টপিকঃ খেলাঘর part 3 রাইটার মুক্তা রয় অ্যান্ড unspokenwords

দুবছর পর বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছে পার্থিব।বিয়ের পর প্রথম বাপেরবাড়ি এল রত্না।সেই হাসিখুশি উজ্জ্বল মেয়েটাকে দেখছে আবার সবাই।প্রিয়াংশুর কানে খবরটা যেতে দেরী হয় না।প্রিয়াংশুর এক কলিগ রত্নাদের বিশেষ পরিচিত।ঘটনাটা শুনে ভদ্রলোক প্রিয়াংশুকে মনে মনে ভীষণই অপছন্দ করেন,তবে মুখে কিছু বলেন না।এবার তিনি সুযোগ পেলেন জ্বালা ধরানোর।টিফিনে ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ সারছিল প্রিয়াংশু।ভদ্রলোক এককাপ চা নিয়ে এসে বসেন ওর টেবিলে।হাসছেন।
- বুঝলে ভায়া, দেখে এলাম রাজাবাহাদূরের নাতির ছেলেবউকে।শুনেছি ওদের বাড়িটা একটা প্যালেস।দেখার মতো!ইচ্ছে আছে একবার ঘুরে আসার।ওরাও খুব করে বলছে যাবার জন্য, গিন্নিরও শখ তীর্থটা ঘুরে আসার।
প্রিয়াংশু কিছুই বুঝছে না।একটু অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল-
- কার কথা বলছেন, সঞ্জয়দা?
- আরে আমাদের রত্নার কথা রে।বিয়ের পর প্রথম এল।কাল আমাদের খেতে বলেছিল বৌদি।রাজরানী হয়েছে আমাদের মেয়েটা!দেখতেও যে কী সুন্দর হয়েছে!কোলে ছেলে।ভারী ভালো লাগলো ওকে দেখে!ওর বাবা অনিরুদ্ধ সেন বড় ভালো মানুষ ছিলেন, তেমনি ছিলেন সৎ।আমরা যারা সৎ থাকার চেষ্টা করি তারা ভালোই জানি এই ফিল্ডে সৎ থাকাটা কতটা কঠিন-
কথাটা বলেই আর বসলেন না ভদ্রলোক।উঠে চলে গেলেন।
গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে প্রিয়াংশু।তারপর খাওয়া ফেলে উঠে চলে যায়।সমানে মাথায় ঘুরছে রত্না।দিদিরা সম্বন্ধ আনছে।তবে মনমতো সম্বন্ধ পেতে ডিভোর্সী ছেলের একটু বেগ পেতে হয় বৈকি।কেন ডিভোর্স হয়েছিল?তাদের বাড়ির থেকে বলা হয়েছে মেয়ের বাড়ি লুকিয়ে পাগল মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিল।জানাজানি হতে ডিভোর্স।যার জন্য ওরা খোরপোষ চায়নি।চাইবে কোন মুখে?বিয়ে তার প্রায় ঠিক।বালুরঘাটের মেয়ে।এল আই সির অফিসার।বাগডোগরায় পোস্টেড।ওখানেই পি জিতে থাকে।প্রিয়াংশুর মা-বাবা প্রায়ই যাচ্ছেন ওর কাছে খাবারদাবার-গিফ্ট নিয়ে।মেয়েরবাড়ি মুগ্ধ তাদের ব্যবহারে।মা-বাবা যখন করুণভাবে তার ভাবী শ্বশুরবাড়িকে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী বলছিলেন অবাক চোখে তাকিয়েছিল প্রিয়াংশু।নৈতিকতা জিনিসটা লোভের মতোই ছোঁয়াচে।রত্নার থেকে রোগটা তার এল নাকি?
