টপিকঃ সক্রেটিস এর বিচার ও মৃত্যু
সক্রেটিস এর বিচার ও মৃত্যু
সক্রেটিস দেখতে মোটেও সুদৰ্শন ছিলেন না । প্রাচীন সাহিত্য ও দর্শনে তাঁর সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, আর প্রাচীন ভাস্কর্য ও চিত্র থেকে তাঁর চেহারার যে আভাস মেলে-তা থেকে এমন ধারণাই করতে হয় । গোলগাল, কিছুটা মোটাসোটা টাক-মাথা , সেইসঙ্গে থ্যাবড়া নাক । মোটের ওপর চেহারাটা তার আকর্ষণীয় ছিল না একেবারেই । তার পরও, সেই সময়ের এথেন্সের তরুণ-যুবকেরা এসে ভিড় জমাচ্ছিল তার চারপাশে, পেতে চাইছিল তাঁর সান্নিধ্য, শুনতে চাইছিল তাঁর কথা ।
সমাজের নানা শ্রেণী থেকে আসছিল এ সকল তরুণ । এদের মধ্যে ছিলেন প্লেটো”৩ ও অ্যালসিবিয়াডেসের মতো ধনী-বংশের ছেলেরা। সক্রেটিসের মুখে এথেনীয় গণতন্ত্রের ব্যঙ্গাত্মক বিশ্লেষণ শুনে মজা পেতেন এরা । ছিলেন অ্যান্টিসথেনেসের মতো সমাজতন্ত্রী; সক্রেটিসের দারিদ্র্যাক্লিষ্ট জীবনই আকর্ষণ করে এনেছিল একে ৷ ছিলেন, এমনকি অ্যারিস্টিপ্পাসের মতো সব কিছুতে বিশ্বাস হারানো এক যুবক।সমাজকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোয় বিশ্বাস করতেন ইনি, স্বপ্ন দেখতেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে সব মানুষই হয়ে উঠবে সক্রেটিসের মতো মুক্তমনা ।
কোন আকর্ষণে সক্রেটিসের কাছে ছুটে আসছিল এ সকল তরুণযুবক?
মূল একটি কারণ হয়তো ছিল-অসাধারণ একজন দার্শনিক হবার পাশাপাশি, মানুষ হিসেবেও সক্রেটিস ছিলেন অনন্য । অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি। সাহসীও ছিলেন খুব । নিজের জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বঁচিয়েছিলেন অ্যালসিবিয়াডেসের । আর, সক্রেটিসের অন্য যে বৈশিষ্ট্যটি মুগ্ধ করত তরুণদের, তা তার জ্ঞানের নম্রতা, তার নিরহংকারী বিনয় । নিজেকে কখনোই জ্ঞানী বলে দাবি করতেন না তিনি । বলা হয়ে থাকে, ডেলফি মন্দিরের ‘ওর্যাকল’ গ্রিকদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল সক্রেটিসের নাম । এ ঘোষণাকে, শেষপর্যন্ত, মেনে নিয়েছিলেন সক্রেটিস; কিন্তু, সেইসঙ্গে, বলেছিলেন এ কথাও
: ‘আমি একটা জিনিসই শুধু জানি, তা হচ্ছে-আমি কিছুই জানি না ’।
দর্শনের আরম্ভ সেখানেই, যেখান থেকে মানুষ প্রশ্ন করা শুরু করে । বিশেষ করে যখন সে প্রশ্ন করে তার নিজের বিশ্বাস, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণাগুলোকে । এসব বিশ্বাস আর ধারণার আপাত অভ্রান্তির পেছনেই কখনো কখনো ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজস্ব লোভ, নিজস্ব স্বার্থ। দর্শন কখনোই সত্য হয়ে ওঠে না যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার নিজের মনকে খতিয়ে না দেখে । যেমন বলেছিলেন সক্রেটিস : “নিজেকে জানো '**
এথেন্সের বাজারে, পথেঘাটে নানা মানুষকে, নানা সময়ে, আত্মসমীক্ষণে প্ররোচিত করতেন সক্রেটিস । শেখাতে চাইতেন- কীভাবে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে হয় । কেউ যদি জোরালোভাবে ন্যায় ও অন্যায় বিষয়ে কথা বলত, নিরীহ গলায় জানতে চাইতেন- কাকে বলে “ন্যায়?
বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রয়োজনে, মানুষ বিমূর্ত যে সকল ধারণাকে শব্দের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে, নিশ্চিন্ত মনে ব্যবহার করে চলে-শব্দের আড়ালের ওই ধারণাগুলোকেই প্রশ্নের শরে বিদ্ধ করতে উদ্ধৃদ্ধ করতেন সক্রেটিস।
সম্মান কাকে বলে? মানবগুণ কাকে বলে? নীতি কী? মানবসত্তা কী? দেশপ্ৰেম কী? কেমন রাষ্ট্র চাই?
অবিরাম প্রশ্নের এই বাণে, একসময়, নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলেন তিনি। যুদ্ধের সময় সেটা। রাষ্ট্রের যেকোনো রকম সমালোচনা করাই বিপজ্জনক । তার ওপর, যে-সময়ে গণতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার নানা অসংগতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছিলেন নিজেদের চিন্তায় ওইরকম অজস্র অসংগতিকে চিহ্নিত করতে, সেগুলো পরিহার করতে-সেই একই সময়ে, সম্ভ্রান্ত বংশের কিছু নেতা গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ।
কারমিডেস, ক্রিটিয়াস, অ্যালসিবিয়াডেসের মতো, এদের কেউ কেউ ছিলেন সক্রেটিসের সরাসরি ছাত্র। যুদ্ধে স্পার্টার কাছে এথেন্সের পরাজয়ের পরপর, ক্ষমতার দখল নেন এরা । কিন্তু, সে অভু্যুত্থান সফল হতে পারেনি। মাত্র এক বছরের মাথায় পতন হয় “তিরিশ নেতার শাসন" । আর, এঁদের হটিয়ে, গণতন্ত্রপহীরা আবার যখন ক্ষমতায় ফেরেন, তখনই অভিযোগ আনা হয় সক্রেটিসের বিরুদ্ধে । সন্দেহ করা হয়, ব্যর্থ ওই অত্যুত্থানের মূল ইন্ধনদাতা তিনি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অভিযোগ আনা হয়, তাতে বলা হয় : সক্রেটিস অধাৰ্মিক; এথেন্সের প্রচলিত দেব-দেবীর প্রতি বিশ্বাস নেই তার; আর, এথেন্সের তরুণ প্ৰজন্মকে তার দর্শনচর্চার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করছেন তিনি, ঠেলে দিচ্ছেন বিপথে । ফলে, কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় সক্রেটিসকে । বিচারে মৃত্যুদণ্ড সাব্যস্ত হয় তাঁর ।
সক্রেটিসের বিচারের সময়ে প্লেটোর বয়স ছিল আটাশ । বিশ বছর বয়স থেকে, একটানা আট বছর, সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন প্লেটো। আর, আরো ছোট বয়স হতেই চিনতেন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে।
পরবর্তীতে, সক্রেটিসের এই বিচারের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন প্লেটো তার অ্যাপলজি শীর্ষক ‘ডায়ালগ’টিতে । বিচারের পুরো সময়টাতেই বিচারস্থলে উপস্থিত ছিলেন তিনি। আর উপস্থিত ছিলেন সক্রেটিসের অন্তিম মুহূর্তেও : কারাগারের নিভৃত কক্ষে যখন হেমলকের পেয়ালা তুলে চুমুক দিচ্ছিলেন সক্রেটিস । হৃদয়বিদারক সেই অন্তিম দৃশ্যের বর্ণনা আছে প্লেটোর ফিডো” নামের ডায়ালগটিতে। এই ডায়ালগেরই শেষ বাক্যে মথিত হয়ে আছে পরম শ্ৰদ্ধেয় শিক্ষকের জীবনাবসানের পরপর এক ছাত্রের বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস : “এভাবেই চলে গেলেন আমাদের বন্ধু; সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, তিনি ছিলেন আমার দেখা সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে ন্যায়বান-সবার চেয়ে সেরা মানুষ **
বইঃসক্রেটিসের আগে লেখকঃ আহমেদ খালেদ