টপিকঃ মাতৃত্ব

আমার জীবনে দেখা দুটি ঘটনা শ্রীরামপুর মাসি বাড়ি যাচি বছর দুকে আগে মেইন লাইন বর্ধমান লোকাল উঠেছি কিন্তু compartment হৈ হৈ কাণ্ড একটা বছর ৪ ৫ এর হারিয়ে যাওয়া বাচ্চা খুব কাঁদছে আর ভয়ের ছোটে অ ভধ্রমহিলা কে জরিয়া ধরেছে হাওড়া  জি র পি তে বাচ্চা টা জমা দেয় হোল আমি হেল্প করেছিলাম ফেরার সময় দেখে ছিলাম তার চোখে মাতৃয়ের আকুতি এই নিয়া আজকের এই গল্প | কি অদ্ভুত সব মেয়ের মধ্যই বোধহয়ই এক মা বাস করে | কারো কারো মন নারী পুরুষ সব ক্ষেত্রেই তাদের মন কেবল শরীরেই আবদ্ধ। শরীরের বাইরেও যে বিশাল জগত তার খবরই রাখে না। ঈশ্বর সৃষ্ট নারী বিপুল বিস্ময়ের আকর।অত্যন্ত বেদনার কথা নারীর সেই সব মনি-মাণিক্য কিছু মানুষের নজরেই পড়েনা।নারী পুরুষের তুলনায় কোথায় পিছিয়ে?তারা কি কেবল ভোগ্য পণ্য?

ব্যাগের মধ্যে মোবাইলটা বাজছে, গুঞ্জার একটুও ইচ্ছা করছে না কারও সাথে কথা বলতে। মনে হয় দীপ্তেশ। এক ছাদের তলায় থেকে গত তিনচার দিন ধরে সামান্য কথাটুকুও বলা বন্ধ করে দিয়ে, এখন ফোন করা হচ্ছে। পুরুষ জাতটাই স্বার্থপর। যুগ যুগ ধরে মেয়েদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির যন্ত্র ভেবে এসেছে, আজও তার কোন পরিবর্তন হলো না। শুধু দীপ্তেশকেই বা দোষ দেয় কি করে, নিজের মায়ের গলাতেও তো দীপ্তেশেরই সুর। নিজের সমস্যাটা কাউকে বোঝাতেই পারলো না গুঞ্জা। আসলে গুঞ্জার কাজের গুরুত্ব, ওর নিজের চাওয়া-পাওয়া সবকিছুই মূল্যহীন ওর জীবনের সবথেকে কাছের দুটো মানুষের কাছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে টিকিটের লাইনে এগোতে থাকে গুঞ্জা। কাউন্টারে সঠিক ভাড়াটা ঢুকিয়ে যান্ত্রিক গলাতেই বলে, একটা শিয়ালদা।

টিকিটটা নিয়ে ব্যাগের মধ্যে ভরে হাঁটতে থাকে। দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকে ট্রেনে, বিশেষ করে লেডিস কম্পার্টমেন্টগুলোতে। একটা পছন্দমত জানলার ধারের সিটে এসে বসে গুঞ্জা। ট্রেনে নিত্য যাতায়াত গুঞ্জার, তবে শিয়ালদা লাইনে নয়। কতবার দীপ্তেশকে বলেছে, কলকাতায় একটা ফ্ল্যাটের কথা। ঐ অফিস টাইমের ট্রেনের ভিড়ে রোজদিনের যাতায়াত, আর পোষাচ্ছে না গুঞ্জার। কোম্পানী মাসের শেষে অতগুলো টাকা এমনি দেয়না। সকাল দশটা থেকে রাত আটটা অবধি শরীরের সব এনার্জিটুকু নিগড়ে নেয় একবারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!!!! দীপ্তেশ ওর যুক্তিতে অনড়। শ্রীরামপুরের বাড়িতে মা-বাবার স্মৃতি, ছোটবেলার স্মৃতি জুড়ে আছে। আর এমন সুন্দর খোলামেলা পরিবেশ আছে নাকি কলকাতাতে!!!! দীপ্তেশদের বাড়িটা যে সুন্দর, একথা অস্বীকার করে না গুঞ্জা। ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে এখনও গঙ্গা দেখা যায়। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তটা এতো সুন্দর, মন ভরে যায়। কিন্তু ওসব দেখার সময় কোথায় গুঞ্জার!!!! প্রয়োজন আর পরিস্থিতির সাথে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়।

