টপিকঃ খেলাঘর part 1 রাইটার মুক্তা রয় অ্যান্ড unspokenwords
রত্না হাসিহাসি মুখে বড়দির কাছে লীভ অ্যাপ্লিকেশনটা জমা দিল।বড়দি হাসছেন দেখে লজ্জায় তাকাতে পারছে না।কলিগরা রত্নাকে ঘিরে রয়েছে।
- দেখিস রত্না,বরকে পেয়ে আবার আমাদের ভুলিস না।
নীলিমা ঠাট্টা করে।রত্না হাসে।লাজুক হাসি।বড়দি বলেন-
- না না, মাত্র চারদিনের ক্যাজুয়াল নিয়ে বিয়ে করছে!আমিই তো মেডিক্যাল নিয়েছিলাম টানা পনের দিনের।
- তুই রত্না বড় ছুটি নিলি না কেন?
- ওই না করেছে।শুধু শুধু ছুটি নিয়ে কী লাভ?
- খুব ভালো বর হয়েছে রে তোর!আমারটা তো খালি বলে ছুটি নাও।চল ওখানে চল সেখানে।বেড়ানোর রাজা!আমার যে এটা চাকরি বুঝতেই চায় না-
অনুযোগ করে সুপ্রিয়া।
- না না।সত্যি রত্নার হবু বর দারুণ বুঝদার!তুই লাকি রে রত্না।আমারজন খালি চাকরি ছাড়তে বলে।আমি বলেছি, তোমায় ছাড়তে পারি, কিন্তু চাকরি নয়।
হাসতে হাসতে রিমার্ক করে মৌসুমী।বাকীরা হাসছে।
- আচ্ছা, কাল রোববার, পরশু বিবাহবাসরে তোর সাথে আমাদের দেখা হচ্ছে তাহলে?
সবাই হেসে মন্তব্য করছে।কোনমতে কলিগদের হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করে বাড়ি পালায় রত্না।বাড়িতে লোকজনের ভীড়।আর একচোট হাসাহাসির মধ্যে পড়ে।নিজের ঘরে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় বড়বৌদির কাছে।
রত্না চাকরি করছে বছর দুয়েক হল।ছাব্বিশ বছর বয়স।মাস্টার ডিগ্রির স্কেল পায়।চিরকালের নির্বিবাদী, ঠাণ্ডা, চুপচাপ মেয়ে।দারুণ মেধাবী ছাত্রী।শ্যামাঙ্গী, ছিপছিপে, লম্বা চেহারা।তুখোড় সুন্দরী না হলেও মুখে আলগা শ্রী আছে।ওর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কালো টানা দুটি টলটলে চোখ আর জোড়া সুন্দর ভ্রূ।সব মিলিয়ে রত্নার রূপে আছে গহন বনের হাতছানি।ওর বড়বৌদি তাই ঠাট্টা করে বলে,'মোদের রতনের গহন বনে, কোন মুনিঋষি বসবে ধ্যানে।তা ঠাকুরঝি, কাশীর বিশ্বনাথ বর আসবে মনে হচ্ছে?'কথা শুনে রত্না লজ্জায় মার পেছনে গিয়ে লুকোয়।দুই দাদার পর একমাত্র বোন রত্না বাড়ির সকলের ভীষণ আদরের।বড়দার বিয়ে হয়েছে, ছোড়দার এখনো হয়নি।বড়দা থাকে বউ নিয়ে দুর্গাপুর।ওখানে পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার।ছোড়দা শিলিগুড়ি পলিটেকনিকের লেকচারার।বাবা কাজ করতেন পি.ডব্লিউ. ডিতে।তিন বছর হল গত হয়েছেন।
রত্নার বিয়ে হচ্ছে শিলিগুড়িরই ছেলে প্রিয়াংশুর সাথে।চেনাশুনো ছেলেটা।চাকরি করছে পি.ডব্লিউ. ডি অফিসে।ওরা দুবোন এক ভাই।দুই দিদিরই বিয়ে হয়েছে।বাবা পোস্টাপিসে চাকরি করতেন।রিটায়ার করেছেন।ওদের বাড়ি সুভাষপল্লী।অনেক বড় বড় চাকুরে সম্বন্ধ এসেছিল রত্নার।বাইরের সব।মা আর ছোড়দা বলেন, বাইরের ছেলে কেমন হবে, স্বভাবচরিত্র কী হবে তা জানার উপায় নেই।