টপিকঃ গো-হত্যা--হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-বিভেদের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
গো-হত্যা--হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-বিভেদের ঐতিহাসিক পর্যালোচনা (প্রথম পর্ব)
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভেদের কতগুলি কারণ আছে, সেগুলির মধ্যে গো-হত্যার ও গো-রক্ষার সমস্যাটি ছিল সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং সব চেয়ে মারাত্মক। গোহত্যিা নিয়ে দাঙ্গা, খুন, মোকদ্দমা সবই সংঘটিত হয়েছে। মুসলমানরা গো-হত্যা করে ও গো-মাংস ভক্ষণ করে। তারা ঈদুল আজহা’ বা কোরবানি উৎসবে ছাগ, মেষ, মহিষ, উট, দুষ্কবার সঙ্গে গরু ও কোরবানী করে। (১ ‘কোরবানী" (আরবি কুর্বনি) শব্দের অর্থ উৎসর্গ ; হজরত ইব্রাহিম ঈশ্বরের নিকট স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নিজ পুত্র ইসমাইলকে উপাস্যের নামে কোরবান করতে উদ্যত হলে ঈশ্বরের মহিমায় তার প্রাণ রক্ষা পায়, ইসমাইলের পরিবর্তে দু'বা জবেহ হয়। সেই ঘটনার পর থেকে কোরবানির রীতি চলে আসছে; হজরত মহম্মদ একে ইসলাম ধর্মের অঙ্গীভূত করেন।)
এটি ধর্মপালনের অঙ্গ ; তবে ধর্মোৎসব ছাড়াও বিবাহাদি সামাজিক উৎসবে এবং উৎসব ব্যতিরেকে গো-মাংস ভক্ষণ উদ্দেশ্যে মুসলমানেরা গরু হত্যা করে থাকে। এদিকে হিন্দুগণ গরুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে, সেই সূত্রে তাদের কাছে গো-হত্যা মহাপাপ।। (২ বেদে বা উপনিষদে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ নয়। প্ৰাচীন আৰ্য সমাজে গোমাংস দ্বারা অতিথি আপ্যায়নের রীতি ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দু সমাজে গোহত্যা ও গোমাংস নিষিদ্ধ নয়। পুরাণে আছে, পৃথু বা বিশ্বপতির নির্দেশে পৃথিবীর ছদ্মরূপ ধারিণী গাভী নিজ দুগ্ধে পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করেন, এজন্য বিশ্বমাতা ও গোমাতা অভিন্ন। ঐ রূপ বিশ্বাস থেকে গরু দেবতারূপে পূজ্য হয়ে আসছে।)
দুই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধধর্মী ধর্মনীতির কারণে গো-হত্যা ও গো-রক্ষা নিয়ে সহজেই কলহ-বিবাদ বেধেছে। এ সমস্যাটি ভারতব্যাপী ছড়িয়ে ছিল।
>১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী গো-হত্যা নিবারণী সভা’ স্থাপন করে গো-রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন। সভার সদস্য ভ্ৰাম্যমাণ সাধুগণ বক্তৃতা, পত্রিকা, প্রচারপত্র, প্রাচীরপত্র প্রভৃতির সাহায্যে গো-রক্ষার আর্দশ প্রচার করতেন। এক সময় ভারতীয় কংগ্রেসকে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়ান হয়।
>১৮৮৭ সালে মাদ্রাজের বার্ষিক অধিবেশনে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় গো-হত্যা বন্ধের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
>১৮৯১ সালে নাগপুরের অধিবেশনে গো-রক্ষিণী সভার সদস্যগণ কংগ্রেসের প্যাণ্ডেলে সভা করার ও চাঁদা তোলার অনুমতি পান। (৩Muslim Community in Bengal, p 199)
>গো-রক্ষিণী সভার ফরিদপুর শাখার সম্পাদক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ গো-হত্যা বন্ধ করার জন্য ‘কসাই-এর গো-হত্যা” শিরোনামে প্রচার পত্র বিলি করে জন মত তৈরি করে।হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গরু বিক্রয় করতে নিষেধ করা হয়, ঐ সঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিজ নিজ জমিদারীতে গো-হত্যা বন্ধ করার আবেদন জানান হয়।