বাপী রেলে চাকরি করতো, গুঞ্জার ছোটবেলার স্মৃতি তো শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গাতে নয়, আশপাশের রাজ্যেও ছড়িয়ে আছে। কোনো জায়গায় দু-তিন বছরের বেশি থাকা হয়নি। স্কুলের বন্ধু-পাড়ার বন্ধু সবাইকে ছেড়ে আসতো কাঁদতে কাঁদতে। উচুঁ ক্লাসে ওঠার পর এইভাবে পড়াশুনোর অসুবিধা হবে বলে, বাপী হোস্টেলে দিতে চেয়েছিল গুঞ্জাকে। গুঞ্জা কিছুতেই রাজি হয়নি। বাপী-মাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারবে না ও। অথচ আজ বাপী এগারো বছরেরও ওপর হয়ে গেল নেই। দিব্যি রয়েছে বাপীকে ছাড়া। বিয়ের পর সাতটা বছর তো মাকে ছেড়েও আছে, যদিও সময় পেলেই দু-চারদিন মায়ের কাছে থেকে যায় গুঞ্জা। রিটার্মেন্টের পর বড়ো শখ করে বাড়িটা করেছিল বাপী, ছ'টা মাসও থাকতে পেল না মানুষটা। সুস্থসবল মানুষটা হঠাৎ ঘুমের মধ্যে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেও পারেনি কেউ। ছোট থেকেই বাপীর বড্ড নেওটা গুঞ্জা, মা বলতো বাপসোহাগী বেটি। আজও বাপীর কথা ভাবলে চোখদুটো জলে ভরে আসে। ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে চোখের জলটা মুছে নেয়। দীপ্তেশের সাথে রাগারাগি করে গত পরশুদিন মায়ের কাছে গিয়েছিল গুঞ্জা। কিছু না বললেও মা সব ঠিক বুঝে যায়। কিন্তু কেন যে গুঞ্জার সমস্যাটা বুঝতে পারছে না কে জানে!!!! কাল রাতে মায়ের সাথেও একটু কথাকাটাকাটি হয়ে গেল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না গুঞ্জার। এই মুহূর্তে তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজের কেরিয়ারটার এতো বড়ো সর্বনাশ কিছুতেই করতে পারবে না। আজ সকাল থেকে একটা কথাও বলেনি মায়ের সাথে, আজ রাতে যে না ফিরতে পারে সেটাও না। পরে অবস্থা বুঝে ফোনে খবর দিয়ে দেবে। দু-একটা জামাকাপড় ভরে নিয়েছে হাতব্যাগটাতেই। মোহনা বলছিল, ওকে দুটোদিন নার্সিংহোমে থাকতে হয়েছিল। অবশ্য ওর পাঁচমাস হয়ে গিয়েছিল। গুঞ্জার সবেমাত্র সাড়ে তিন চলছে। ডাক্তারবাবুরাও অদ্ভুত মানুষ। সন্তানকে পৃথিবীতে আনবে কি আনবে না, সেই সিদ্ধান্ত একা নেওয়ার অধিকার তার নেই!!!! যেহেতু স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকে, স্বামীর মতটাও প্রয়োজন। তারওপর অনেকটা সময়ও পেরিয়ে গেছে, গুঞ্জার বয়সটাও একটা ফ্যাক্টর।