পরদিন নানা অছিলায় রত্নাদের পাড়ার আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করেও রত্নার দেখা পায়নি প্রিয়াংশু।আবার শুনলো ওর ছেলের কথা।বাড়ি ফিরেছে।মা জানালেন তার ভাবী শ্বশুরবাড়ি থেকে আসছে সোমবার পাটিপত্র করতে আসছে।শুনে চুপচাপ ঘরে ঢুকে যায়।সেই খাট,সেই বিছানা, সেই আলমারি, ড্রেসিংটেবিল,রত্নার বইপত্র তেমনটিই আছে।আলমারিটা খোলে।ভর্তি শাড়ি।মার ইচ্ছে কটা নিজের জন্য রেখে বাদবাকি দুই দিদিকে দিয়ে দেবার।বউকে দিয়ে কী লাভ?উল্টে বউ দেখলে ভাববে শাড়িগুলো তারা রেখে দিয়েছে।প্রিয়াংশু জবাব দিয়েছিল, রেখেই তো দেওয়া হয়েছে।ওকে এগুলো ফেরত দেওয়া উচিত।বাবা বললেন, তোর যত্তসব ন্যাকামো।দেখগে গোপনে প্রেম ছিল নাকি ওই ছোঁড়াটার সাথে!বজ্জাত-চরিত্রহীন মেয়েছেলে!শুনে আর দাঁড়ায়নি প্রিয়াংশু।
বিয়ের অ্যালবাম দেখতে বসে।রত্নার খুব শখ ছিল বাইরে হানিমুনে যাওয়ার।যায়নি প্রিয়াংশু।বাচ্চা বাচ্চা করে মাথা কুটতো।ওর ছেলে হয়েছে?কী মনে করে ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ায় প্রিয়াংশু।কোন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।ওদের গলিটার কাছে বড়রাস্তায় বাইকটা দাঁড় করালো।ইতস্তত করছে।হঠাৎ দেখে বড়দোকানটায় পার্থিব দাঁড়িয়ে।কিছু কিনছে টিনছে।পাশে এসে দাঁড়ায়।দোকানী পার্থিবর সামনে এনে রাখলো বড় একটা টেডিবিয়ার,বেবিফুডের প্যাকেট, একটা বেবিক্রিম,আর দু প্যাকেট কন্ট্রাসেপটিভ।ওগুলো গোছাতে গোছাতে পার্থিব তার দিকে তাকিয়ে হাসে।
- কেমন আছো প্রিয়াংশুদা?
- এই চলে যাচ্ছে-
- হুঁ, অনেকদিন পর দেখা।সেই পূর্বার বিয়েতে দেখেছিলাম।
- হ্যাঁ, কবে এসেছ?
- দিন চারেক।ওর অনেকদিন শিলিগুড়িতে আসা হয় না।বাচ্চাটা ছোট ছিল।
- কিছুদিন আছো তো?
- রোববার পর্যন্ত।সামনেই সোনার প্রথম জন্মদিন।একেবারে মা,পূর্বা, অপূর্বও যাবে সাথে।ওদিকে বড়দা, দিদিভাই, ভাগ্নীদুটোও যাচ্ছে।পূর্বা এখন ওখানেই থাকবে।ওদের বাচ্চাটা ওখানেই হবে।আমাদের বাড়িটা একেবারে নার্শারী হয়ে যাবে!
পার্থিব উচ্ছ্বসিত।ম্লান হাসে প্রিয়াংশু।
- ঠিক।তোমার বাচ্চাটাকে একটু দেখতে পারবো?
কাঁপা গলা প্রিয়াংশুর।
- হ্যাঁ, কেন নয়?চল-
প্রিয়াংশু দেখল কন্ট্রাসেপটিভের প্যাকেটদুটো পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল পার্থিব।
- রতন?দেখো কে এসেছে দেখা করতে!
বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল রত্না।কথা শুনে সামনে তাকায়।তারপর তাড়াতাড়ি গায়ে আঁচল দেয়।লোকটা যে কী!কোথাকার উটকো লোকজন এনে বেডরুমে ঢুকিয়েছে!বুদ্ধি নেই ঘটে!বাচ্চা বাবাকে দেখে চনমনিয়ে বা বা করতে করতে বাবার কোলে ঝাঁপ দিল।টেডিবিয়ার বাবাজীকে সমানে খামচাচ্ছে।প্রিয়াংশু দেখে একেবারে বাবার মুখ বসানো ছেলের।
- আক্কেল নেই তোমার?যাকেতাকে নিয়ে ঢুকেছ বেডরুমে!বসার ঘর নেই?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, চল প্রিয়াংশুদা,বাইরের ঘরে গিয়ে বসি আমরা।
- বাবানকে আমার কাছে দিয়ে যাও।সকলের নজর ভালো হয় না।
রত্না উঠে টেডিবিয়ার সহ বাচ্চাকে বাবার কোল থেকে নিয়ে নেয়।পার্থিব প্রিয়াংশুকে বাইরের ঘরে নিয়ে বসায়।একটু পরেই কফি, মিষ্টি নিয়ে হাজির পূর্বা।প্রিয়াংশু খেতে আপত্তি জানালে পূর্বা হেসে বলে বাচ্চা যারাই দেখতে আসছে সব্বাইকে মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে।অগত্যা প্লেট উঠিয়ে নেয় প্রিয়াংশু।কফিতে চুমুক দিচ্ছে, রত্না ঘরে এসে ঢুকলো।পূর্বার কোলে ছেলে।ছটফটিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।প্রিয়াংশু দেখছে রত্নাকে।কী সুন্দরটাই না হয়েছে!ছাত্র পড়িয়ে উঠে আসা সেই ক্লান্ত চেহারার করুণ-বিধ্বস্ত চোখমুখের মেয়েটির মুখে আজ যেন বিদ্যুতের চোখ ঝলসানো আলো!শান্ত অভিজাত ভঙ্গিমায় পার্থিবর পাশে এসে বসল।পরনে দামি শাড়ি, মাথায় অল্প ঘোমটা।এসেন্সের মিঠে গন্ধ ছড়াচ্ছে।
- কেমন আছো?
মৃদু গলা প্রিয়াংশুর।বিব্রত হাসি।রত্না তাকায় প্রিয়াংশুর দিকে।ভাবলেশহীন মুখে অপরিচিতের দৃষ্টি।
- আমাকে চিনছো না?
প্রিয়াংশুর গলায় আকুলতা।
- না।ইনি কে সোনার বাবা?
পার্থিবকে প্রশ্ন করে রত্না।সবাই হকচকিয়ে গেছে।প্রিয়াংশু হতভম্ব।
- আমি তোমার মানে-
কথা শেষ করতে পারে না প্রিয়াংশু।
- ও তাই বলুন।বাচ্চা দেখতে এসেছেন?সোনার বাবার আপনি পরিচিত?তাই না?হ্যাঁ, মনে পড়েছে।আমার স্বামীর কাছে শুনেছি আপনার স্ত্রী অসুস্থ।ট্রিটমেন্ট করতে অনেক খরচ হচ্ছে নিশ্চয়ই?
- না মানে-
- মানে আপনি আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আছেন।দেখি কী করতে পারি।
উঠে চলে যায় রত্না।পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসে।প্রিয়াংশু উঠতে নিয়েছিল।রত্না দাঁড়াতে বলে।তারপর একটা চেক নিয়ে বাচ্চার নজর বাঁচিয়ে প্রিয়াংশুর
হাতে দেয়।প্রিয়াংশু দেখে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক।
- একি করছ?আমি-
কথা বলতে পারছে না প্রিয়াংশু।দেখলো চেকটা প্রিয়াংশু দত্তর নামে কাটা।
- বাচ্চার নজর বাঁচালাম।পশ্চিমে এর চল আছে।চেকটা নিয়ে ভাববেন না।বেনারসের ঘোষবাড়ির বহুরানী মিসেস রত্না ঘোষ আপনাকে এটা দিচ্ছে।এ রকম পাঁচ-দশটা চেক কাটার ক্ষমতা তার আছে।
- কিন্তু আমি-
নিভে আসা গলা প্রিয়াংশুর।
- চিন্তা কর না প্রিয়াংশুদা।ও সজ্ঞানেই তোমায় চেকটা দিল।এটা কাউকে মুক্তি দেবার জন্য।দানধ্যানের কাজ আমার স্ত্রী বহু করে।এমনকি ওখানকার মহিলা মহাবিদ্যালয়ের ও অধ্যাপিকাও।টাকা নিয়ে করে না।পড়াশুনো, পড়ানো জিনিসটাকে খুব ভালোবাসে।তাই নেশাটা ছাড়তে পারেনি।ঘন্টাখানেক একটু পড়িয়ে আসে মনের আনন্দে।
ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে প্রিয়াংশু।চুপ করে বসে আছে।রত্না বাচ্চাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল পূর্বার সাথে।রাত বেড়ে চলেছে।
- যে অবস্থায় ওকে তুমি বিয়ে করেছ কোন ছেলে চিন্তাও করতে পারবে না!তুমি ওকে ভালো করে তুলেছ,সুখী করেছ।সত্যি তুমি ধন্য পার্থিব-
- একটু ভুল বললে প্রিয়াংশুদা।আমি ধন্য ঠিকই, তবে জীবনে ওকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে ধন্য।কজন জানে ওর মতো ভালোবাসতে?সংসার-সন্তান-স্বামী অন্ত প্রাণ!কজনের থাকে এই গুণ?ওকে আমি জীবনে পেয়েছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
শান্তভাবে কথাগুলো বলে পার্থিব।
- আমি বড্ড ভুল করেছি রে!চূড়ান্ত ভুল!