তাছাড়া বাইরে বিয়ে দিলে রত্নার চাকরির কী হবে?সেই সময় বড়বৌদিও একটা সম্বন্ধ এনেছিল।ওদের কেমন আত্মীয়।খুবই অবস্থাপন্ন প্রবাসী বাঙালি।ছেলেটা ব্যবসায়ী শুনে ছোড়দা নাক শিঁটকোয়।বড় ব্যবসায়ী যখন ক্যারেকটার লুজ হতে পারে।কাঁচা টাকা ওদের, তাদের মতো গোনা পয়সা তো নয়।বড়বৌদি বোঝাতে থাকে, দেখতে-শুনতে, স্বভাবে খুব ভালো ছেলে।রতনকে সুখে রাখবে।কমতির মধ্যে বয়সটা একটু কম রতনের চেয়ে।এই আট-ন'মাস-রতনের জন্ম বৈশাখে আর ওর অঘ্রাণে।আজকাল ভালো ছেলে দেখলে এদিকে কেউ দেখে না।গিয়ে আলাপ করতে দোষ কোথায়?বিশ্বনাথ দর্শনও হবে আবার মেয়ের বিয়ের কথাও।শুনে একটু রাজী হয়েছিলেন মা।বৌমা ভীষণ দায়িত্বশীল, বুদ্ধিমতী মেয়ে।ওর কথার ওজন আছে।দেখাই যাক।ছোড়দাও নিমরাজী হয়।ঠিক সেই সময় এই সম্বন্ধটি এল।ভীষণ পছন্দ ওদের রত্নাকে।ছেলের বাবা তো প্রতিদিনই আসছেন সন্ধ্যাবেলায় এবাড়ি বেড়াতে।সাথে কোন কোনদিন স্ত্রীও থাকেন।সঙ্গে আনেন খাবারদাবার।লজ্জা পান রত্নার মা-দাদারা।তবে ওনাদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ সকলেই।আর ঘরোয়া-মিষ্টি ছেলেটাকেও ভালো লেগেছে সবার।সবচেয়ে বড় কথা ওরা রত্নার চাকরির পক্ষে।এই বাজারে কেউ চাকরি ছাড়ে নাকি?সুতরাং হাতের কাছে সোনার টুকরো ছেলে পেয়ে ওই ব্যবসায়ী, কমবয়সী প্রবাসীর হাতে কে মেয়ে দেয়?
সুখের সায়রে সাঁতার কাটছে রত্না।চারদিন পরে আবার স্কুলে জয়েন করেছে।এদিক ওদিক টুকটাক ঘুরে বেড়ানো, রান্নাঘরে শাশুড়িমাকে সাহায্য করা,আর বাড়ির সবার সাথে গল্প করা-দারুণ মজায় কাটছে দিনগুলো।প্রিয়াংশুর সাথে মাকে দেখতেও যায়।সবাই বলে রত্নার মুখে যেন আলো ঠিকরে বেরচ্ছে।কলিগরা ফাজলামো করে, স্বামীর সোহাগের আলো।
প্রথম থমকে যায় রত্না যখন প্রিয়াংশু বলল মাইনেটা ব্যাঙ্কের থেকে তুলে ওর মার হাতে দিতে।রত্নার সপ্রশ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,'এটাই এবাড়ির রীতি।'আর কোন প্রশ্ন করেনি রত্না।ঠিকই তো,গুরুজনের হাতে দেওয়াটা ভালো দেখাবে।গোটা ধরেই এনে দেয় শাশুড়িমার হাতে।ভাবে উনি দেখে হেসে নিশ্চয়ই তাকে আবার ফিরিয়ে দেবেন সব।তখন রত্না কিছু টাকা ওনার হাতে দিয়ে দেবে হাত খরচের জন্য।কিন্তু শাশুড়িমাই তাকে শুধুমাত্র হাতখরচের টাকাটা দিয়ে বাকি সব তুলে রাখলেন নিজের আলমারিতে।পরের মাসেও তাই।প্রিয়াংশু হেসে বলল, 'ভয় নেই, তোমার টাকা সুরক্ষিত থাকবে।এলেবেলে ভাবে খরচ হবে না।তোমাদের মেয়েদের তো খালি শাড়িগয়নার নেশা!' কতগুলো টিউশনি যোগাড় করে এনে দিল রত্নাকে।বলল অঙ্কের টিচারের দারুণ দাম।শুধুশুধু বসে না থেকে স্কুল থেকে ফিরে এক ব্যাচ পড়ালে মন্দ কী?রত্না মনে মনে বলে, তাই কী ওরা অঙ্ক,ইংরেজি বা বিজ্ঞানের উচ্চমেধাসম্পন্ন পাত্রী চেয়েছিল?