কাজের চাপ আর দীপ্তেশকে রাজি করাতে গিয়ে কেন যে এতোটা দেরি করে ফেললো, নিজেকেই রাবিশ লাগছে গুঞ্জার। গতদুবার বুঝতে পারার পরেই দুজনে মিলে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, ওষুধেই কাজ হয়েছিল। এবার কি যে হবে কে জানে!!!! একদলা ভয় গলার কাছটাতে পাক খাচ্ছে। ভয় পেলেও পরিস্থিতিটা থেকে উদ্ধার তো পেতে হবে। মোহনা তো এক সপ্তাহ পর থেকেই যথারীতি অফিস জয়েন করেছিল। মোহনার চেনা নার্সিংহোম। ডাক্তারের সাথে ও কথাও বলে রেখেছে। তিন তিনজন ডাক্তারবাবুর সাথে তো গুঞ্জা নিজেও কথা বলেছে, কেউ তো রাজিই হননি। এখন একমাত্র ভরসা মোহনা। আজ একবারও সকাল থেকে ফোন করা হয়নি ওকে। ওর আবার ভুলে যাওয়া স্বভাব আছে। দুটোর সময় স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানোর কথাটা হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ করে দেয় মোহনাকে। হাজার ভাবনার মাঝে কখন যে ট্রেনটা চলতে শুরু করেছে খেয়ালই করেনি। বেশ কিছু প্যাসেঞ্জারও উঠেছে, ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা আর নেই। চোখ আটকে যায় এক গর্ভবতী মহিলার দিকে। মহিলা বললে ভুল হবে নিতান্ত বাচ্চা একটা মেয়ে, এখনও আঠারো হয়েছে কিনা সন্দেহ। ফলের ভারে শীর্ণ গাছটাই যেন নুয়ে পড়েছে। আলগোছে একবার নিজের শরীরটাতে চোখ বুলিয়ে নেয় গুঞ্জা। তার শরীরে কি প্রেগনেন্সির কোন চিহ্ন বোঝা যাচ্ছে!!!! গুঞ্জাদিদির কোন ভালো খবর আছে নাকি গো জেঠিমা? তুমি বলো কি ছাই না বলো, তিন-তিনখানা বাচ্চার জম্ম দিয়েছি, এসব চেহ্নো মিনতির চোক এড়াবে নি। তা অনেকদিন তো হলো বে হয়েছে, এবার তো ঘরে নতুন অতিথি আসা ভালো খবর, তোমাদের কিসের এতো লুকোছাপা বুজিনে বাপু। আমাদের ঘর হলে এতদিনে বাঁজা মেয়েমানুষ বলে বাপেরঘরে বইসে দে যেতো। গুঞ্জাদিদির ছেলে হলি এই মিনতিকে কিন্তু নতুন কাপড় দিতে হবে বলে রাকলাম। কাল মিনতিদি ঘর মুঝতে মুঝতে মাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করছিল, কথাটা ঘর থেকেই কানে এসেছিল গুঞ্জার। যদিও মিনতিদি অনেক বছর কাজ করছে মায়ের কাছে, তবু তো কাজের লোক। তারও যেন ঘুম হচ্ছেনা গুঞ্জার চিন্তায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ বোজে গুঞ্জা। ভিতরে একটা চাপা অস্বস্তি আর ভয় কাজ করছে সমানে, নিজের মনেই সাহস এনে সেটা কাটানোর চেষ্টা করছে।

চোখটা বোধহয় একটু লেগে এসেছিল গুঞ্জার। চুড়িদারের ওড়নাটাতে টান পড়তেই ভেঙে যায় ঘুমটা। একটা বাচ্চা মেয়ে পাশে বসে ওড়নাটা ধরে টানছে। কতই বা বয়স, খুব বেশি হলে চার-পাঁচ বছর হবে বোধহয়। আশেপাশে কোথাও মায়ের কাছ থেকে উঠে এসেছে বোধহয়। গুঞ্জা হালকা হেসে জিজ্ঞাসা করে, কিছু বলবে?

জল খাবো....

কার সাথে এসেছ তুমি? তোমার মা কোথায়?

চুপ করে থাকে, কোন জবাব দেয়না।

গুঞ্জা আবার জানতে চায়, কার সাথে ট্রেনে উঠেছ তুমি? কোথায় যাবে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এবার জবাব দেয়, একাই উঠেছি ট্রেনে।

এইটুকু মেয়ে একা ট্রেনে উঠেছে!!!! আশ্চর্য তো।

একা কেন ট্রেনে উঠেছ, তোমার বাড়ি কোথায়?

কথাটা বোধহয় একটু ধমকের সুরে হয়ে গিয়েছিল। কাঁদতে শুরু করেছে মেয়েটা। এতো মহা জ্বালা। মেয়েটাকে কাছে টেনে নেয়, আহা কাঁদছো কেন? তোমার সাথে কে আছে বলো? তুমি একা একা কি করে ট্রেনে উঠলে?

ততক্ষণে কয়েকজন হকার আর পেসেঞ্জার দাঁড়িয়ে গেছে সামনে। কি হয়েছে দিদি ?