>ফরিদপুরের ‘আঞ্জুমানে ইসলাম মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ করে জেলা— প্রশাসকের কাছে আবেদন পত্র প্রেরণ করে। ঐ আবেদনপত্রে বলা হয় যে, গো-হত্যার প্রশ্নে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নিত্য সংঘর্ষ বাধে ; বিহার ও উত্তর প্রদেশে এ নিয়ে দাঙ্গা হয়ে গেছে ; পূর্ববঙ্গে পূর্বে কোন বিবাদ ছিল না, কিন্তু যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের প্রচারণার ফলে হিন্দুগণ গো-হত্যা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়। মুসলমানেরা এটি মেনে নিতে পারে না, ফলে শান্তি বিঘ্ন হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে। জেলা-প্রশাসক যাতে ঐ রূপ প্রচারণা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেন, ঐ পত্রে তার আবেদন জানান হয়েছে। The Moslein Chronicle, 4 April 1895, p. 138
গো-রক্ষিণী সভার পরেই জমিদারদের স্থান। অনেক জমিদার মুসলমান প্রজাদের ঈদ উপলক্ষে গো-কোরবানি অথবা বিবাহ উপলক্ষে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেন।
>মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ আত্মকথায় (আমার সংসার জীবন)" লিখেছেন, “গোবিন্দপুর,
হরিশঙ্করপুর, সনাতনী, গোপীনগর, আমলা, গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত বড় হিন্দু-জমিদারের জমিদারীভুক্ত ; সেখানকার মুসলমানগণ বহুকাল অবধি গরু কোরবানি করিতে বা গরু জবে ও উহার মাংস ভক্ষণ করিতে পারিত না। কেহ করিলে তাহার আর রক্ষা ছিল না। জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগণ কোরবানিদাতা ও গরু হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্ৰহার ও নানা প্রকার অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট হইতে জরিমানা আদায় করিত। সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ঐ অঞ্চল হইতে গো-কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল।”ইসলাম-প্রচারক, ৮ বর্ষ ৭ সংখ্যা, ১৩:১৪, পৃ: ২৭৫
তিনি আরও বলেছেন, হিন্দু প্ৰজাগণ এ ব্যাপারে জমিদারকে সমর্থন দিত। তিনি বলেন, সভা-সমিতির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে মুসলমানগণ পরিশেষে সাবধানতা ও গোপনীয়তা রক্ষা করে গরুকোরবানের সুবিধা পায়।
‘মোসলেম ক্রনিকলে 'একাধিক সংখ্যায় গো-হত্যা সমস্যার সংবাদ প্ৰকাশ করা হয়। ১৭ মার্চ ১৮৯৫ সালে লেখা হয়, রাজশাহী বিভাগের খোকসার অন্তর্ভুক্ত পানানগর ও অন্যান্য গ্রামের মুসলমানদের প্রতি গো-হত্যার জন্য দুর্ব্যবহার করা হয়। কমিশনারের রিপোটে ঐরুপ গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণে জমিদারের হস্তক্ষেপের উল্লেখ আছে। The Moslem Chronicle, 17 March 1895, p. 16
ময়মনসিংহের অস্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদারগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গো-কোরবানির জন্য জরিমানা করেছিলেন। Ibid. 20 May 1895, p.235
>১৩১২ সনের ৫ জ্যৈষ্ঠ মিহির ও সুধাকর গরু জবাই শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদে বলা হয় যে, চাঁদপুরের কতিপয় মুসলমান ঈদ উপলক্ষে গরু কোরবান দিলে গোপালচন্দ্র নামে এক ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজাদারি নালিশ করেন। প্রকাশ্যে
রাস্তায় গরু জবাই করেছে এবং বদ্ধ জলে মাংস ধৌত করে জল অপবিত্র করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযোগ আনা হয়। জেলা-হাকিম জগদীশচন্দ্র সেন সরজমিনে তদন্ত না করে একজনকে এক মাস কারাদণ্ড, একজনকে ৫০ টাকা ও অপরজনকে ১৫ টাকা অর্থদণ্ড করেন। Ibid, 16 May 1896, p. 224