সাত আট মাসের মধ্যে রত্না দেখল সে সকাল সাড়ে ছটার থেকে নটা সাড়ে নটা পর্যন্ত টিউশনি করে।তারপর স্নানটান সেরে নাকেমুখে কোনমতে একটু খেয়ে স্কুল।আবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে নটা দশটা পর্যন্ত টিউশনি।মেশিনের মতো খেটে যাচ্ছে!অথচ টাকার দেখা কিন্তু পায় না।সমস্ত টাকাই কালেকশন করেন তার শ্বশুরমশাই।বলেন,'রত্না ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারবে না।ছেলেমেয়েগুলো আজকাল ভীষণ পাজী।বাড়ির পাঠানো টাকা টিচারকে না দিয়ে সবটা নিজেরা খরচ করে।'যদিও উনি টাকাগুলো আর বৌমাকে না দিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেন।রত্নার বাপেরবাড়ি অবস্থাপন্ন, অভিজাত।এসব ছোটখাটো ব্যাপার মাকে বলবে কল্পনাই করতে পারে না পি.ডব্লিউ. ডির পদস্থ ইঞ্জিনিয়ারের আদরিনী কন্যা।নেহাত শখেরই চাকরি ছিল তার বিয়ের আগে।আর আজ কিভাবে জানাবে বৌমার টাকার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন এঁরা?হয়তো ব্যাপারটা সাময়িক।ও একটু গুছিয়ে নিলেই হাল্কা হয়ে যাবে রত্না।এখনই তো পরিশ্রমের সময়।নিজের মনে সান্ত্বনা দেয় রত্না।
অতিরিক্ত পরিশ্রমে শরীরটা বেশ কাহিলই লাগে আজকাল রত্নার।সারাটা দিন ধরে পড়ানো!একঘেয়ে কাজ করতে করতে মন তিক্ত, মাথা ক্লান্ত।কত যত্ন করে রান্না শিখেছিল, কিন্তু এঁদের তার রান্না বা ঘরকন্যার কাজ নয়,তার অর্থই বড্ড প্রিয়।এমনকি প্রিয়াংশুর জন্য একটা সোয়েটার করবে ভেবেছিল, ও সপাটে না করে!এদিকে শাশুড়িমার শরীর ঠিক নেই, সেও টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত।ফলে রান্নার বউয়ের অখাদ্য রান্নাই গিলতে হয়।আজকাল আবার অরুচি হয়েছে তার।কিছুই ভালো লাগে না খেতে।
টিউশনির ব্যাচটাকে ছেড়ে দিল রত্না।কিছুতেই পারছে না পড়াতে।সমানে বমির ভাব আসছে!গিয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে থাকে।তারপর আর পারে না সামলাতে।নালার কাছে গিয়ে হড়হড়িয়ে বমি।অথচ তার গ্যাস-অম্বল হয়নি!দাঁড়াতেই পেছনে দেখে শাশুড়িমা।
- তোমার শরীর ঠিক আছে তো বৌমা?গতমাসে-?
- না মা।
- হুঁ-
মুখ কালো করে চিন্তিত মুখে চলে যান শাশুড়িমা।রাতে খেতে গিয়ে দেখে সবাই কেমন গম্ভীর।প্রিয়াংশুর মুখ থমথমে!