কোন ছেলেধরা চক্করে জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা কে জানে!!!! উফ্ ঝঞ্ঝাট আর ভালো লাগেনা। তবু যতটা সম্ভব পরিস্থিতিটা বোঝানোর চেষ্টা করে সবাইকে। মেয়ে ততক্ষণে গুঞ্জার বাঁহাত জড়িয়ে ধরে সমানে বলে চলেছে, জল খাবো।

আহা দিদি বাচ্চা মেয়ে জল চাইছে, দিন না একটু।

বাধ্য হয়ে জলের বোতলটা বের করে ব্যাগ থেকে। ভর্তি বোতল, ঐটুকু মেয়ে খেতে পারে নাকি!!!! ঢাকা খুলে অল্প অল্প করে ঢেলে দেয় মেয়েটার মুখে।

সবাই জানতে চাইছে কি নাম? কার সাথে এসেছে? কোন্ স্টেশনে উঠেছে?

সবার প্রশ্নে বেচারি ঘাবড়ে গেছে? মুখ গুঁজে দিয়েছে গুঞ্জার কোলে। গুঞ্জা যেন ওর কতদিনের চেনা। মেয়েটার এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলগুলোতে যেন নিজের অজান্তেই হাত বুলিয়ে ফেলে গুঞ্জা।

দিদি আপনি ওকে চেনেন ?

অদ্ভুত প্রশ্নে মেজাজটা গরম হয়ে যায় গুঞ্জার। আপনারা সামনে বসেই তো প্রথম থেকে দেখছেন সবটা। আমি ওকে চিনব কি করে ?

না আমরা এতজন থাকতে হঠাৎ আপনাকে এমন আঁকড়ে ধরলো তো....

এই প্রশ্ন তো গুঞ্জারও....

হকাররা আশেপাশের কম্পার্টমেন্টে খুঁজে আসে, যদি মেয়েটার বাড়ির লোকের খোঁজ পায়। কিন্তু না, কোন খোঁজই পায়নি। মেয়েটা ততক্ষণে গুঞ্জার কোলে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে গেছে।

শিয়ালদা ঢুকছে। সবাই বুদ্ধি দিচ্ছে স্টেশনে জিআরপির কাছে মেয়েটাকে জমা দিতে। ঘটনাটা সবার সামনেই ঘটেছে। সহযাত্রীদের একটু সাথে যাওৎার অনুরোধ করে গুঞ্জা। বেশিরভাগ জনের মধ্যে অযথা ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার আভাস। দু-একজন হকার সাথে যেতে রাজি হয়।

ট্রেন ঢুকে গেছে স্টেশনে। মেয়েটাকে কোল থেকে তুলতে গেলে, আবার ঢুলে পড়ে কোলে। বাধ্য হয়ে ঘুমন্ত মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে ট্রেন থেকে নামে। যথারীতি স্টেশন জুড়ে মানুষের ভিড়। দুজন হকার সাথে আছে শুধু। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই বাকিরা যে যার পথে পা বাড়িয়েছে। আসুন দিদি আমাদের সাথে। ওদের দুজনের পিছুপিছু ভিড়ের মধ্যেই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে গুঞ্জা। পরম নিশ্চিন্তে গলা জড়িয়ে ধরেছে গুঞ্জার।

জিআরপির অফিসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই কথা বলছে গুঞ্জা। ফোন করে মোহনাকেও ডেকে নিয়েছে। একা একা ভীষণ নার্ভাস ফিল করছিল। বাচ্চাটা জেগে গেছে ততক্ষণে। অবাক চোখে দেখছে চারপাশটা। পুলিশগুলো নাম, এটাসেটা জিজ্ঞাসা করায় আরও ঘাবড়ে যাচ্ছে। আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছে গুঞ্জাকে। একজন মহিলা পুলিশ গুঞ্জার কোল থেকে নিতে গেলে কাঁদতে শুরু করে। এতটুকু সময়েই কেমন যেন মায়ায় জড়িয়ে গেছে গুঞ্জাও। কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে বুকটায়। তবু ছাড়তেই হয়। নিজের মোবাইল নম্বরটা তো দিতেই হয়েছে ওখানে। তবু বারবার করে বলে, মেয়েটার বাড়ির লোকের খোঁজ পেলে অবশ্যই যেন ফোন করে জানায় একবার।