সাহিত্যের ক্ষেত্রে গো-হত্যা সমস্যা সবচেয়ে গুরুত্ব পায় টাঙ্গাইলের ‘আহমদীতে (১ শ্রবণ ১২৯৫) প্রকাশিত মীর মশাররফ হোসেনের গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে। মশাররফ হোসেন ছিলেন উদারপন্থী এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে সমন্বয়বাদী। তিনি প্ৰবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন, “ভারতের অনেক স্থানে গো-বধ লইয়া বিশেষ আন্দোলন হইতেছে। সভাসমিতি বসিতেছে, বক্তৃতার স্রোত বহিতেছে, ইংরেজি, বাঙ্গালা সংবাদ পত্রিকায় হৃদয়গ্রাহী প্ৰবন্ধে সকল প্ৰকাশ হইতেছে, কোন কোন স্থানে হিন্দু মুসলমান একত্রে এক প্রাণে এক যোগে গোবিংশ রক্ষার উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন। কোন কোন ইংরেজি পত্রিকায় আবার প্রতিবাদও চলিতেছে। এসময় আর নীরব থাকা উচিত মনে করিলাম না।”মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ. ৩১৫
গো-হত্যা উভয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরায় বলে তিনি মুসলমানদের গো-কোরবানি বন্ধ ও গো-মাংস ভক্ষণ ত্যাগ করতে বলেন। তিনি বলেছেন, “এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মুলসমান উভয় জাতিই প্রধান পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্ববন্ধ যে, ধর্মে ভিন্ন, কিন্তু মর্মে এবং কর্মে এক — সংসার কাৰ্য্যে ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে বিপদে সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই। এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কি?”মশাররফরচনা-সম্ভার, পৃ. ৩১৯
>টাঙ্গাইলের অপর পত্রিকা “আখবারে এসলামীয়া” মশাররফ হোসেনের বক্তব্যের প্রথম প্ৰতিবাদ করে ; পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন ছিলেন গোঁড়াপন্থী। তিনি ধর্ম সভায় বক্তৃতার ও পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে মশাররফের প্রতিবাদ করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। “আখবারে এসলামীয়ায় (শ্রাবণ ১২৯৫) প্রথম প্রতিবাদ হয় জনৈক ব্যক্তির প্রেরিত একটি পত্রে।( সম্পাদক মন্তব্য করেন, “আহমদীতে গােকুল নির্মূল সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পড়িয়া নীরব থাকিতে পরিলাম না। আল্লা চাহে এ সম্বন্ধে পৃথকরূপে লিখিব, এবার এসলামীয়ার একটি প্রিয় বন্ধুর প্রেরিত প্ৰবন্ধটা প্ৰকাশ করিলাম।” — মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ. ৩৩০—৪০)
পত্রে ২১টি পরিচ্ছেদে মশাররফের যুক্তি খণ্ডন করা হয়। পত্র শেষে উপদেশ দিয়ে বলা হয়, “সমাজের গ্রন্থি অতিশয় দৃঢ়, একটুক সাবধান হইয়া লিখনি ধরিবেন ; সমাজকে চটাইলে বড় প্ৰমাদ ঘটিবার সম্ভাবনা। উপসংহারকালে একটি হিতোপদেশ না দিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারিলাম না। আপনি তওবা করিয়া পুনরায় মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হউন। তাহা না হইলে আপনার মুক্তিলাভের কোনই উপায় নাই।”(মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ- ৩৪৯-৫০)
দ্বিতীয় প্রস্তাব ‘গোধন কি সামান্য ধন'-এ (শ্রাবণ ১২৯৫) মশাররফ হোসেন বলেন, “মোসলমান শাস্ত্রে গোজাতির গুণের ব্যাখ্যা নাই। — সুতরাং সাধারণ পশুর মধ্যে পরিগণিত। ... অত্রস্থ কোন মৌলবী মহামতির কথার আভাষে বুঝিয়াছি যে, ঐ কথা ভিন্ন আর তাঁহাদের কোন কথা নাই। ঐ কথাটুকু আশ্রয় করিয়াই গোধনের জীবন সংহার করিতে বাধ্য। ... কিন্তু ঐরোপ প্ৰতিবাদ, কি সভাসমিতির ভয়ে, এ অত্যাচার, অন্যায়াচার, হৃদয় বিদারক, মর্মাহত ভীষণ ব্যাপার স্বরূপ গো-হত্যা নিবারণ বিষয়, প্ৰস্তাব লিখিতে অধমের লিখনি ক্ষান্ত হইবে না।”(মশাররফ রচনা-সম্ভার, পৃ. ৩২৮)
ক্রমশ--------------