- এজন্যই তোমাকে নিয়ে যেতে চাই না কোত্থাও।নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারো না!চাহিদা তোমার এত বেশি-
শুতে শুতে প্রিয়াংশু কথাটা রত্নার দিকে ছুঁড়ে দিল।বিস্ময়ে-ব্যথায় কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে রত্না।তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ে।হলং গিয়েছিল দুজনে।প্রিয়াংশুর ইচ্ছে ছিল না।গাদা টাকা খরচ।বাড়িতে হাত দিচ্ছে, প্ল্যান রেডি।রত্নার জোরাজুরিতেই রাজী হয়।
পরদিন থেকে দারুণ নরম ব্যবহার প্রিয়াংশুর।শ্বশুর-শাশুড়িও বেশ সদয়।রত্নাও খুশি।হয়তো বাচ্চা হবে এই আনন্দে সবাই সন্তুষ্ট বৌমার ওপর।
দিন তিনেক পর প্রিয়াংশুর সাথে গাইনি দেখাতে যায় রত্না।ইউরিন টেস্ট পজেটিভ এসেছে।সাথে শাশুড়িমা।একটু বিরক্তিই ধরে।লজ্জাও লাগছে।স্বামী যেখানে আছে শাশুড়িমার আসার কী দরকার?তখনও বোঝেনি রত্না যে দরকারটা কী।
বাড়ি যখন ফিরলো বুঝলো তার ভেতরের প্রাণটা আর নেই।একরকম জোর করে তাকে অন্ধকারে রেখে অ্যাবরশন করানো হয়েছে।বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে রত্না।যখন সে পড়াশোনা করত আর চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা ভাবতো তখন একবারও ভাবেনি তার চাকরিই তার সন্তানের জীবন কেড়ে নেবে।তার সন্তানও কাম্য নয় এদের কাছে!সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আর এত গাদাগাদা টিউশনি করবে কে?চুপচাপ হয়ে গেছে রত্না।তার দুঃসহ অভিজ্ঞতা কাউকে বলার নয়।কলিগরা জিজ্ঞেস করে।হেসে পাশ কাটায়।মাও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু পড়ার চেষ্টা করেন।রত্না হেসে ভোলায়।পৃথিবীর কাছে নিজেকে সুখী দেখানোর চেষ্টায় কমতি নেই।
ছোড়দার বিয়ে।রত্নার শ্বশুরবাড়ি থেকে বউকে দামি গয়না দিল।প্রিয়াংশু মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে।বেশ কাজকর্মও করছে শালার বিয়েতে।শাশুড়িমা এসে হেসে হেসে গল্প করলেন, এয়োর কাজ করলেন।তবে রত্না বিশেষ সময় দিতে পারলো না।তার হায়ার সেকেন্ডারী আর মাধ্যমিকের দলটিকে ছুটি দিতে পারেনি।সামনে পরীক্ষা ওদের।
ছোড়দার বউ বারাণসীর মেয়ে।শিলিগুড়িতে উঠিয়ে এনে বিয়ে হচ্ছে পূর্বার।সাড়ে চব্বিশ বছরের হাসিখুশি মিষ্টি মেয়ে।ওখানে একটা ফার্মে কাজ করত।ছেড়ে দিয়েছে।ওর দাদা পার্থিব বলল,'বোন
সি.এ করেছে।চাকরি পেতে আশা করি অসুবিধে হবে না।যদি ও চায় করবে চাকরি।মেয়েদের চাকরি করা বা না করা সম্পূর্ণ ওদের নিজস্ব ব্যাপার।শ্বশুরবাড়ি বা বাপেরবাড়ি কারও জোর খাটে না।'কথাটা ভালো লেগেছিল রত্নার মা,দাদাদের।ঠিকই।পূর্বা যা চায় তাই হবে।