দুহাতে মুখ ঢাকে প্রিয়াংশু।
- দাদাভাই, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে।সোনা ঘুমিয়েছে।বৌদি তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
রত্নার ছোড়দা-মা রাগে, ঘেন্নায় বাইরে আসেননি।পূর্বাই জানান দেয় দাদাকে।
- হ্যাঁ আসছি।তোরা বস।
- হুঁ, তোকে ছাড়া বৌদি কোনদিন খায়?সোনা বুকের দুধ টানে।ওর খিদে পেয়েছে।তাছাড়া বৌদিকে জানিস তুই।তোকে ছাড়া কতক্ষণ থাকবে?
বলেই দুষ্টুটা পালালো।পার্থিব জানে ইচ্ছে করেই প্রিয়াংশুদাকে শুনালো কথাটা।প্রিয়াংশু তাকিয়ে দেখে পার্থিবর চোখমুখ লাল।
- যাও ভাই।তোমাদের দেরী করে দিলাম।
উঠে দাঁড়ায় প্রিয়াংশু।পার্থিব ওকে এগিয়ে দিতে দিতে অপ্রতিভ হাসে।
- ও কিছু নয়।ওখানেও আমাদের খেতে খেতে সাড়ে দশটা হয়েই যায়।সোনা দশটার আগে ঘুমুতেই চায় না।দাদু-ঠামার আহ্লাদে মারাত্মক দুষ্টু হয়ে উঠছে!সন্ধ্যেটা মা-বাপীই ওকে নিয়ে কাটান।কদিন নাতিকে না পেয়ে কী যে ছটফট করছেন বলার নয়!খালি ফোন-
প্রিয়াংশু পার্থিবর দিকে তাকায়।গেটের কাছে আতরগোলাপ গাছটা গন্ধ ছড়াচ্ছে।গুণণ্ডণ করে গজলের সুর ভাঁজছে পার্থিব।ভারী মিষ্টি গলা।বোঝা যায় রেওয়াজ করা।রত্নাও তো ভালো গান জানে।দুজনে সন্ধ্যেবেলা কত না জানি গান গায়!তারপর রাতের বাসর।পার্থিবকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী, সবচাইতে উজ্জ্বল মানুষ মনে হচ্ছে প্রিয়াংশুর।বাচ্চা কোলে ওর জন্য ওর বউ ঘরে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়াংশুর মনের কথা অজানা নয় পার্থিবর।সস্মিত হেসে মাথা নাড়ে।বলতে পারে না, আমার রতনের না হয় ভাগ্যক্রমে এক নীরব পূজারী ছিল, কিন্তু সব মেয়ের সে ভাগ্যটুকুও থাকে না।পরিত্যক্ত হয়ে কত রতন পথের ধূলায় গড়াগড়ি খেতে খেতে ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে যায়!
"আসি" বলে বাইকে স্টার্ট দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় প্রিয়াংশু।এ জীবনটা তো তারও হতে পারতো?পরক্ষণেই চোখে পড়ে হাতে ধরা কালো জমাটবাঁধা অন্ধকারটা।চার নম্বর ডলটা তার নয়।কোথার থেকে যেন আধো আধো বা বা ডাকটা বুকে এসে আঘাত করল!দেখলো পার্থিব বাড়িতে ঢুকে গেল।বাচ্চাটার জন্য কেনা হারটা পকেটেই রয়ে গেছে।
সমাপ্ত
গল্পটি সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা মুক্তা সাহায্য না করলে গল্পটা লেখা হত না আমি মাঝপথে ছেড়ে দিয়াছিলাম পেন দিয়া কান্না লিখতে কার ভাললাগে শেষ পর্বের অনেকটা মুক্তা দিদির চিন্তার  fosol