বলতে বলতে সে জানতে পারল প্রোফাইলটি সুজয়নীলের৷ সুজয়নীলের সাথে চ্যাটিং করে সে যেন নিজের মৃতপ্রায় জীবনে প্রাণের সঞ্চার অনুভব করতে পারল। সুজয়নীলের সাথে কথা বলে, তার সকল সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করে নিজেকে খুব হাল্কা মনে করতে থাকল সে। একদিন কোনো কারণে কথা না হলেই আবার ডিপ্রেশনে চলে যায় সুনন্দিতা। এভাবেই বাড়তে লাগল তাদের বন্ধুত্ব। সুজয়নীলকে সে শেয়ার করতে লাগল তার রোজকার রুটিন। সুজয়নীলও খুব উৎসাহ নিয়ে শুনত সেসব কথা। সুনন্দিতার মত সুজয়নীলেরও কথা বলতে ভালো লাগতে শুরু করল সুনন্দিতার সাথে। ফেসবুকের সীমা ছাড়িয়ে তারায়া দেখা করতে শুরু করল রিয়েল ওয়ার্ল্ডেও। সবাই যখন ক্লাবের জন্যে বেরিয়ে যেত সুনন্দিতা দেখা করতে যেত সুজয়নীলের সঙ্গে৷ তাদের ভাঙ্গা অনুভূতিগুলো যেন আবার জোড়া লাগতে শুরু করল একে অপরের সঙ্গে৷ তারা আজকাল প্রায়ই দেখা করে বিভিন্ন জায়গায়৷ সেরকমই আজও সুনন্দিতা দেখা করতে এসেছিল সুজয়নীলের সঙ্গে। কাল রাতে শারীরিক হেনস্থা হওয়ার পর আজ সুজয়নীলের সঙ্গে দেখা করতে না পারলে সুনন্দিতা যেন মরে যেত। ভিক্টোরিয়ার লেকের পাশে বসে সুজয়নীলের বুকে মাথা দিয়ে সে যেন পরম শান্তি লাভ করল। সুজয়নীলের বুক যেন তার পরম শান্তির আশ্রয়। সুজয়নীল তাকে বলে সুনন্দিতা যেন চলে আসে তার কাছে সব কিছু অস্বীকার করে। কিন্তু সুনন্দিতা পারে না। ওই যে সমাজ। তার যে আরো দুটো বোন আছে। সে যদি সব বাধন অস্বীকার করে চলে যায় সমাজ কাল তার বোনেদেরও চরিত্রহীনা বলবে। সে যে সুজয়নীলকে ভালোবেসেও অভিজিতের সঙ্গে মিথ্যে সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। তাই তাদের সম্পর্ক, তাদের ভালোবাসা অবৈধই থেকে যায় সমাজের চোখে৷

প্রতিরাতে মাতাল চরিত্রহীন অভিজিতের হাতে মার খেয়ে ক্রমান্বয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠতে থাকে সুনন্দিতা। সুজয়নীলের ভালোবাসাকে আকড়ে ধরার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে সে। ঠিক তখনই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মা বাবা বোনের মুখ। সে যেন চেয়েও কাটাতে পারে না অভিজিতের সাথে তার বাধনকে। স্বপ্ন দেখে প্রায়শই ভয়ে লাফিয়ে ওঠে সে৷ স্বপ্নে সে দেখতে পায় এক কালো অজগর গিলতে আসছে তাকে৷ সে পালাতে চাইছে, সে দৌড়োচ্ছে তার আশ্রয়ের দিকে কিন্তু হোচট খেয়ে পরে যাচ্ছে৷ ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফোন করে সুজয়নীলকে। সুজয়নীলের সাথে কথা বলে শান্তি পায় ভীষণ৷ কিন্তু তবুও কতদিন এভাবে কাটাতে হবে তাকে বুঝতে পারে না সুনন্দিতা। বারংবার সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে বলে তাকে মুক্তি দিতে। সুনন্দিতা যে আর বাচতে চায় না। সে আজ তাই ঘুমের ওষুধ নিয়ে বসে খাটের ওপর আত্মহত্যা করতে চায় সে। কিন্তু ঘুমের ওষুধ নিজের হাতে ঢালার সময় তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুজয়নীলের মুখ। তার স্মৃতিপটে এক এক করে ভেসে উঠতে থাকে সুজয়নীলের ভালোবাসার স্মৃতিগুলো। তার সাথে কাটানো সেই প্রতিটা মুহুর্ত যা সে প্রাণোচ্ছল ভাবে বেচে ছিল। ঠিক তখনই তার সামনে তার বিবেক এসে দাঁড়ায় এক কটাক্ষের চাহুনি নিয়ে। তার বিবেক তার দিকে কটাক্ষের সুরে হেসে বলে,