রত্নার ভালো লেগেছে পূর্বাদের পরিবারটা।তাদের অনুরোধেই শিলিগুড়িতে মেয়ে এনে বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন।রত্নাদের ঊননব্বই বছরের দিদিমার ছোটনাতির বিয়েটা দেখার ভীষণ ইচ্ছে।জানুয়ারির প্রবল ঠাণ্ডায় ওনাকে এবাড়ি ওবাড়ি নাড়ানোই কঠিন।এছাড়া আরও কিছু বয়স্ক মানুষ আছেন যাঁরা অতদূর বরযাত্রী যেতে পারবেন না।যেমন, দুই জ্যেঠু, বড়মামা, বড় দুই মেসো,এক পিসেমশাই।এঁদের সকলের বিয়েতে উপস্থিত থেকে বিয়েটা দেখার ইচ্ছে।রত্নার মা চিন্তায় পড়েছিলেন।না পেরে শেষে সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখেন মেয়ের সামনে।ভীষণ সজ্জন মানুষ তাঁরা।এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন।পরে বেনারসে পার্টি দেবেন মেয়ে-জামাই নিয়ে।মা-বড়দারা যাবেন তখন।তবে রত্নার যে যাওয়া হবে না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।বেনারসে ওদের বিশাল ব্যাবসা।পূর্বার দাদা
সি.এ করে এম.বি.এ করেছে।ব্যাবসাটা ওই বেশি দেখে।ওদের বাবা বললেন উনি এখন রিটায়ারের পথে।পার্থিব প্রায় রত্নারই বয়সী।দুবার এসেছিল রত্নাকে নিতে তার শ্বশুরবাড়ি।ছাত্র পড়াচ্ছিল রত্না।পার্থিব বাইরের ঘরে বসে ম্যাগাজিন দেখছিল।রত্না রেডি হয়ে বেরিয়ে এলে হেসে বলল-
- ব্যাপার কী বলুন তো?ভাইয়ের বিয়ে আর বোন খালি ছাত্র ঠ্যাঙাচ্ছে!কটাদিন ছুটি নেওয়া যেত না?তারপরই কিছু বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল।মুখের হাসি মিলিয়ে যায় পার্থিবর।সবার কাছে লুকিয়ে রাখলেও এক আধচেনা ভিনদেশীর কাছে ধরা পড়ে যায় রত্না।
- চলুন, আপনার জন্য অপেক্ষায় আছেন মাসীমা-
শান্ত গলায় কথাটা বলে পার্থিব।
একই ঘটনা ঘটে রত্নার ছোড়দা অপূর্বর বৌভাতের দিনটায়।রত্না মাধ্যমিকের ব্যাচটাকে পড়াচ্ছে।সকাল দশটা মতো হবে।বাইক নিয়ে রত্নাকে নিতে হাজির পার্থিব।পার্থিবকে আধঘন্টার ওপর বসারঘরে বসিয়ে ব্যাচটাকে ছেড়ে দিয়ে সেজেগুঁজে যখন বেরিয়ে আসে রত্না পার্থিবর চোখে মুগ্ধতা।
- প্রিয়াংশুদা খুব লাকি!আপনার মতো স্ত্রী পেয়েছেন উনি!আমি এমনটি দেখিনি-
পার্থিবর কথায় ম্লান হাসে রত্না।পার্থিব রত্নাকে পৌঁছে দিতেই হৈহৈ করে ওকে নিয়ে যায় প্রিয়াংশু।দেখে একটু হাসে পার্থিব।সাড়ে নটা পৌনে দশটা নাগাদ যখন মাসীমা বললেন জামাইকে মেয়েটাকে একটু নিয়ে আসতে, ওর প্রিয় মটরশুঁটির কচুরি আর আলুরদম হচ্ছে-ভদ্রলোকটি হেসে জানালো, 'প্রফেশনালিজম মা।ব্যাচ পড়াচ্ছে।কম্পিটিশনের বাজার।কখন ছাড়বে জানা নেই।ও রিক্সা করে চলে আসবে।'
আনন্দে গল্পে ভালোই কাটে সারাদিন রত্নার।হঠাৎই রাতের দিকে শরীরটা খারাপ লাগছে।একটু দূরেই এক ভবনে বৌভাতের আসর বসেছিল।কবার বলল প্রিয়াংশুকে রত্না,'একটু চল না।শরীরটা আমার ভালো লাগছে না।ভীষণ মাথা ধরেছে!'গল্পে ব্যস্ত প্রিয়াংশু কোন পাত্তা দিল না।
অগত্যা একাই বেরিয়ে আসে রত্না।কয়েক পা এগিয়েছে।পেছন থেকে ডাকে পার্থিব।
- চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
- না না, তার দরকার নেই।এমন কিছু নয়-
- বাহ্ রে!আমি ওই মজলিসে ছিলাম।বুঝেছি আপনি অসুস্থ বোধ করছেন।আপনাকে একা ছাড়া যায়?