মোহনা তাড়াতাড়ি করছে। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের টাইম পেরিয়ে যাবে। জিআরপির অফিস থেকে গুঞ্জাদের বেরিয়ে আসতে দেখে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করেছে বাচ্চাটা। পুলিশটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবু চলে আসছিল। হঠাৎ মেয়েটার মা ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় গুঞ্জা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে গুঞ্জার। গুঞ্জার কষ্টটা বোধহয় বুঝতে পারেন অফিসার। মহিলা পুলিশটাকে ওকে ভেতরে নিয়ে যেতে বলেন। গুঞ্জাকে বলে, আপনি নিশ্চিন্তে যান ম্যাডাম। আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি ওকে ওর বাড়ি পৌঁছে দেব।

স্টেশনের ভিড় কাটিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডের দিকে যাচ্ছে ওরা। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মোহনার থেকে বারবার পিছিয়ে পড়ছে গুঞ্জা।

ট্যাক্সিতে উঠেও উদাস গুঞ্জা। অত টেনশন করিসনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। সাতদিনে একদম ঝাড়া হাতপা হয়ে যাবি।

গুঞ্জা অন্য কথা ভাবছে। সময়টা বড্ড অল্প কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা 'ক্ষণিকের অতিথি' হয়ে গুঞ্জার জীবনে এসে গুঞ্জার ভাবনাগুলোকে কেমন যেন এলোমেলো করে দিয়ে গেলো। আজ প্রথমবার যেন শরীরের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রাণটার অস্তিত্ব অনুভব করছে গুঞ্জা। অনাগত প্রাণটাকে নিশ্চিন্তের আশ্রয় থেকে নিষ্ঠুরভাবে তুলে ফেলতে কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে গুঞ্জার।

হঠাৎ মোহনাকে জড়িয়ে ধরে গুঞ্জা।

চমকে ওঠে মোহনা। কি রে কি হলো!!!!

চল্ ফিরে যাই, যেতে হবে না ডাক্তারবাবুর কাছে। যে আসছে সে আসুক। গুঞ্জার দুচোখে প্রথম মাতৃত্বের লজ্জা।

আজ শুধু গুঞ্জার জন্য অফিসের একটা ছুটি নষ্ট হলো। গুঞ্জার ন্যাকামিতে বেশ বিরক্ত মোহনা। তবু হালকা হেসে গাড়ি ঘোরাতে বলে ড্রাইভারকে।

গুঞ্জার মনে তখন মাতৃত্বের অনুভূতি। অমন কোঁকড়া চুল একটা ফুটফুটে মেয়ে সবসময় তাকে আঁকড়ে থাকবে, ভাবতেই বুকের মধ্যেটায় একটা অজানা সুখের শিহরণ। মোবাইলটা বের করে ব্যাগ থেকে। দীপ্তেশকে ফোন করবে একবার!!!! নাহ্ তার থেকে বরঞ্চ একটা মেসেজ করুক হোয়াটস্অ্যাপে।

"তোমার পরী পৃথিবীতে আসতে আর মাত্র সাড়ে ছটা মাস। সন্ধ্যেবেলা একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখো ডাঃ সরকারের কাছে। ফেরার পথে বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপ চাই আমার। প্রথম বাবা হওয়ার ট্রিট।"

দীপ্তেশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বন্ধ করে দেয় নেটটা। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করছে। মোহনাকে নামিয়ে, ঐ ট্যাক্সি করেই হাওড়া স্টেশনের দিকে রওনা হয় গুঞ্জা।

শিয়ালদা স্টেশনে একবার বাচ্চাটার খোঁজ নিয়ে আসতে মন চাইছিল। কিন্তু গুঞ্জাকে দেখলে হয়তো আবার কান্নাকাটি করবে। ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটার কাছে সারাজীবনের জন্য এক কৃতজ্ঞতায় বাধা পড়ে গেল গুঞ্জা। ঈশ্বর ভক্তি কোনদিনই তেমন নেই গুঞ্জার। তবু আজ সেই ঈশ্বরকেই প্রার্থণা জানায়, মেয়েটাকে খুব তাড়াতাড়ি ওর পরিবার ফিরিয়ে দাও ঠাকুর....