টপিকঃ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং চাঁদাবাজি
আজকের গল্পটা ভালবাসার,
আজকের গল্পটা তিক্ত অভিজ্ঞতার,
আজকের গল্পটা সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার...
আমি লিঙ্গ বৈষম্যে বিশ্বাসী নই। নারী পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কেউ কারো থেকে আলাদা নন। মহান স্রষ্টা নিজ হাতে তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে তিনি নিশ্চয় একইরকমভাবে ভালবাসেন। কিন্তু পার্থক্যটা তৈরি করছি আমরা...
আমি যখন খুব ছোট, তখন থেকেই আমাদের এলাকার কাচা বাজারের প্রথম দোকানটাতেই একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে কেনা বেচা করতে দেখতাম। উনি একেবারেই স্বাভাবিক একটি জীবন যাপন করছিলেন এবং আমি কখনই তাকে দেখিনি অন্য কাউকে উত্যক্ত করতে অথবা কেউ তাকে কটু কথা বলছে সেটাও দেখিনি। হঠাৎ একদিন সে গায়েব হয়ে গেল! এরপর তাকে অদ্ভুত পোষাকে রাস্তা ঘাটে মানুষকে ধরে জোর করে টাকা আদায় করতে দেখলাম আমি... এখনো সে এভাবেই আছেন।
এবারের অংশটা কয়েক মাস আগে আমার অফিসের। আমি যখন অফিসের লিফটে উঠবো তখন পাশে প্রায় ৮/১০ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তারা লিফটে উঠতে অস্বস্থিবোধ করছিল। আমি তাদের গন্তব্যস্থল পঞ্চম তলাতে উটতে সাহায্য করলাম। যদিও তারা তখন আমাকে ধন্যবাদ জানায়নি, শুধু আড়চোখে দেখল। এরপর আমি আমার একজন ক্লায়েন্টকে নিয়ে আমার প্যানেলে গিয়ে বসলাম। পুরো অফিসে সেদিন আমরা দুইজনই ছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ হুড়মুড় করে সেই ৮/১০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আমার অফিসে ঢুকে আমার রুমে মোটামুটি আমাদের ঘিরে দাঁড়ালো এবং তাদের বিশাল অঙ্কের টাকার একটা চাহিদা জানিয়ে দিল। টেবিলের উপর অফিসের সদ্য কেনা এডিটিং পিসি এবং আমাদের দুইজনের চারটি মোবাইল সহ আরও অনেক দামি জিনিশপত্র ছিল। তারা সেদিকে বারবার ইশারা করে টাকা না দিলে কি করবে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল।
সেদিন আমার অফিসে আর কারো আসার কথা নয় এবং আমার কাছে শুধুমাত্র দুপুরের লাঞ্চ এবং বাস ভাড়া ছাড়া একটাকাও অতিরিক্ত ছিল না। আমার ক্লায়েন্টের বাসা অফিসের পাশে হবার কারণে সে মানিব্যাগ ছাড়াই এসেছে। তাদেরকে আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনভাবেই তারা সেটা মানতে নারাজ। ফোন করে হলেও কাউকে না কাউকে আমার ডেকে আনতেই হবে অন্যথায় এবার তারা অশ্লীল সব হুমকি দেওয়া শুরু করলো। এর মাঝে তারা ঐ ভবনের অন্য সব অফিস থেকেই টাকা সংগ্রহ করে ফেলেছে।
আমি আমার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের গল্প ভাবনার সময়েও সেখানে এমন একটা সমাজ দেখাতে চেয়েছি যেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা অত্যন্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে, তারা আমাদেরই ভাই বোন, তারা আমাদেরই কাছের মানুষ। কিন্তু তাদের সেদিনের অকস্মাৎ এই আক্রমণ আমাকে ব্যথিত করেছিল। অনুভব করতে পারছিলাম আমার চোখের কোণে পানি জমে গেছে। সেদিন আমার দুপুরের লাঞ্চের টাকাটা তাদেরকে দিয়ে দিতে হয়েছিল।
না খেয়ে থাকাটা বা টাকা দেওয়া নিয়ে কোন কষ্ট আমি পাই নাই। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তাদের প্রতি আমার ভালবাসায় আঘাত এসে পড়ায়।
গত দুইদিনে মিরপুর থেকে মগবাজার যেতে তিনবার বাসে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন এসে সবার থেকে একরকম বিদ্রূপ করতে করতে কিছু কিছু পয়সা নিয়ে গিয়েছে। কেউ কিছু বলেনি, কেউ কিছু ভাবেনি। শুধু আমি ভাবছিলাম আমার ছোটবেলায় দেখা সেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটির কথা যাকে দেখেছিলাম কিছুটা সময়ের জন্য হলেও সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় টিকে থাকতে...