রত্না এসে শুয়ে পড়ে।পার্থিব জল এনে দেয়।জলটা খায়।তারপর হঠাৎ বমির ভাব আসে।তাড়াতাড়ি গিয়ে নালায় বমি করে উঠতে নিয়ে পড়ে যায়।হুঁশ নেই কোন।
জ্ঞান ফিরতেই দেখে সে শুয়ে আছে মায়ের বিছানায়।পাশে বসে পার্থিব তার মাথায় হাত বুলোচ্ছে।
- ডাক্তার ডাকি?যা ভয় পেয়েছিলাম!প্রিয়াংশুদার মোবাইলে ফোন করেছি।এল বলে প্রিয়াংশুদা।এলে বকতে বলব।আপনি নিজের যত্ন-
পার্থিবর কথা শেষ হবার আগেই প্রিয়াংশু হাজির।থমথমে মুখ।
- প্রিয়াংশুদা, গিন্নিকে সামলান-
বেরিয়ে যায় পার্থিব।বুঝছে প্রিয়াংশুদা অসন্তুষ্ট হয়েছে।হয়তো পার্থিবর ইন্টারফেয়ার পছন্দ হয়নি।যাকগে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে না যাওয়াই ভালো।
- কী ব্যাপার তোমার?বমি হয়েছে শুনলাম?আবার পেটে কিছু আসেনি তো?কতদিন তোমাকে বলেছি সাবধানে চল।তোমার এত ক্ষিদে কেন বলত?বাচ্চা এলে পড়াবে কী করে?
- তা বলে কী বাচ্চা নেব না?
- কেন নেব না?চার-পাঁচটা বছর যেতে দাও।দুজনে মিলে সংসারটাকে দাঁড় করাই আগে।সময় তো ফুরিয়ে যায়নি।
- সংসার তো দাঁড়িয়েই আছে।কোন অসুবিধে তো নেই-
- যা বোঝ না তা নিয়ে তর্ক কর না রত্না-
পার্থিব যেতে যেতেও বারান্দায় থমকে দাঁড়িয়েছিল।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে যায়।মেয়েরা যতই শোষণের হাত থেকে বেরনোর চেষ্টা করুক, নতুন ধরনের শোষণযন্ত্র তৈরি তাদের প্রাণরস শুষে নিতে।পূর্বকালের একাদশি করা বাল্যবিধবার সাথে আজকের স্বাবলম্বী রত্নার কী সত্যি কোন তফাৎ আছে?
পরদিন পার্থিব দেখে রত্নার চোখমুখ কালো, শুকনো।যাবার আগে বলে-
- নিজেকে ঠকাবেন না প্লিজ-
তবুও রত্না নিজেকে ঠকায়।দিন সাতেক পর আবার গাইনি দেখাতে নিয়ে যায় স্বামী ও শাশুড়ি।ফিরে এসে বোঝে তার দেহের নতুন প্রাণটা নেই।কান্নায় ভেঙে পড়ে।প্রিয়াংশু এক্সকিউজ দেয় তার সোনোগ্রাফি রিপোর্ট ভালো নয়,তাই-।শুনে এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছিল রত্না প্রিয়াংশুর আনা দুধের গ্লাস।দিন সাতেকের মেডিক্যাল নিল শরীর খারাপের জন্য।এদিকে প্রিয়াংশুর বাড়ির কাজ চলছে পুরোদমে।
দশই বৈশাখ রত্নার জন্মদিনে তাকে দামি কাঁথা স্টিচের সিল্কের শাড়ি দিলেন শাশুড়িমা।ঘরোয়া অনুষ্ঠান হল।সবাই ধন্য ধন্য করে।রত্না ভাগ্য করে শ্বশুরবাড়ি পেয়েছে।এর দিন পাঁচেক পর তৃতীয়বার গাইনির কাছ থেকে ফিরল রত্নাকে নিয়ে ওর
স্বামী-শাশুড়ি।গাইনি ওয়ার্নিং দিয়েছেন, এত অ্যাবরশন হলে ফ্যাটাল কিছু হতে পারে।আর যেন অ্যাবরশন করা না হয়।সাবধানে চলতে হবে মাসখানেক।স্বামীর আনা খাবার ঢিল মেরে ফেলে দিল রত্না।না খেয়ে কাটালো দিনটা।দিন পনেরর মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়াল একটা টিউশনিও নেই রত্নার।অস্বাভাবিক পাগলাটে আচরণের জন্য গার্জিয়ানরা ছেলেমেয়েদের আর রত্নার কাছে পাঠায় না।স্কুলেও যায় না রত্না।কলিগরা তাকে বোঝাতে এসেছে।কাউকে কিচ্ছু বলে না।ঘোলাটে চোখে তাকায় সবার দিকে,তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।সবাই তো অবাক।কোত্থাও কোন অশান্তি নেই, এত ভালো স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন।আপ্রাণ চেষ্টা করছে রত্নাকে একটু ভালো রাখার।কী হল মেয়েটার?পাগল হয়ে যাচ্ছে নাতো?