"কার জন্যে সমাজ মানছিস তুই সুনন্দিতা? তোর বাবা মা তোর বোনের জন্যে? যাদের কাছে তোর সুখের চেয়ে তোর ভালো থাকার চেয়ে নিজের মিথ্যে সামাজিক মূল্য অনেক বেশি? কোন সমাজের কথা ভাবছিস তুই? যেই সমাজে সুজয়নীলদের অস্বীকার করে অভিজিৎদের বসায় দেবতার আসনে? সেই সমাজের মুখে লাথি মেরে এগিয়ে চল তুই। এগিয়ে চল সুজয়নীলের হাত ধরে। তোকে যে বাচতেই হবে সুজয়নীলের জন্যে। ওই মানুষটার যে তুই ছাড়া কেউ নেই। জীবনে একবার আঘাত পেয়েছে, তার পরেও ভাঙ্গা মন নিয়ে ভালো বেসেছে তোকে। একবার ভাব সুনন্দিতা তুই মারা গেলে ও কি নিয়ে বাচবে? ও যে মরে যাবে বেচে থেকেও। অভিজিতের শাস্তি সুজয়নীল কেন পাবে বলতে পারিস?"

ঘুমের ওষুধগুলো দোতালার জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় সুনন্দিতা। সেই রাতেই নিজের সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে ঘর ছারে সুনন্দিতা৷ কিছুক্ষণ আগে বুক করা ক্যাবে বসে পৌছায় সুজয়নীলের ফ্ল্যাটে৷ সুজয়নীল তখন ব্যস্ত ছিল গল্প লেখায়৷ হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠায় একটু চমকে গিয়ে বলে,

"আসছি দাড়ান৷ "

সুজয়নীল দরজা খুলে সুনন্দিতাকে দেখে অবাক হয়ে যায়৷ সুনন্দিতা ঘরে ঢুকে সার্টিফিকেটের ফাইল টা সোফায় রেখে সুজয়নীলকে জড়িয়ে ধরে বলে,

"আমি সব ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে চলে এসেছি তোমার কাছে চিরতরে। আমি আর কোথাও যাব না।"

সুনন্দিতাকে জড়িয়ে ধরে চোখ জলে ভরে যায় সুজয়নীলেরও। তবে তা আনন্দের জল। সুজয় তার মাথায় আলতো চুম্বন করে বলে,

" এটা তোমারই বাড়ি সুনি। তুমি এটাকে নিজের মত করে সাজিয়ে নাও। "

কিছুদিন পর সুজয়নীলের বাড়ি থেকেই ডির্ভোস কেস ফাইল করে সুনন্দিতা। তার কোনো কমপেনশেসান চাই না। তার শুধু মুক্তি চাই। বছর খানেকের মাথায় ডির্ভোস পেয়েও যায় সে। সুজয়নীলের সাথে বিয়ে করে সুখের সংসার সাজিয়েছে সুনন্দিতা৷

এত কিছুর পরেও সমাজ সুজয়নীল এবং সুনিন্দিতাকে ঘৃণার চোখে দেখে সমাজ। অনেকে কটাক্ষ করে বলে,

"মালটার মেয়ে জোটে নি পরের বৌকে নিয়ে টানাটানি করে বিয়ে৷ "

মিডিয়াও সুযোগ বুঝে কাদা ছুড়তে ছাড়ে না সুজয়নীলের গায়ে। পপুলার হওয়ায় সোশাল মিডিয়াও ট্রল করে "অবৈধ " বলে ডাকে তাদের। কিন্তু তারা গায়ে মাখে না। কারণ তারা জানে ভালোবাসা কখনো অবৈধ হয় না।