দুমাসের ওপর হল স্কুলে যাচ্ছে না রত্না।কারও সাথে কথাও নেই কোন।প্রিয়াংশু চুপচাপ এসে ডিভোর্স পেপারটা ধরায় রত্নাকে।রত্নার ছোড়দা আর মাকে ডেকেছেন প্রিয়াংশুর বাবা-মা।
- নিজের মেয়ে করে রেখেছিলাম ওকে আমরা।ঘরের কুটোটি ভাঙতে দেইনি দিদি।পড়াশুনো নিয়ে থাকতে ভালোবাসে,তাই থাকুক।কিন্তু সবই কপাল!
আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন প্রিয়াংশুর মা।সমানে কেঁদে চলেছেন রত্নার মা রমাদেবী।
- সেতো আমরা জানি দিদি।কিন্তু-
রমাদেবীর কথা শেষ হয় না।রত্নার শ্বশুরমশাই গলা খাঁকার দিলেন।
- বৌমাকে আর আমরা রাখতে পারবো না।একটা ছেলেপুলে হল না আড়াইটে বছরে!এসে নষ্ট হয়ে যায়!তাও মেনে নিয়েছি।ঘরের কাজ করে না, টিউশনি-স্কুল নিয়েই ব্যস্ত, সেও সহ্য করেছি।কিন্তু পাগল নিয়ে তো আর থাকা যায় না।প্রিয় আমাদের একমাত্র ছেলে-
এই কবছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাড়িটার।হালফ্যাশনের পাথরবসানো বাড়ি হয়েছে আটপৌরে, পুরনো, ঝরঝরে পাকাবাড়ির জায়গায়।অর্থের চাকচিক্য রত্নার শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী সকলের শরীরে।ওনারা অবশ্য ছেলের বিয়েতে নগদ ক্যাশ নেননি।পণবিরোধী অনেক কথাও বলেছেন সেই সময়ে।ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে চুপচাপ সই করে দেয় রত্না।তৃতীয়বার অ্যাবরশনের পর এদের বলেছিল, চাকরিই অন্তরায় আমার সন্তানের।তাই ওটা আমি ছেড়ে দেব।কথাটা শুনে শাশুড়ি তাকে ছেলের সামনেই বলেছিলেন, তাহলে আমার ছেলে তোমাকে ছেড়ে দেবে।তখন বাচ্চাটা কোন পথে আসবে?মা-ছেলে দুজনের ব্যাঙ্গের হাসিটা ভুলতে পারছে না রত্না।
ছোট একটা স্যুটকেস নিয়ে বেরিয়ে আসে রত্না ছোড়দা-ছোটবৌদির সাথে।গয়নাগুলো প্রিয়াংশুর মার কাছে আছে।উনি বলেছেন লকার থাকে উঠিয়ে দিয়ে যাবেন।রত্না জানে উনি আর সেগুলো ফেরত দেবেন না।অতি ভদ্র মা-ছোড়দা আর চাইতেও যাবে না।
ফিরে এসে আরও গুম মেরে গেছে রত্না।মুখে একটা কথাও নেই।ছোটবৌদি বহু কষ্টে দুটো-চারটে কথা-গল্প করে।স্কুলে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে।কেউ বুঝছে না কেন এমনটা হল।মা রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।বাকীদেরও মন ভীষণ খারাপ।